শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০১৬

রক্তিম মিলন -এর কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ

কবিতা পড়ি। কবিতা পড়ি না। কেন কবিতা পড়ি না?




কবিতায় প্রেম, দ্রোহ, অনুরাগ, বিরাগ, ভালবাসা সব কিছু থাকে। এই থাকা বড় জটিল। জটিলতায় কবিতা প্রবহমান। এই জটিলতা পাঠকের নিকট কবিতার অর্থ আর কবিতার তথ্য ও তত্ত্বে। কারণ কবিতায় যে তথ্যের যোগান দেয়া হয়, সেই তথ্য থাকে একটি মোড়কের ভিতর। পাঠককে নিজ দায়িত্বে সেই মোড়ক খুলতে হয়। কবি সেই দায়িত্ব এড়িয়ে কবিতা লেখেন। নজরুল কবিতায় লিখেছেন, 'আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার'। কিন্তু নজরুল কবিতায় 'ইস্রাফিল' এবং তাঁর 'শিঙ্গা'কে পাঠকের নিকট পরিচিত করাননি। নজরুলের কবিতায় মিথ ও পৌরাণিক চরিত্রের ব্যবহার পাঠককে নিযে যায় সুদূর অতীতে। কবিতার লাইন 'ভীম রণ-ভূমে রণিবে না'। কবিতা পড়তে পড়তে মহাভারতের ভীমকে চেনা যায় না। কবিতার ভীম নিজ পরিচয়ে থাকেন মহাভারত নামক মহাকাব্যে আর বিদ্রোহী কবিতায় আছেন একটি মোড়কে। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে এই মর্মোদ্ধার এবং পরিচয় উদ্ধার অসম্ভব।

 কবিতার তত্ত্বে কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওর্থ বলেছেন, সকল কবিতা হচ্ছে কবির শক্তিশালী আবেগের উদগিরণ। তাঁর মতে কবিতা সৃষ্টি হয় কবির ভিতর জমা হওয়া আবেগের গভীর প্রবাহ থেকে। এই তত্ত্বে কবির বিখ্যাত অনেক কবিতা সৃষ্টি হয়েছে। পাঠক সাদরে এবং সোগ্রাসে তাঁর কবিতা পড়ছে এবং পড়বে। তাঁর কবিতা টেমস, রাইন, হাডসন নদীর পাড় থেকে বঙ্গভূমের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা পাড়ের মানুষজনও পড়ে। কিন্তু কবিতায় তাঁর তত্ত্বকে প্রত্যাখান করেছেন আরেক বিখ্যাত কবি টি.এস. ইলিয়ট। তাঁর মতে কবিকে কবিতা লিখতে হলে ব্যক্তিগত আবেগ পরিহার করে অন্য আবেগ ধারণ করতে হবে। এই আবেগ হবে ব্যক্তি সত্তা বিসর্জন। আত্মসত্তা এবং ব্যক্তিকসত্তা পরিহারের মধ্য দিয়ে কবি হয়ে উঠবেন পরিপূর্ণ। কবিতার তত্ত্বে কবিদ্বয় পরস্পর বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করলেও পাঠক সমাজ তাঁদের দুজনকেই সমাদরের সহিত গ্রহণ করেছে। তাঁদের কবিতা আনন্দের সাথে পড়ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নির্ভুল কে? নির্ভুলতার বিচারে পাঠক নৈর্ব্যক্তিক থেকেছে। পাঠক সমাজ অজান্তেই অ্যারিস্টটলের মতবাদকে মেনে নিয়েছে। নির্ভুলতার প্রশ্নে অ্যারিস্টটল তাঁর কাব্যতত্ত্ব গ্রন্থে জানিয়েছেন, 'নির্ভুলতার মানদন্ড কাব্যে এবং রাজনীতিতে বা অন্যান্য শিল্পকর্মে আলাদা আলাদা'। নৈর্ব্যক্তিক পাঠক সমাজ বিভিন্ন শিল্পের শিল্পগুণ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার দায়িত্ব যেমন এড়িয়ে গেছে তেমনি এড়িয়ে গেছে দুই কবির কবিতা তত্ত্ব। পাঠককুল তাঁদের তত্ত্বের কপচানো তেতো আলোচনা থেকে বেরিয়ে গ্রহণ করেছে সৃষ্ট কবিতা সম্ভার।

পারস্পরিক বিরোধিতা শুধু ওয়ার্ডসওর্থ এবং ইলিয়টের মধ্যেই থেমে থাকেনি। তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন গুরু এবং শিষ্য। অ্যারিস্টটলের গুরু প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবিদের বিতাড়িত করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, চরিত্র গঠনে সাহিত্যের প্রভাব হানিকর। কিন্তু প্লেটোর একাডেমিতে অধ্যয়নকারী, দীর্ঘ ঊনিশ বছর তাঁর সঙ্গে সময় কাটানো ছাত্র অ্যারিস্টটল উক্ত মতবাদ প্রত্যাখান করে বলেছেন, সাহিত্য সত্য নির্ভর। এবং প্রমাণ করেছেন সাহিত্যের প্রভাব মূলত শুভ। তাঁর দৃষ্টিতে কবিরা ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা করেন না, ঘটতে পারে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইঙ্গিতও করেন।

কবিতা পাঠে নিরন্তর আনন্দ লাভ হয়। পাঠক পুলকিত হবার জন্য কবিতা পড়ে। কিন্তু পুলক আর পুলকিত হবার শিহরণ কমছে নানা কারণে। কবি নিজ আনন্দে কবিতা লেখেন। বর্তমান ইনফরমেশনের যুগে কবিতায় পাঠকের এক প্রকার অরুচি তৈরি হয়েছে। এই অরুচির কারণ তথ্য যুদ্ধ (ইনফরমেশন ওয়ার)। পাঠক সরাসরি তথ্য (ইনফরমেশন) চায়। পাঠককুল কর্মব্যস্ত বিশ্বায়নে নিছক আনন্দযজ্ঞে গা ভাসাতে চায় না। তাঁরা কবিতার জন্মান্তরের ভিতর দিয়ে তত্ত্ব বা তথ্য নিতে অনিচ্ছুক। কারণ কালিদাসের যুগ পেরিয়ে এখন ইন্টারনেটের যুগ চলছে। প্রযুক্তির রসহীন বাস্তবতায় মানুষ দুর্বোধ্যতায় থাকতে চায় না। কিন্তু কবিতায় এরকম চলে হারহামেশাই। একটু ব্যাখ্যা করা যাক, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীতে বিশু গেয়েছে, 'তোর প্রাণের রস শুকিয়ে গেলে ওরে….'। আবার এই একই গান গীতবিতানে আছে। এবং এই সর্বনামের ব্যবহারে পাঠক থৈ হারিয়ে ফেলে। রবীঠাকুরের ‘তোর‘, ‘তুমি‘ কে? প্রেমিক না স্রষ্টা। এই সমূহ দোলাচলে সাধারণ পাঠক বলে বসে, ভাই কবিতা বুঝি না, তাই কবিতা পড়ি না, এত জ্ঞান আমার নাই, কবিরা কীভাবে এতসব লেখে, ইত্যকার নানা মন্তব্য। আর সমূহ মন্তব্যের ভারে চাপা পড়ে কবিতার স্বাদ।

দি নেসেসিটি অব আর্ট গ্রন্থে আর্নস্ট ফিশ্চার লিখেছেন, 'ধ্রুপদী সাহিত্যের যুগে কবিতা অত্যন্ত মনোরম ও আকর্ষণীয় চিন্তা বা আবেগ। কবিতা ভাষা তৈরির কারখানা।'

মানুষ আনন্দ পেতে নতুন নতুন কবিত লেখে। কবিতায় নতুন তত্ত্বের জন্ম দেয়। গ্রহণ ও বর্জনের মধ্য দিয়ে কবিতা এগিয়ে যায়। মানুষজন বুঝে না বুঝে কবিতা পড়ে। আবার খুব ভাল করে বোঝার জন্য গবেষক হয়। অনুসন্ধান করে নতুন বিষয় তুলে আনে। কিন্তু একই সাথে বিশ্বায়নের কর্মব্যস্ততা মানুষকে কবিতাহীন করে তোলে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন