শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

'ক্যালেন্ডার সিরিজ' থেকে পাঁচটি কবিতা : জয়ন্ত জিল্লু



এক.
একটা ফুটবল নিয়ে আমরা ক্যালেন্ডারে খেলছি। আমরা এই কারণে খেলছি যাতে আমরা ক্লান্ত হই। কেননা আমরা ক্লান্ত হতে হতে কিছু তারিখ মুছে দিতে চাচ্ছি। কেননা ক্লান্ত হলে কিছু দিনে আমরা একটা ক্রস চিহ্ন এঁকে দিতে পারব। ওভাবে কোনো একদিন একটা মাস নাই হয়ে যেতে পারে। ধরলাম, ওই নাই হয়ে যাওয়া মাসটি অক্টোবর। যেহেতু মাসটি আসন্ন, কিন্ত নাই হয়ে গেছে সেহেতু আমরা নভেম্বর পর্যন্ত ফুটবল খেলব। ক্যালেন্ডারে এভাবে সব খেলা যায়। আমরা ফুটবল খেলছি। কেউ কেউ ঠিক এই মুহুর্তে খেলছে সাপলুডো; আর যারা ঠিক দাবা খেলছে তাদের ঘাড়ে রাজা সওয়ার হয়েছে। এবার ভাবুন, ক্যালেন্ডারে দাবা খেলতে খেলতে নভেম্বর অব্দি একজন রাজাকে বয়ে বেড়ানো সহজ কথা নয়। এই যে সহজ নয়, সেটাই ক্যালেন্ডার। ওখানে তারিখসমেত কঠিন হয়ে আছে নির্দিষ্ট বার, নির্দিষ্ট মাস: আরও বেশি কঠিন আছে অবহেলা গাছটি। সেই গাছ যা তুমি আমার বুকে রোপণ করে দিয়েছিলে।

এখন গাছটির ফল না-দেওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারি।



দুই.
আমাদের ক্যালেন্ডার স্বভাব ভিন্ন, বালিকা বৃত্ত আঁকে তারিখের উপর। তারিখ তখন স্তন হয়ে যায়। আর, ক্রস চিহ্ন আঁকা বৃত্তগুলো ভালোবাসার তীর হয়ে বুকে বিঁধে। কিংবা আস্ত ক্যালেন্ডার হতে কেউ কেউ দেহ লুকিয়ে ফেলে। দীপিকার নাভী লুকাতে গিয়ে শৈশবে আমার মনে পড়েছিল ধানগাছ ও বিষণ্ণ বিলাপের। আরেকটা ক্যালেন্ডার ছিল, যেখানে একটা ঈগল। উফ, আমাদের মস্তিষ্ক খেয়ে ঈগল যখন ওই সীমান্তে তখন কাঁটাতারে ফেলানীর লাশ দেখেছি। গোয়ালিনী দুধের বিজ্ঞাপনে শৈশব হাডুডু খেলে, আর তারিখ দুই মই নিচে নামে। আমাদের বয়স তখন সাত দু গুণে চৌদ্দ। বালকের ঠোঁটে তখন লজ্জা, বালিকার ফ্রকে বিবিধ জ্যোতি! এভাবে ক্যালেন্ডারে হয় মাছচাষ। মাঝেমধ্যে প্রণয়ের পাপ। বড় হয়ে ক্যালেন্ডারে আমরা মই এঁকে উপরে উঠি। তারিখ লাফিয়ে উচ্চলাফ প্রতিযোগিতায় যখন অনেকের বাড়ি-গাড়ি হয়, ততদিনে ক্যালেন্ডারের সাল পাল্টে যায়। এমন পাল্টানো একটা সালের নাম একাত্তর, একটি তারিখ ১৫ই আগস্ট: আর লাল হয়ে যাওয়া ক্যালেন্ডারের নাম শেখ মুজিব, যার ছোট অক্ষর শেখ রাসেল! 




তিন.
ক্যালেন্ডারে দশজন মানুষ আছে। আর দশটা বৃত্ত এঁকে সেটা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্র বরাবর। রাষ্ট্রের তরফ থেকে সেটা দেওয়া হয়েছে র‍্যাবের কাছে। র‍্যাব দশজন ব্যক্তির জন্য দশটা গুলি বরাদ্দ করে রেখেছে। এখন গুলি হবে। গুলির সাথে শব্দ হবে। মনে রাখুন, এই শব্দটা আপনি পত্রিকায় পাবেন না। সুতরাং এনকাউন্টার গল্পটি পড়তে পড়তে আপনি গুলির শব্দের কথা ভাবুন। ভাবুন ক্যালেন্ডারের দশ ব্যক্তিকে একটা নির্জন মাঠে নেওয়া হয়েছে। মাঠের উপর এক ফালি আকাশ। আকাশে গোল করে ফুটে আছে চাঁদ। এই ফাঁকে তাদেরকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। দশটা গুলির শব্দ হলো একসাথে। একটা চাঁদ ভাঙলো। চাঁদটা আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার আগেই পত্রিকার রিপোর্ট লেখা হলো। কিন্তু আপনি কোথাও ক্যালেন্ডার, গুলির শব্দ ও একটা চাঁদ ভেঙে পড়ার শব্দ পত্রিকায় পাননি। অথচ চা খেতে খেতে আপনি খবরটি পড়েছেন। বিশ্বাস না হয়, আপনি আরেকটি চা খান, আর চা খেতে খেতে রাষ্ট্রের দিকে তাকান। 




চার.
কেবল ১৭ তারিখ। ক্যালেন্ডারে ঐদিন জলপাই রঙ অন্ধকারে চুপচাপ কাঁদছে কল্পনা। কল্পনাকে আমরা টুকটাক চিনি। মেয়েটার গায়ের রঙ ফর্সা। এমন আরেক ফর্সা মেয়ের নাম তনু। খাদিজাকেও আমরা ওভাবে চিনি হয়ত। যেহেতু তাঁরা কেউ কথা বলে না, সেহেতু তারা ক্যালেন্ডারের ভাষায় কথা বলে। সেহেতু ক্যালেন্ডারের রঙ লাল হয়। এই লাল রঙে সংবাদপত্রে ধর্ষণের গল্প ছাপা হতো একদা। যেহেতু ধর্ষণ আমাদের চোখে একটা গল্প। সেহেতু এই গল্পের নায়িকারা লাল রঙে ঘুমায়। সেই লাল রঙ আবার শুক্রবার ধরে জুমার নামাজ পড়তে যায়। একদিন, দুইদিন, তিনদিন... এভাবে সাড়ে চুয়াত্তর দিন পার হলে বুঝতে পারে তাদের শুক্রবার ছেড়ে যেতে হবে বুধবারে। বুধবার একটা চুপচাপ দিন। এই দিন খাদিজা মরে যাবে, এইদিন কবর থেকে হাত তুলে মোনাজাত করবে ইয়াসমিন। তারচেয়ে বড় কথা, এইদিন কেউ প্রেসক্লাবে গিয়ে প্রতিবাদ করবে না। এমন একটা চুপচাপ ঠাণ্ডাদিনে ক্যালেন্ডারে বরফ জমে, সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসে শোকপাখি। তারপর, জমতে থাকা বরফে তনুর শরীর হতে পারদ নেমে যেতে থাকে। আর, এসব পুরুষের থার্মোমিটারে মাপা হচ্ছে ক্যালেন্ডারে, যেখানে বুধবার একটা নিরীহ ও চুপচাপ দিবসের নাম। 



পাঁচ.
একদিন আমরা পোশাক খুলে বসে ছিলাম। ঠিক এই সময় ক্যালেন্ডারে বৃষ্টি হলো। বৃষ্টি পরবর্তী জ্বর এলো রহিম চাচার। তাকে আমরা ভিজতে ভিজতে একটা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। হাসপাতালে ডাক্তার নেই, নার্স ঘুমুচ্ছে। যেহেতু এই ঘুমটাও ক্যালেন্ডারে হচ্ছে, সেহেতু তাকে ডাকার জন্য আমাদের একটি নির্দিষ্ট দিন কেটে দিতে হচ্ছে। শনি থেকে শুক্র। রহিম চাচা ব্যতিরেকে আমরা তখন ছয়জন ছিলাম, এবং আমরা একেক জন একেকদিনে জন্মেছিলাম।  কেবল রহিম চাচা জন্মেছিল শুক্রবারে। তারপর আমরা শুক্রবারটি কেটে দিয়ে নার্সের ঘুম ভাঙালাম এবং নিজেরাও জানাজার ওজু করতে চলে এলাম।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন