শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

দ্বিধাহীন একদিন : কাব্যগ্রন্থ হিসেবে কতটা সমৃদ্ধ?

প্রচ্ছদ : পল্লব শাহরিয়ার 

| |এক| |

   উত্তরের শহর রংপুর থেকে সাম্প্রতিক প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ 'দ্বিধাহীন একদিন'। চৌদ্দজন লেখকের এটি একটি যৌথ প্রয়াস। লেখকরা মূলতঃ উত্তরবঙ্গেরই পরিচিত মুখ। সম্পাদনা করেছেন শ্রদ্ধেয় দুই লেখক— আসহাদুজ্জামান মিলন ও সোহানুর রহমান শাহীন। প্রচ্ছদ নির্মাণে পল্লব শাহরিয়ার প্রশংসনীয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। গ্রন্থটির উৎসর্গপত্রে রয়েছে রংপুরের শ্রদ্ধেয় দুই প্রয়াত কবি— নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ ও রোমেনা চৌধুরী'র নাম। কাগজ, মুদ্রণ, বাঁধাই প্রভৃতি বাহ্যিক বিবেচনায় একটি সফল বই সাজিয়েছে রংপুরেরই প্রকাশনী—পাতা প্রকাশ। এ সবকিছু একপাশে রেখে কাব্যগ্রন্থ হিসেবে কতটা সমৃদ্ধ 'দ্বিধাহীন একদিন'?
   বইটি হাতে পাওয়ার পর তিন-চার দিনে পুরোটা শেষ করতে সক্ষম হয়েছি। রংপুরের লেখক মহলে উঠবস থাকায়, স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের প্রায় সকল লেখকই পরিচিত মুখ। তাঁদের অনেকের লেখা আগে পড়া হয়নি; এই বইয়েই প্রথম পড়া। বইটিতে প্রত্যেকের দশটি করে কবিতা থাকায় তাঁদের লেখার উপর সম্যক ধারণা লাভে সক্ষম হয়েছি। প্রত্যেক লেখকের লেখার উপর পৃথকভাবে ভালো-মন্দ কিছু ব্যাপার অবলোকন করেছি। সবমিলিয়ে সম্পাদক ও লেখকদের প্রতি রয়েছে কিছু অনুযোগ।
   কিছু তিক্ত সত্য কথা। মাত্র গুটিকয়েক কবিতা ব্যতীত কোন কবিতায় নিঃশ্বাস খুঁজে পাইনি আমি। শুধু দীর্ঘ কবিতা হলেই নিঃশ্বাস গাঢ় হয় না; এক লাইনের কবিতার মাঝেও গভীর নিঃশ্বাস থাকে। কবিতায় থাকা চাই যথার্থ উপমা ও চিত্রকল্প। কবিতার নাম করে মাঝেমাঝে ঢুকে পড়েছে অনেক ছড়া এবং অকবিতা! অনেকেই অন্ত্যমিলের ব্যবহার এমনভাবে দেখিয়েছেন, যেন এটাই কবিতার একমাত্র ছন্দ, এছাড়া কবিতা হতেই পারে না। অথচ এটা করতে গিয়ে তাঁর কবিতাটিই হয়ে গেছে অন্তঃসারশূন্য! এভাবে কেউ ছড়া চালিয়ে দিয়েছেন। কারও আবার ছড়া-কবিতা কিছুই হয়নি, হয়েছে—অকবিতা! কেউ একটি চিত্রকল্পকে ধারণ করে এমনরূপে সাজিয়েছেন তার সবকটি লেখা, স্বভাবগত ভাবে যা পাঠকমনে একঘেয়েমির উদ্রেক হতে বাধ্য। কিছু শব্দের ভুল প্রয়োগ, বানানভুল এবং যতিচিহ্নের অপ্রাসঙ্গিক ব্যবহার সম্পাদকদের দায়িত্বকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু সম্পাদকীয় লিখে কোন সম্পাদক দায়মুক্ত হতে পারেন না। যখন দেশের অধিকাংশ জাতীয় দৈনিক প্রায় নির্ভুল ভাবে পত্রিকা প্রকাশ করে যাচ্ছে প্রতিদিন, তখন এগারো ফর্মার একটি কাব্যগ্রন্থে একটি ভুলেরও ব্যাপকতা বিশাল ব্যাপার। কয়েকটি ভুল অনেকবার দেখতে হয়েছে—বাড়ী, গাড়ী, ভাঙ্গা আরও কিছু। 'একাডেমী' বানানটি যদি ভুল হয়ে থাকে, তবে উল্লেখিত শব্দ তিনটিও ভুল। এগুলোর শুদ্ধরূপ যথাক্রমে: বাড়ি, গাড়ি, ভাঙা। 'কি' এবং 'কী' এর উল্টো প্রয়োগ চোখে পড়েছে। এছাড়াও যতিচিহ্নের অপ্রাসঙ্গিক ব্যবহার এবং ব্যবহার না করার মতো ভুল এতো পরিমাণ দেখেছি, যা উল্লেখ করা বেশ কষ্টসাধ্য। 

| |দুই| |

   এ পর্যায়ে একটু চোখ বুলিয়ে আসা যাক 'দ্বিধাহীন একদিন' কাব্যগ্রন্থে। বর্ণানুক্রমে প্রথমেই কবি আদিল ফকির। গ্রামীণ আবহ তাঁর চর্চায় বেশ উজ্জ্বল; জীবন ও প্রকৃতি তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু। কবিতার ভাব-ভাষা সরল। এ গ্রন্থের কবিতাগুলোতেও সে পথেই এগিয়েছেন। ভালো কিছু উপহার দিয়েছেন: 'প্রশ্ন' কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, 'গরুগুলো ঘুরেফিরে সবুজ পাতা খায়/মুসলমান-হিন্দু কী খুঁজে পায়?'। 'ব্যস্ত গ্রহের গল্প' কবিতায় শেষের বিস্ময়, 'ও বাবা, তারাও এখন ব্যস্ত। ধান কাটা নিয়ে, না—মানুষ কাটা নিয়ে।' কিছু ভুল প্রয়োগও দেখেছি: 'সময়-২' কবিতায় অসামঞ্জস্য সম্বোধন, 'মা! এ...! মা কই গেল?' এখানে 'এ' এর স্থলে 'ও' লেখা উচিৎ হতো। 'দলছাড়া' কবিতার দ্বিতীয় লাইনে ভুল শব্দচয়ন, 'সুখ-দুখোতে'। এখানে 'দুখোতে' না লিখে 'দুঃখে' বা 'দুখেতে' লেখা সমীচীন ছিলো। কবিতার গঠন নির্মাণে তাঁকে আরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন ছিলো।
   আসহাদুজ্জামান মিলন। এ গ্রন্থের সম্পাদনায় ছিলেন। তাঁর লেখার হাত বেশ পুরনো। পাঠক নিঃসন্দেহে তাঁর কাছে ভালো লেখা প্রত্যাশা করে। লিখেছেনও বেশ: 'অমৃত সুধা' কবিতায় নিরেট সত্য উপস্থাপনা, 'শেষ পর্যন্ত পরাজিত হতেই হয় শরীরের কাছে।' এছাড়াও টুকরো সংলাপধর্মী কবিতা 'চুপ! একদম চুপ' নিঃসন্দেহে দারুণ রোমান্টিক সৃষ্টি। তবে সম্পদকের লেখাতেও বানান ভুল দেখেছি: 'অমৃত সুধা' কবিতায় 'নিঃশ্বাস' শব্দের ভুল বানান—'ভারী নিঃস্বাসে অমৃত সুধা পানে ব্যস্ত'। 'নগ্ন পায়ের পায়েল ছুঁলে' কবিতায় 'ব্যালকনি' শব্দের ভুল বানান—'চিলেকোঠার বেলকুনি- আভা আলোর হাতছানি'।
   আশরাফুজ্জামান বাবু। অধিকাংশ কবিতায় ভালো বিষয়বস্তু বেছে নিয়েছেন—মা, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা। কিন্তু কবিতার ভিতরে তা তিনি দাঁড় করাতে পারেননি। অন্ত্যমিল ঠিক রাখতে গিয়ে কবিতা গাম্ভীর্যহীন করে ফেলেছেন। প্রথম কবিতা 'বঙ্গমাতা' রীতিমত পুঁথিসাহিত্য পর্যায়ে নিয়ে গেছেন—''রেণু' মিশন স্কুলে যায়, বন্ধু, পড়ার বই/চলো ওই 'রেণু'র কথা আরো কিছু কই।' 'মায়ের ভালোবাসা' ও 'সবাই বলে আছে সে' লেখা দু'টি কবিতার নামে ছড়া সাজিয়েছেন। 'আমি হবো নায়ক মেসি'—এটি কবিতাই হয়নি (আমিও ব্যক্তিগতভাবে ফুটবলে আর্জেন্টিনার সমর্থক; মেসি প্রিয় ফুটবলার)।
   কুশল রায় লিখেছেন সহজ ভাষায়, ধিরগতিতে এগিয়েছেন কবিতায়। কিন্তু এভাবে এগুতো গিয়ে এদিক-ওদিক খেয়ালহীন ভাবে এড়িয়ে গেছেন। এতে করে কবিতা কখনো কখনো ঠিক কবিতা হয়ে উঠেনি। 'তিস্তা নদে যদি তোমাকে পেতাম' নামটি তিনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে যে রেখেছেন, কবিতা পড়ে তা আমার বোধগম্য হয়নি। 'সুন্দর নই' নামের লেখাটি আমার কাছে ঠিক কবিতা মনে হয়নি।
   একজনের লেখা পড়ে অবাক না হয়ে পারিনি—ডাঃ মোঃ খোরশেদ আলম মণ্ডল। ওনার কবি পরিচিতিতে উল্লেখ রয়েছে, 'ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি।' তাঁর লেখায় আমি এর যথেষ্ট প্রমাণ খুঁজে পাইনি। কবিতার প্রতি গভীর অনুরাগ হতে হয়তো ব্যস্ত পেশার ফাঁকে কবিতা লিখেন তিনি। কিন্তু আধুনিক কবিতার জগতে তাঁর লেখাগুলো কেবল অঙ্কুর হতে পারে কিংবা নিছক অকবিতা।
   জাকির আহমদ। একজন দক্ষ সংগঠক ও ভালো ছড়াকার। উত্তরের সাহিত্যমহলে বেশ সমাদৃত তিনি। ছড়া লেখার পাশাপাশি মাঝেমাঝে শখের বসে কবিতাও লিখে থাকেন এবং প্রাঞ্জল ভাষায় বেশ ভালো লিখেন। ভালো লিখেছেনও: 'আমার বাড়ি ফেরার রাস্তাটি এখন রাজপথ', 'বসন্ত আসুক মনুষ্যত্বে', 'মিথ্যেভোর'—কিছু ভালো কবিতা। যদিও 'আমার বাড়ি ফেরার রাস্তাটি এখন রাজপথ' কবিতাটিতে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ'র 'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি' কবিতাটির প্রভাব খেয়াল করেছি। বানান ও শব্দের কিছু ভুল প্রয়োগ: 'এবার বসন্ত আসুক মনুষ্যত্বে' কবিতায় বিদেশি শব্দে মূর্ধন্য(ণ) এর ব্যবহার—'বার্ণ ইউনিট'। 'এক পশলা বৃষ্টি ও তোমার সাক্ষাত' কবিতায় 'বৃষ্টির রিণিঝিনি শব্দের মতো' পঙক্তিতে 'রিণিঝিনি' শব্দ কেন্দ্রিক দু'টি ভুল—বানানগত ও প্রয়োগিক। শব্দটির শুদ্ধ বানান—রিনিঝিনি। শুদ্ধ প্রয়োগ—নূপুরের বা বাদ্যের ক্ষেত্রে রিনিঝিনি এবং বৃষ্টির ক্ষেত্রে হতো রিমিঝিমি। আর 'পদ্মার তীরে' লেখাটিকে আমি কবিতা বলতে নারাজ।
   ফিরোজ কাওসার মামুন। ভালোই লিখেন। এ গ্রন্থে তাঁর 'অচেনা নদী' লেখাটি মনে ধরার মতো, যদিও কারও মনে ধরা না ধরাতে কবির কিছু যায়-আসে না। কিন্তু কবিতা যেন ছড়া না হয়, এদিক থেকে কবিকে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়। যা তিনি হননি। 'তুমি ছাড়া' এবং 'আমার তুমি' লেখা দু'টি ছড়া বৈ কিছুই হয়নি। 'একটি করে যাচ্ছে দিন' লেখাটিও ছড়ার দিকেই গড়িয়েছে। 'নারী' কবিতাটিও ঠিক কবিতায় ফেলাতে পারেননি; কেমন যেন শ্লোগান সর্বস্ব মনে হয়েছে। এদিকে 'আড্ডাবাজী' কবিতায় ব্যবহৃত 'বাজী' শব্দটি ভুল প্রয়োগ। এই 'বাজী' শব্দের অর্থ--ঘোড়া; যা অবশ্যই এ কবিতায় 'বাজি' হবে।
   এম এ মাহমুদ মেঘ। তরুণ কবি। প্রথমেই চমক দিয়েছেন 'এপাশ ওপাশ' কবিতায়। চমৎকার একটি কবিতা—'ঠোঁটের কম্পন,/অগোছালো নাইটি আর ফিসফাস আওয়াজ/বুকের উপর কথা বলার যন্ত্রটা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া/এইতো ওপাশের রোজকার রেওয়াজ।' কিন্তু এই সুন্দর শুরুর কবিতাটির মতো পরের কবিতাগুলো নির্মাণ করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। একটি চিঠি অবশ্যই কবিতা হতে পারে শব্দ নৈপুন্যে; কিন্তু 'কল্পনা' কবিতায় তিনি সে দক্ষতা দেখাতে পারেননি। 'আমরা পাপী' এবং 'স্বপ্ন ছুটি' লেখা দু'টিকে তিনি ছড়ার দিকেই গড়িয়েছেন।
   এম. এ. শোয়েব দুলাল। এ গ্রন্থের কবিতার ভিত্তিতে তাঁর কবিতার হাত খুব ভালো লাগেনি। কবিতাকে উনি জোরপূর্বক লেখার একধরনের চেষ্টা চালিয়েছেন, যা অপচেষ্টায় পর্যবসিত হয়েছে। ফলাফলে কোনোটি খানিকটা ছড়া মতন কিছু হয়েছে, কোনোটি স্রেফ সংক্ষিপ্ত গল্প কিংবা নীতিকথার ফিরিস্তি হয়েছে। 'মোহাম্মদ রাসূলউল্লাহ (সা:)' এবং 'হারাগাছ তোমাদের দেশ' এ দু'টি লেখায় কবিতার কোনো উপাদান নেই।
   নাটকের মানুষ সরকার বাবলু। কবিতার প্রতিও হয়তো রয়েছে তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তাঁর পরিচয় পর্বে 'আকাঙ্ক্ষা' শব্দটির ভুল বানান ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর কবিতা বেশ ভালোই লেগেছে। যদিও অন্ত্যমিলের আধিক্যেতা দেখাতে গিয়ে কোথাও কোথাও স্বাভাবিক ভাব প্রকাশ ব্যাহত হয়েছে। এমনকি এভাবে এগুতে গিয়ে 'স্বপ্নের গাঁও' এবং 'আঁতেল' লেখা দু'টির কবিতা হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
   এস এম সাথী বেগম। রংপুর সাহিত্যাঙ্গনের খুব পরিচিত একজন মানুষ। প্রায় প্রতিটি কবিতা সুন্দর সৃষ্টি। তাঁর মাঝে একজন নিখাদ কবির উপস্থিতি উনার কবিতা প্রমাণ করে দেয়: 'অযথা কাব্য' কবিতার পঙক্তি—'দুর্গ ভেদ করে জটিল গণিত/সমাধান হলো কোন ক্যালকুলেটর বিহীন/আমাকে পড়েই, রইলো না কোনো/নিয়মের সূত্র।' তবে এই কবিতার দ্বিতীয় লাইনে ভুল প্রয়োগ 'পিপাসার্ত' শব্দটির শুদ্ধ 'পিপাসিত' হওয়ার কথা। এছাড়া 'ইচ্ছেগুলো নির্লজ্জ' কবিতায় 'সে আলোয় আমার ইচ্ছেগুলো নিঃস্প্রভ নির্লজ্জ' —এই সুন্দর পঙক্তিটিতে 'নিঃস্প্রভ' শব্দটি ভুল। শুদ্ধ বানান—নিষ্প্রভ।
   সানজিদা নাজনীন লুনা। তাঁর কবিতাকে হয়তো কবিতা বলা যেতে পারে। তবে প্রতিটি কবিতাই যখন 'তুমি'র বিরহ ও বিচ্ছেদ কেন্দ্রিক, তখন 'একঘেয়ে' শব্দটি মাথায় আসা স্বাভাবিক নয় কি? এছাড়া ভুল বানান এনার পিছুও ছাড়েনি: 'পৃথিবীর উল্টোপীঠে' কবিতায় 'পীঠ' শব্দটির অর্থ 'বেদি'। এই ভুল প্রয়োগটি কবিতার শেষ লাইনেও দেখেছি। এ কবিতায় শব্দটির শুদ্ধ বানান হবে—পিঠ। 'প্রশ্ন' কবিতার একটি লাইন—'ফুলসয্যার স্বপ্ন আর দেখি না।' এখানে 'ফুলসয্যা' শব্দটির বানান ভুল। এখানে বানানটির শুদ্ধরূপ হবে—ফুলশয্যা। আবার 'ফুলসজ্জা' বলেও আরেকটি শব্দ রয়েছে; তবে শব্দ দু'টির অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। 'শুভ্রতায় তুমি' কবিতায় একটি লাইনে দু'টি ভুল বানান দেখেছি—'জোনাকীদের আলোয় ছিল উজ্বল রাত।' এখানে 'জোনাকী' শব্দটি 'জোনাকি' এবং 'উজ্বল' শব্দটি 'উজ্জ্বল' হবে। প্রথম ভুল শব্দটি কবিতায় আরও একবার রয়েছে।
   সোহানুর রহমান শাহীন। এ গ্রন্থের সম্পাদনায় ছিলেন। কবি। এই কাব্যগ্রন্থের সেরা কবি বলবো আমি। প্রতিটি কবিতাই অসাধারণ: 'লাল পিঁপড়ের ক্ষত' কবিতায়, 'নিরর্থক ভাববাচ্য আর আমার কাতরতা/শহরে ক্ষতির কারণ হয় না, নিভে না সড়ক পিদিম।' 'ঘুম' কবিতায় লিখেছেন, 'দিবস-রজনী ভাবো কাম খেয়ালে, নিষিদ্ধ দেয়ালে/ফিরে ফিরে চাও, যা ছিল সঞ্চয় খোয়ালে সকালে।' তবে সম্পাদকের লেখাতেও বানান নির্ভুল হয়নি: 'পকেট প্ররোচনা' কবিতায়—'যদি ছুঁয়ে দাও বাসন্তিকা শাড়ির আঁচল' এবং 'ধ্বনিত হতে থাকে দৃশ্যান্তরে—আমি উর্দ্ধোমুখী হবো।' একই কবিতার দু'টি লাইনের দু'টি শব্দ ভুলের থাবায়। এখানে 'বাসন্তিকা' শব্দটি 'বাসন্তিক' হবে এবং 'উর্দ্ধোমুখী' শব্দটি 'ঊর্ধ্বমুখি' হবে। এছাড়া দশটির মাঝে দু'টি লেখা কবিতা না হয়ে ছড়া মনে হয়েছে—'ফাগুন রাঙা মন' এবং 'বৈরী বাতাস'।
   কবি এইচ এম হারুন। বেশ লিখেছেন তিন: 'কবিতার চিৎকার' কবিতায় লিখেছেন, 'জাগো কবি, জাগাও বিবেকের লাঙল,/চাষে নাও বুকের জমিন শুদ্ধ শব্দ ফলনে।' এদিকে ভুল বানানও চোখে পড়েছে: 'পথের শিশু' কবিতায়, 'তাদের হাতে হাতটি রেখে মিটাই তাদের দাবী'—এখানে 'দাবী' শব্দটি 'দাবি' হবে। 'দুঃখী আমি সুখি ফানুস' কবিতায় এখানে 'সুখি' শব্দটি 'সুখী' হবে। সুখ প্রাপ্ত বুঝালে 'সুখিত' শব্দটি ব্যবহার করা যেতো।
   কবিদের কবিতায় অজস্র ভুল বানানের পর সম্পাদকীয় পাতাতেও ভুল বানানের শব্দ দেখেছি। শেষ দিককার 'সজ্ঞায়িত' শব্দটি হবে—সংজ্ঞায়িত।

| |তিন| |

   এই যে কবিতার মোড়কে অন্তঃসারশূন্য কবিতা নির্মাণ, শব্দের ভুল প্রয়োগ, ভুল বানান প্রভৃতি সমস্যার মুখোমুখি আমরা। এটা তো শুধু 'দ্বিধাহীন একদিন' কাব্যগ্রন্থের ফসল নয়। স্থানীয় সম্পাদক ও সংগঠকদের প্রকাশনার ক্ষেত্রে অবহেলার ফসল। তাঁরা শুধু অবিরত প্রকাশ করেই যাচ্ছেন সাহিত্যের কাগজ। সম্পাদকীয় পাতা লিখেই দায়মুক্ত হচ্ছেন। আমি লেখা পাঠালাম, সম্পাদক তার কাগজে নির্দ্বিধায় ছেপে দিলেন। লেখাটি পরখ করার কথা একটিবার তাঁর কল্পনাপ্রসূত হলো না। কিছু লিখলেই তা সাহিত্যের কাগজের যোগ্য হতে পারে না। এটা কাগজের কলেবর বাড়াবে হয়তো; মান বাড়াবে না। এটা অবহেলা বৈ কী? প্রুফ বলে তো একটি শব্দ রয়েছে। উপযুক্ত প্রুফ রিডারের দ্বারা প্রুফশিট দেখিয়ে নেয়া কার দায়িত্ব?
   অবশেষে আমি বলবো, 'দ্বিধাহীন একদিন' কাব্যগ্রন্থটি একটি সুন্দর বই হিসেবে হয়তো বুকশেলফে খুব সহজেই স্থান করে নিবে। কিন্তু একটি সমৃদ্ধ কবিতার বই হিসেবে পাঠকমনে স্থান করে নেয়া অতটা সহজ হবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন