রবিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৬

শিল্পী নাজনীন -এর অনুগল্প

বিকার
অনেকক্ষন থেকে ফোনটা বাজছে । বেজেই চলেছে । শব্দ নেই । মৃগীরোগীর কাঁপন নিয়ে অদ্ভুতভাবে কাঁপছে । রুবা । কোন সন্দেহ নাই । মেয়েগুলো এতো বোকা কেন হয় কে জানে ! মুদৃ হাসে দিব্য । আপন মনে বিড়বিড় করে । বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে অন্ধকার ছাদের দিকে চেয়ে থাকে । হাতের সিগারেট ওঠানামা করে তার । কি চায় রুবা? কেন সে নিজের গোছানো সংসার ছেড়ে, নিশ্চিত ভবিষ্যত ছেড়ে তার মত অপগন্ড লম্পটের হাতে সঁপে দিতে চায় নিজেকে ? বোকা মেয়েটা ! বড্ড সরল । কেন যে বোঝে না দিব্যকে ! সাত বছর আগেও এমনি বেজেছিল ফোনটা । সেদিনও ফোন ধরেনি দিব্য । ইচ্ছে করেনি । অদ্ভুত এক আলস্য গ্রাস করেছিল তাকে । ঠিক আজকের মতই । সেদিন সে আজকের মত নিস্পৃহভাবে বিছানায় চিৎ ছিল না অবশ্য । বরং অদ্ভুত এক আনন্দ আর অসহ্য ভাললাগা নিয়ে আড়াল থেকে দেখেছিল রুবার জলে ভেসে যাওয়া মুখ, অসহায়তার আর্তি, স্বপ্নভঙ্গের কষ্টে মুচড়ে যাওয়া রুবার তুলতুলে শরীর । আহ্ । কি যে আনন্দ হয়েছিল সেদিন ! তীব্র সুখে ভেসে গিয়েছিল তার দুঃখবিলাসী মন । সাথে সাথে রুবার প্রতি অদ্ভুত এক মায়ায়, করুণায় বিগলিত হয়েছিল তার অন্তর ! আহা ! বোকা মেয়েটা ! ভালবেসে সুখ নাই, বোকা মেয়েটা জানে না তা । জানে না, ভালবাসায় নয় বরং তার জলে ভেজা চোখেই যত সুখ দিব্যর । যন্ত্রনায় ছটফট করা রুবাতেই আগ্রহ যত তার । কিন্তু জানে নাইই বা কেন ! দিব্যতো গোপন করেনি কিছুই ! বরং প্রথম পরিচয়েই সে বলেছিল, সে আসলে মেয়ে পটানো টাইপ ছেলে, তার প্রেমিকারও কোন গোনাগুনতি নাই ।
দশ বছর আগে এক বন্ধুর সাথে দিব্য গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ইডেনের গেটে । খুব অবাক হয়ে তাকিয়েছিল গনগনে দুপুরের রোদে পুড়তে থাকা কলেজটার ময়লাটে শরীরের দিকে । এখানেই পড়তেন তবে লাবণ্য গুপ্ত ! জীবনানন্দের লাবণ্য গুপ্ত ! এখানেই ! অবাক বিস্ময় মেনে চেয়েছিল সে । তার লাবণ্য গুপ্ত কোথায় কে জানে ! পোড়াতেই আনন্দ তার, পুড়তেও । কে জানে কখন, আনমনে সে আবৃত্তি করতে শুরু করেছিল জীবনানন্দের ‘সুদর্শনা’ । তার ভরাট কন্ঠ আবৃত্তি করতে থাকে-
'একদিন ম্লান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিন্নর কণ্ঠ দেবদারু গাছে,
দেখেছি অমৃতসূর্য আছে।'
‘আপনি তো খুব ভালো আবৃত্তি করেন !’- রিনরিনে কণ্ঠটায় সচকিত হয় দিব্য । অপ্রস্তুত ও কিছুটা । তবে সামলেও নেয় দ্রুত । তারপর কণ্ঠটাকে আরও একটু কাঁপিয়ে, আরও একটু অনর্থক ভারী করে সে বলে, ‘ধন্যবাদ’ । আড়চোখে তাকায় । ছিপছিপে শরীরে কবিতার ঢেউ, ছন্দের দোলা । হুম ! তার জহুরী চোখ রত্ন চিনে নেয় নিমেষেই । পোড়া আর পোড়ানো কোনটাতেই ক্লান্তি নেই তার । দুঃখের সাথে সহবাস না হলে জীবন কি আর জীবন থাকে গো ! ম্যাড়মেড়ে, ছাতাপড়া সুখে বড় আপত্তি তার ! তার চাই দুঃখ, চাই অসুখের সাথে নিরন্তর সঙ্গম । তবেই না জীবন । তবেই তো মনে হবে বেঁচে আছি ! রুবা নিজের আগ্রহেই যেচে পরিচিত হলো । দিব্য আবৃত্তি শিল্পী, থিয়েটার করে । রুবা পটলো সহজেই । না, দিব্য বাধা দেয়নি । তবে হ্যাঁ, নিজের কিছু গোপনও করেনি সে । তার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, মেয়েপটানো স্বভাব, এমনকি নিষিদ্ধ পল্লী ! তবু রুবাকে থামানো গেলো না ! সে কি পুড়তেই চায় তবে ? চেয়েছিল? কে জানে ! রহস্য অপার!  ইডেনের সামনে ঘন ঘন টহল অতঃপর । রুবার রান্নায় সকাল দুপুর রাত্রি পার । রুবার টাকায় স্ফুর্তিতে মেয়েপটানো আরো। আহা ! মেয়েগুলো এত বোকা ! কি আছে তার ! কেন তার জন্য কেঁদে ভাসায়, তাকে পাবার নেশায় উন্মাদ হয় এমন ! ভারী দুঃখ হয় তারও !
রুবাও কেঁদে ভাসাল । তার বিয়ে । পাত্র ডাক্তার । কানাডায় থাকে । বিচ্ছেদের ব্যথায় বুকটা টনটন করে দিব্যর । তবু, দুঃখটুকু তার চাই, চাই যন্ত্রনার দহন । কিন্তু রুবাটা বোঝেনা । ভারী অবুঝ সে । দিব্যকে তাই কথা দিতে হলো, পরদিন সকাল দশটায় কাজী অফিসে থাকবে সে । হুম ! পাগল আর কি ! সে ছিল বৈ কি ! তবে আড়ালে । দারুণ আনন্দে ভাসতে ভাসতে, অসহ্য যন্ত্রনায় পুড়তে পুড়তে সে দেখেছিল রুবার জলে ভেজা মুখ, তার অপেক্ষার প্রহর গোনা, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রনা নিয়ে অতঃপর চলে যাওয়া ।
কষ্ট, বড় কষ্ট । রুবাদের জন্য কষ্ট । নিজের জন্য কষ্ট । কষ্টই জীবন তবু । কষ্টই ঈশ্বর তার ! রুবা চলে গেল কানাডা । মন পোড়ে । বড্ড পোড়ে । আবার ফোন । আবার যোগাযোগ ! একমাস হলো দেশে ফিরেছে রুবা । আজ আবার সে সব গহনা আর জমানো টাকা নিয়ে অপেক্ষায় । প্রকৃতি বড় নির্দয় । ফোনটা সেই সেদিনের মতই কাঁপছে অসহ্য যাতনায় । ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে দিব্য । যেন সে তাকিয়ে আছে কোন কাঁকড়া কিংবা বিছের দিকে, অদ্ভুত কোন জন্তুর দিকে ! সিগারেট পুড়তে থাকে হাতে, পুড়তে থাকে সেও । ফোনটা কেঁপে কেঁপে থেমে যায় । রুবার কান্না কি থামে ? জানেনা দিব্য ।বুকের মধ্যে বন্য এক আনন্দ লাফায়, অসহ্য এক যন্ত্রনা দাপায় ! তার পোড়াতেই আনন্দ, পুড়তেও । আগুনই আরাধ্য তার, আগুনই নিয়তি !
________________

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন