শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫

শিল্পী নাজনীন -এর অনুগল্প

অপেক্ষা
অনেকক্ষণ শূন্য গ্লাসটার দিকে আনমনে চেয়ে থাকে সে । কি দেখে সে ? শূন্য গ্লাস নাকি সেখানে তখনও থেকে যাওয়া জলের দাগ ? না, কিছুই দেখে না সে । কিচ্ছু না । তার মনটাও এখন অমনি শূন্য কি ? ঐ জলের গ্লাসটার মত ? জলটুকু নিঃশেষে পান করে ফেলে রেখে গিয়েছে কেউ, নিদারুণ অবহেলা ভরে । নাহ্ । মানুষের মনটা কখনও শূন্য হয় না আসলে । এবং হয় না বলেই, নিজের মানবজন্মকে নিজেই সে এখন অভিসম্পাত দেয় মনে মনে । মনের মধ্যে ভাবনাগুলো  সামান্য বুদবুদ তুলে হারিয়ে যেতে থাকে, নতুন ভাবনা আবার উঁকি দেয় । আহ্ ! জ্বালিয়ে মারে ।
পাবলিক লাইব্রেরির এই রঙজ্বলা ক্যান্টিনে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে সে ? কাঁহাতক আর সহ্য করা যায় এই পানসে, বিস্বাদ চায়ের অত্যাচার ! না, আর নয় । সে ঠেলে সরিয়ে দেয় চায়ের কাপ, নান আর ডালের এঁটো আর বেজার, আধময়লা কাঁচের বাসন । এই নিয়ে মোট ছ’কাপ চা আর দু-দুটো নান সেই সাথে একবাটি হালিম সাবাড় করেছে সে । না, ভুল । নান আর হালিম অনেকটাই পড়ে আছে, শুধু বিস্বাদ চায়ের অত্যাচার এড়াতে পারে নি । অন্যমনে খেয়ে ফেলেছে কখন, বুঝতে পারে নি । না, পান করেছে । কাউন্টারে বিল মিটিয়ে সে নিভু নিভু পায়ে বের হয় অতঃপর । এই নিয়ে মোট পাঁচদিন হলো, আসবে বলে এলো না জিতু । জিতু কি অন্য কারও প্রেমে পড়ল তবে ? মন মজল অন্য কোথাও? আচ্ছা, প্রেমে পড়াটা কি সহজ এতটাই ? জলে ঝাঁপ দেয়ার মত ? হবে হয়তো । যারা সাঁতারে পটু তারাই হয়ত উৎরে যায় শেষমেষ, বাকিরা তার-ই মত হাবুডুবু খায়, অহেতুক পেট ভরে জলে এবং অবশ্যই ডুবে মরে ।
একটা সময় ছিল যখন তার সাথে এক মিনিট কথা বলার জন্য, একটিবার দেখা করার জন্য ছটফট করত জিতু, অস্থির করে তুলত তাকে । অথচ এখন ! উল্টে গিয়েছে পাশার দান । সাঁতারে দারুণ পটু সে এখন  । অথচ, সে ! দিপা ! না, তার ভালোবাসায় তো চির ধরে নি একটুও । জিতু তাকে চায় না আর, স্পষ্ট বলেছে সে কথা । তবু বোকা সে, দিপা চেয়েছিল শেষবার অন্তত দেখা হোক, জিতু তাকে বলুক শুধু, কেন এত অবজ্ঞা তাকে, কেন এত অপমান । হ্যাঁ, অনেক অনুরোধে রাজি হয়েছিল জিতু এবং বাকি চারবারের মত-ই, অনিবার্যভাবেই, আজও আসেনি সে, ফোনটাও বন্ধ করে দিয়েছে, নির্দিষ্ট সময় পরে, অন্যান্য বারের মতই ।
বুকের ভেতরটা কেমন ভার হয়ে আসে তার । পৃথিবীটা খুব ফাঁকা হয়ে যায় যেন । চারপাশের এত শোরগোল, কোলাহল কিছুই আর স্পর্শ করে না তাকে । সে স্খলিত, মৃদুপায়ে হাঁটে, রাস্তা পার হয়, বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের সামনে এসে দাঁড়ায়, বাসের অপেক্ষা করে । যেন সে মানুষ নয় কোন, একটি যন্ত্র মাত্র । স্রেফ তাকে যেতে হবে তাই যাওয়া, ফিরতে হবে, তাই ফেরা । অকারণ, অর্থহীনভাবে সে যেন ক্রীড়নকের মত চলতে থাকে শুধু ।
নেমে আসা সন্ধ্যার ম্রিয়মান আলো হঠাৎই নিভে আসে যেন । আকাশ কালো হয়ে আসে সহসা । খুব শীতল, ঠান্ডা বাতাস বয়, চোখের মধ্যে উড়ে আসে একরাশ ধুলো । ধুলো মুছতে চোখ রগরায় দিপা, আকাশের দিকে তাকায় ।
আহ্ ! আকাশে এত আনন্দ ছড়ালো কে হঠাৎ ! কে আঁকল এত অসামান্য দৃশ্যপট! পুরো আকাশ ছেয়েছে কালো মেঘের চাদরে, তার নিচে উড়ছে ঝাঁকঝাঁক পাখির দঙ্গল । ঢাকা শহরে এত পাখিও কি ছিল কোনো দিন ? আছে ? আচ্ছা, ওগুলো কি কাক ? আহা! কাকও এত সুন্দর হয় তবে ! পাখিতে যেন ছেয়ে গেলো পুরো আকাশ, তারা উড়ছে তো উড়ছেই ! বিরাম নেই আর । বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ, আকাশের এই ঘনায়মান অন্ধকারের অসামান্য দৃশ্যপট আর হাজারো পাখির ডানা মেলে ওড়ার এই ছন্দ দিপাকে অনেক বছর পেছনে ফিরিয়ে নেয় সহসা। কিংবা অন্য আর এক জীবনে সে ফিরে যায় হঠাৎ । দিপার সামনে থেকে মুছে যায় ঢাকা শহর, নিভে যায় তার সব আলো, দূরে মিলিয়ে যায় কোলাহল, যানজট । সেখানে ভেসে ওঠে অন্য এক দৃশ্যপট, অন্য এক জীবন । দিপা সহসা আবিষ্কার করে সে ফিরে গিয়েছে তার সেই শৈশবে, দারুণ ঝড় উঠেছে হঠাৎ, দমকা বাতাস আর বৃষ্টির তোড়ে সে জবুথবু হয়ে নিজের ভিজে যাওয়া ফ্রকটাই উল্টিয়ে নিয়ে নিজেদের রান্নাঘরের পেছনের আমগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে শীতে আর ভয়ে কাঁপছে ঠকঠক ! মাঝে মাঝে, ঝড়ের তোড়ে আম পড়ছে ঝুপ করে । সব ভয়, সব উৎকন্ঠা ভুলে সে দৌড়ে গিয়ে আবছা আঁধার হাতড়ে তা রাখছে ভাঙ্গা ঝুড়ির কোনে । গরুটা ভয়ে হাম্বা রবে কাঁদছে ভীষন, রান্নাঘরে মা চিৎকার করে ডাকছে তাকে দিপা, দিপা, তাড়াতাড়ি ঘরে আয় বলে । কিন্তু সে ঝড়ের প্রকোপ, বৃষ্টির ছুঁড়ে দেওয়া শীত আর ঘনায়মান সন্ধ্যার সেই অসামান্যতায় বিস্ময়ে আর ভয়ে বোবা হয়ে সেই আমগাছটার নিচেই দাঁড়িয়ে থাকে ছবির মত, বিভূতিবাবুর দূর্গার মত !
বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় চমকে ওঠে সে । কোথায় কি ? সে দাঁড়িয়ে আছে শাহবাগের মোড়ে, ঢাকার রাস্তায় তেমনি যানজট, কোলাহল, ধোঁওয়া । আজান হচ্ছে । মাগরেবের সময় হলো । কমে এসেছে দমকা বাতাসের তোড় । বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে । সে ভিজছে । গাড়িটা আসেনি এখনও । সে অপেক্ষা করে । জিতুর দেওয়া টুকরো আঁধার আর ছায় না মন । কোন এক হীরন্ময় আলোয় ডুবে যায় সে, ভিজে যায় তার পিপাসার্ত মন, যা জিতুরা কখন ও ভেজাতে পারে না । দিপা অপেক্ষা করে, বাসের, নতুন দিনের।
_________________________

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন