বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শাশ্বত জীবনবোধ এবং অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনার অহঙ্কার-বাংলার সমন্বয়ধর্মী ঐতিহ্য, বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, নিরবধিকাল অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় ‘ধন্য সেই পুরুষ’। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গাঁথা। তাঁর দূরস্পর্শী স্বপ্ন এবং নিরন্তর লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় একটি অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র গঠিত হয়েছে।
রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি প্রলুব্ধ ব্যক্তিবর্গের সাম্প্রদায়িক বিভাজন রেখায় ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয়। পরিণতিতে বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বাংলার মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ে গোত্র, ধর্ম, ভাষা ও অঞ্চল হিসেবে। প্রবল অনুভূতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু অমানবিক ঘটনায় বিচলিত হয়ে ওঠেন। বিভাজিত দেশে তিনিই প্রথম মানুষে মানুষে অবিভাজিত সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গঠিত হয়েছিল ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন—
‘‘আমি বললাম এর একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোন দাঙ্গাহাঙ্গামা না হয়। হিন্দুরা দেশ ত্যাগ না করে— যাকে ইংরেজিতে বলে ‘কমিউনাল হারমনি’, তার জন্য চেষ্টা করা।” [পৃষ্ঠা ৮৫]
মহাত্মা গান্ধি অহিংস আন্দোলনের জনক হলেও হিংসা ঠেকাতে পারেনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন ধর্মীয় ভেদের উর্ধ্বে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তিনি সবাইকে এক করে দেখতেন। সাম্প্রদায়িকতা তিনি প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করতেন। তাইতো পল্লিকবি গভীর শ্রদ্ধায় লিখেছেন—
“আমরা গান্ধীর বাণী জীবন করিয়া দান,
মিলাতে পারেনি প্রেম-বন্ধনে হিন্দু-মুসলমান।
তারা যা পারেনি তুমি তা করেছ, ধর্মে-ধর্মে আর,
জাতিতে-জাতিতে ভুলিয়াছ ভেদ সন্তান বাংলার।”
শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রমিথিউজ। গ্রিক মিথোলোজিতে প্রমিথিউজ একজন টাইটান। দেবরাজ জিউস তাঁর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন। কিন্তু প্রমিথিউজ ছিলেন মানব প্রেমিক। তিনি জানতে পারলেন জিউস মানব জাতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি গোটা মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য কাজ শুরু করলেন। মানুষকে হাঁটতে শেখালেন এবং মানুষের জন্য স্বর্গ থেকে আগুন নিয়ে এসে এর ব্যবহার শিখিয়ে দিলেন। প্রমিথিউজের মত শেখ মুজিবুর রহমান কাজ করেছেন গণমানুষের মুক্তির জন্য, শোষণ আর অত্যাচার-নিপীড়নের শৃঙ্খল ভাঙ্গার জন্য, আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন জনগণকে রাষ্ট্রীয় ঐক্যে আবদ্ধ করবার জন্য। কিন্তু তিনি মিথ নন, বাস্তব জগতের বাস্তব এক মহাকাব্যিক মানব।
বঙ্গবন্ধু হিন্দু-মুসলমানে বিভেদ করতেন না। প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করতেই কাজ করেছেন। সকলের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল এমন অসংখ্য উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। ১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা এবং সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে আসবেন। এই কারণে সভার প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে আরম্ভ করে। কারণ কংগ্রেস নিষেধ করেছে। এমনকি সভা পণ্ড করার নির্দেশনাও ছিল। এই ঘটনায় বঙ্গবন্ধু আশ্চর্য হয়ে যান। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন—
“আমি এ খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার কাছে তখন হিন্দু মুসলমান বলে কোন কিছু ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গানবাজনা, খেলাধুলা, বেড়ান-সবই চলত।” [পৃষ্ঠা ১১]
কংগ্রেস যেখানে হিন্দু মুসলমানকে বিভাজিত করে রাজনীতি করেছে বঙ্গবন্ধু সেখানে হিন্দু মুসলমান উভয়ের মাঝে সেতু বন্ধক হিসেবে কাজ করেছেন। উভয়ের মাঝে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপনে কাজ করেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করেছেন আজীবন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়—
“এই সময় একটা ঘটনা হয়ে গেল। হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে আড়াআড়ি চলছিল। গোপালগঞ্জ শহরের আশেপাশেও হিন্দু গ্রাম ছিল। দু’একজন মুসলমানের উপর অত্যাচারও হল।” [পৃষ্ঠা ১১]
কংগ্রেসের মুসলিম বিরোধী অবস্থান এই সকল অপ্রীতিকর ঘটনার মূল কারণ। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্বেষের রাজনীতি গ্রহণ করেননি। তাঁদের উদ্ধারের জন্য ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁকে জেলও খাটতে হয়েছে। তাঁর প্রথম জেল হয় উক্ত ঘটনার নিষ্পত্তি করবার কাজে ভূমিকা গ্রহণের জন্য। অথচ এ নিয়ে তাঁর কোন খেদোক্তি নেই। জেল খাটার বর্ণনা একেবারে হালকা মেজাজে লেখা—
“এ আমার জীবনে প্রথম জেল।” [পৃষ্ঠা ১২]
সাম্প্রদায়িক কদর্যতা তিনি অবলোকন করেছেন খুব কাছ থেকে—
“একদিনের ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে বেড়াতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকীমাও আমাকে খুব ভালবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদো কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম, ‘ননী কি হয়েছে?’ ননী আমাকে বলল, ‘তুই আর আমাদের যাস না। কারণ, তুই চলে আসার পরে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে। তোকে ঘরে আনার জন্য সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ধুতে বাধ্য করেছে।’ আমি বললাম, ‘যাব না, তুই আসিস’। আরও অনেক হিন্দু ছেলেদের বাড়িতে গিয়েছি, কিন্তু আমার সহপাঠীরা আমাকে কোনদিন একথা বলে নাই। অনেকের মা ও বাবা আমাকে আদরও করেছেন। এই ধরনের ব্যবহারের জন্য জাতক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে বাঙালি মুসলমান যুবকদের ও ছাত্রদের মধ্যে।” [পৃষ্ঠা ২৩]
শেখ মুজিবের শৈশব স্মৃতি হয়তো ভবিষ্যতের পাথেয় ছিল। তাই তিনি মননে ও চিন্তায় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং তাঁর নেতৃত্বে যে জাতির জন্ম হয়েছিল সেই জাতিকেও তিনি পরিচালিত করেছেন অসাম্প্রদায়িক হতে। বাংলার ইতিহাস তাই অসাম্প্রদায়িক ইতিহাস। কারণ সাম্প্রদায়িক কালিমায় ভারতের বিভাগের মত বাংলার স্বাধীনতা আসেনি। এবং এর পুরো কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।
শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তিত্বের স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্যুতিতে মহিমান্বিত হয়েছে পুরো বাংলা জনপদ। তাঁর গণহিতৈষী চেতনা চিরজাগরুক। তিনি ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে ক্ষমতা আরোহন করতে চাননি, দ্বিজাতি তত্ত্বের মত বিদ্বেষপূর্ণ কোন তত্ত্বের আবিষ্কার করে ক্ষমতার মসনদ দখল করেননি। বরং বন্দুকের নলের সামনেও নতজানু না হয়ে বাংলাকে ভালোবাসার কথা উচ্চারণ করেছেন। আবুল মনসুর আহমদ তাঁর রচিত ‘শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’ বইয়ে কায়েদে আযমের একটি বক্তৃতা উল্লেখ করেছেন। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বক্তৃতায় কায়েদে আযম বলেছেন—
“যে অবস্থায় দেশ ভাগ হইয়াছে, তাতে উভয় রাষ্ট্রের মাইনরিটি এড়াইবার উপায় ছিল না। সমাধানের অন্য কোনও পথ ছিল না।” [পৃষ্ঠা ২৭৩]
কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সমস্যা থেকে পালিয়ে বাঁচার মত নেতা ছিলেন না। তিনি প্রতিকূলতাকে প্রতিরোধ করে সমস্ত অশুভ শক্তিকে ঠেকিয়েছেন বারবার। তিনি তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে বাংলা ভাষা ও কৃষ্টিকে সমায়ত করে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন এবং জনগণের মধ্যে এক অটুট মেলবন্ধনের স্বপ্ন এঁকেছিলেন। তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানেরও ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত হওয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রসঙ্গে তিনি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন—
“সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেয়া হল, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা ‘নিরাপত্তা বন্দি’। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, এখনও সময় আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন।” [পৃষ্ঠা ১২০-১২১]
সেদিন সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত থাকলে হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হতো। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলে অসাম্প্রদায়িক জাতির স্বপ্নদ্রষ্ট্রা শেখ মুজিবুর রহমান দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার আলোচনা শুরু করেন। অবশেষে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ যায়। নতুন নাম দেয়া হয়- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বেলিত দলটির নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। পরবর্তীতে দলের নাম হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইলের আত্মপরিচয়ের পুনঃঅনুসন্ধান করলে উঠে আসে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। শেখ মুজিবুর রহমান দুষ্টক্ষতরুপে আর্বিভূত সাম্প্রদায়িকতা মেনে নেননি। দেশ স্বাধীন হবার পরও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে তিনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। পাক-শোষকরা রবীন্দ্র সংগীত বন্ধ ঘোষণা করলেও তিনি সেই চর্চা অব্যাহত রাখেননি। স্বাধীন দেশে তিনি জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের গান। দেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দেশে নিয়ে এসেছিলেন। কবি ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার ঘোর বিরোধী। কবির প্রতি তাঁর অনুরাগ উক্ত মতাদর্শের অনুপম উদাহরণ।
মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে দেশ ছিল উত্তাল, সারা দেশে উত্তেজনা ছিল দোদুল্যমান। বাঙালি জাতীয়তাবাদে জনতা ছিল বিপ্লবী মেজাজে। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতেও তিনি উত্তেজনা প্রশমিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি শুধু বাঙালি না অবাঙালিদেরও রক্ষা করেছেন। ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় : একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য’ বইয়ে দেশের বিশিষ্ট চিন্তক রেহমান সোবহান একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন—
“...একটি ঘটনায় রাজ্জাকস নামক স্থানীয় একটি শার্টের দোকান লুট হলে আওয়ামী লীগের নগরপ্রধান স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে সেখানে ছুটে যান এবং মালামাল সহ কয়েকজন লুটেরাকে ধরে ফেলেন এবং তাঁদের লুট করা দ্রব্যাদি ফেরত দিতে বাধ্য করেন; ...নওয়াবপুরেও স্থানীয় গুণ্ডারা এ ধরনের লুটপাট চালায়। ওখানে কয়েকটা সাম্প্রদায়িক (বাঙালি-বিহারি) সংঘর্ষও হয়।” [পৃষ্ঠা ৭৯]
শেখ মুজিবুর রহমান উত্তেজনায় উত্তাপ প্রদান করে সুযোগ লুটে নিতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন সম্প্রীতি, এজন্য সদা সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। ১৯৭১ সালের মার্চে যখন জনরোষ বাড়ছিল তখনও তিনি ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বক্তব্য প্রদান করেছেন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে দেয়া ভাষণ বিশ্লেষণ করে রেহমান সোবহান লিখেছেন—
“পূর্ববর্তী বক্তারা যেসব দাবিদাওয়ার কথা বলেছেন, সেসবের ধারেকাছেও গেলেন না তিনি। ...লুটেরাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি নিজে সকল মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। এই অঙ্গীকারের উদ্দেশ্য ছিল আতঙ্কগ্রস্থ অবাঙালি লোকজনের মনে আস্থার ভাব ফিরিয়ে আনা, কেননা ওরা ধরেই নিয়েছিল, আন্দোলনটা ক্রমশ সম্প্রদায়গত অর্থাৎ বাঙালি-বিহারি বিদ্বেষে রুপ নিচ্ছে।” [বাংলাদেশের অভ্যুদয় : একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, পৃষ্ঠা ৭৯]
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদে সবাইকে উজ্জীবিত করলেও অন্ধ জাতীয়তাবাদ অনুসরণ করেননি। এর প্রমাণ অবাঙালিদেরর রক্ষা করবার প্রচেষ্টা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মেটাতে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক ছুটে গেছে। আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ অবদানে শুধু মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিতই হয়নি, দলের কান্ডারি শেখ মুজিবের নিবিড় তত্ত্বাবধানে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধন অটুটও তৈরি হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তায় খুঁজে পাওয়া যায় বুদ্ধিজীবী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র জাতিসত্তার স্বরুপ। এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন—
“আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা।” [পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন, কার্জন হল, ঢাকায় ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮, সভাপতির ভাষণ]
এই বক্তব্যেরই পরিমার্জিত রূপ তিনি উপস্থাপন করেছেন তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণে—
“আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা।” [১০ জানুয়ারি ১৯৭২, রেসকোর্স ময়দান]
বঙ্গবন্ধু ভারত বিভাগের পর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে যুগের পর যুগ গৃহ যুদ্ধ বিরাজমান থাকতে পারত। হুতু ও তুতসিদের মত জাতিগত সংঘাতে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারত বাংলা। কিন্তু মুজিব ছিলেন বলেই সেটি হয়নি। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় বাঙালি জাতি তাঁদের নৃতাত্ত্বিক আবেগে এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল। সম্মোহিত নেতৃত্বের গুণে সবাইকে শুধু একিভূতই করেননি, তিনি নিজেও দেশের সকল মানুষের সঙ্গে আবেগগতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি সকলের আবেগ ধারণ করতেন। ১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে তিনি যে বক্তৃতা দেন সেখানেও এই আবেগের প্রতিফলন ছিল—
“স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী যুদ্ধ করিয়াছেন,তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়ে বাঁচার জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলেন।”
একজন নেতা কেবল জনবান্ধব, দেশদরদী হলেই প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে পারেন। পাকিস্তান গঠিত হবার পর দীর্ঘ সময় পার করলেও জিন্নাহ পাকিস্তানকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা দূরে কথা, মুখেও সে কথা উচ্চারণ করেননি। অথচ প্রজ্ঞাবান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হবার পরপরই সাংবিধানিকভাবে দেশকে গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা সংযোজন করে অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠন করেছেন। তাঁর নেতৃত্ব ছিল ঐন্দ্রজালিক। সম্মোহিত করবার মত। ডেভিড ফ্রস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালবাসি।’ ফ্রস্ট পুনরায় প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আর আপনার দুর্বলতা?’ উত্তরে তিনি চমৎকারভাবে জানিয়েছেন, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালবাসি।’ তিনি সমগ্র জাতিকে হৃদয়ে ধারণ করতেন। তাঁর হৃদয়টি বিশালাকার। এই বিশাল মহামানবকে দেখেই কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো মন্তব্য করেছেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ তিনি প্রকৃত অর্থেই হিমালয় উচ্চতার নেতা ছিলেন। আদিগন্ত বিস্তৃত পর্বতের মত ভালবাসায় তিনি বাঙালি জাতিকে তাঁর সত্তায় মিশিয়ে নিয়েছিলেন।
বাংলার লোকজ প্রত্যেকটি উপাদান, প্রত্যেকটি ধূলিকণা মুজিবময়। কারণ মুজিব সবার। তিনি একক কোন দলের নন। তিনি পুরো জাতিকে এক সূতোয় বাধতে চেয়েছেন। ১৯ জুন ১৯৭৫ সালে বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকের ভাষণে তিনি বলেছেন—
“এভরি পার্টি ওয়ার্কার অব মাইন ইজ মাই ব্রাদার, ইজ লাইক মাই সান। আই ক্রিয়েটেড এ ফ্যামিলি হোয়েন আই অরগানাইজড আওয়ামী লীগ।”
তাঁর বক্তব্যে এটি আলোকিত সত্য যে, তিনি সমগ্র বাংলা জনপদকে গভীর মমতায় উপলব্ধি করেছেন। একটি পরিবার যেমন সুখী হয় তেমনি দেশকে সুখী করতে চেয়েছেন। বাড়ির কর্তা যেমন পরিবার সুরক্ষার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয় তেমনি তিনিও দেশ সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করতে তিনি সর্বতোভাবে অজস্র দুর্লঙ্ঘ্য বাধা অতিক্রম করেছেন। তিনি সুদূরপ্রসারী জ্ঞানচিন্তায় তাঁর স্বপ্নের জাতিরাষ্ট্রের ছবি এঁকেছিলেন। সেই আহ্বানও তিনি সবাইকে করেছিলেন। একুশের এক অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আলোচনা সভায় সেই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। কবীর চৌধুরী সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু জননায়ক থেকে রাষ্ট্র নায়ক’ বইয়ের একটি প্রবন্ধে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন সেই কথা জানিয়ে লিখেছেন—
“তিনি মাত্র দু’টো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। একটি স্বাধীনতার বছরের সময় একুশের অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক শক্তির পরিচয়টিকে বিশ্লেষণ করেছিলেন জনজীবনের রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে এক করে। লেখকদের সেই জীবনের রুপকার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।” [পৃষ্ঠা ৪৮১]
শেখ মুজিবুর রহমান মূলত সাংস্কৃতিক সেতু বন্ধন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক ঐক্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন ঐক্যের ভিত গড়তে হলে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজতে হবে। সেই বৈশিষ্ট্য নিহিত থাকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। বাংলার প্রাণ প্রকৃতিও তাঁর চিন্তায় উৎসারিত ছিল। লোকসংস্কৃতিকে তিনি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ধরে পূর্ব পাকিস্তানের নাম করণ করেছিলেন বাংলাদেশ। ২৫শে জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশর জাতীয় সংসদে ভাষণ প্রদানকালে তিনি বলেছেন—
“সাম্প্রদায়িকতার বীজ বাংলার মাটিতে কোনদিন আসতে পারবে না, আমরা তা হতে দেব না। বাংলাদেশকে ভালবাসবো না, বাংলার কালচারকে ভালবাসবো না- এ আমরা চলতে দেব না। ...কেউ, এ নামে বাংলাদেশকে ডাকে, কেউ অন্য নামে, কেউ ও নামে। বাংলাদেশের নাম পর্যন্ত বলতে তারা লজ্জা বোধ করে। তাদের অধিকার নাই বাংলার মাটিতে থাকার।”
শেখ মুজিবুর রহমানের এই বক্তব্যে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিতাড়িত করবার কথা প্রতিধ্বনিময়। তাঁর বক্তব্যই বাঙ্ময় মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের কবিতায়—
“যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।”
শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের ঐক্যকে দৃঢ়তর করে তাঁদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন এবং জীবনযাত্রার প্রয়োজনে মহত্তর জীবনের অভিমুখে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন পুরো দেশকে।
বাংলার আজন্ম দুঃখ বিশ্বাসঘাতক নরপশু হত্যা করেছে জাতির পিতাকে যিনি বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তাকে সারা বিশ্বে সম্মানের সাথে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁকে হত্যার পর সংবিধানের ধর্ম নিরপেক্ষতা বিলুপ্ত করেছে প্রতিক্রিয়শীল গোষ্ঠী। ধর্মান্ধতা তাই পুনরায় জেঁকে বসেছে। মৌলবাদের উত্থানে সাম্প্রদায়িকতা রহিত জাতীয়তাবাদ এখন প্রশ্নের মুখে। চ্যালেঞ্জের মুখে অসাম্প্রদায়িকতা। আমরা আজ দ্বিধাবিভক্ত জাতি, বিদ্বিষ্টভাবে বিভক্ত। আশার কথা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এখনো জীবিত আছে। তাঁর আদর্শের রাষ্ট্রের জনগণ কখনও সাম্প্রদায়িকতা মেনে নেয়নি, অদূর ভবিষ্যতেও মানতে চাইবে না। হাসান আজিজুল হক সম্পাদিত ‘বঙ্গ বাংলা বাংলাদেশ’ গ্রন্থের একটি প্রবন্ধে রতন খাসনবিশ বলেছেন—
“এ চ্যালেঞ্জ কিছু পরিমাণে আছে বাংলাদেশেও। গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোকে আঁকড়ে ধরে বাংলাদেশ সম্ভবত এ সমস্যা কাটিয়ে তুলবে অদূর ভবিষ্যতে।” [পৃষ্ঠা ২৯৮]
শেখ মুজিবুর রহমানের কল্যাণকামী জাতিরাষ্ট্রে সাময়িক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বিলুপ্ত হবে—এ কথা বাহুল্য নয়। এই অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠনে তাঁর অবদান অস্বীকার করা মানে নিজেদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। সকলের প্রত্যাশা এই তাঁর স্বপ্নকে অনুসরণ করেই বাংলাদেশ সুশাসিত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের নায়ক মহামানবের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
● লেখক : রক্তিম মিলন, রংপুর।
● লেখক : রক্তিম মিলন, রংপুর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন