আকালের ভাত
শীতকাল। শীতের ভাবগতিক ভালো না। শীত পড়েছে প্রচণ্ড। হাড় কাঁপানো শীত। শীতে মনে হচ্ছে হাড়ের ভেতরের মজ্জা জমে যাচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন। তিনি সকলের কাছে শেখ মুজিব নামে পরিচিত। তিনি সকলের আপনজন। কেউ কেউ তাঁকে মুজিব ভাই বলে ডাকে।
শেখ মুজিবের গায়ে কোট। তিনি দুই হাত দিয়ে বুকের কাছে কোট জাপটে ধরে রেখেছেন। শীত যাচ্ছে না। শেখ মুজিব সামনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হাঁটছেন। জোরে হাঁটলে শরীর গরম হবে। তাতে আরাম পাবেন। কলকাতা শহর। পরিচিত রাস্তা। তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়েন। আর খানিকটা এগুলেই বেকার হোস্টেল। সেখানে তিনি থাকেন।
রাত আটটা মতো বাজে। চারদিকে সুনসান অবস্থা। শীতের জন্য আগেভাগে মানুষজন রাস্তার পাশের দোকানগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। শেখ মুজিব বড়ো রাস্তা ছাড়িয়ে গলির ভেতর ঢুকেছেন। রাস্তার দুপাশে সারিসারি বাড়ি। বাড়িগুলোর দরজা-জানালা বন্ধ। শীতের সামান্য বাতাসও যেন ঘরে ঢুকতে না পারে তার ব্যবস্থা।
জোরে জোরে হাঁটতে হাঁটতে আচমকা থমকে দাঁড়ালেন শেখ মুজিব। রাস্তার পাশ থেকে আওয়াজ আসছে। খুব ক্ষীণ সেই আওয়াজ। তিনি শুনলেন কেউ একজন কাতর গলায় বলছে, মা বাঁচাও। কিছু খেতে দাও। মরে তো গেলাম। আর পারি না। একটু ফেন দাও।
১৯৪৩ সাল। দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। আকাল লেগে গেছে দেশে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে। এমন দিন নেই যেদিন রাস্তায় মানুষ মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। কাজ আর খাবারের আশায় গ্রাম থেকে মানুষ ছুটে আসছে শহরে। সন্তানসন্ততি নিয়ে আসছে। কোথাও খাবার নেই। মানুষের পরনে কাপড় নেই।
ইংরেজরা দেশ শাসন করছে। তারা বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ইংরেজরা যুদ্ধের জন্য সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করেছে। নিজ সৈন্যদের খাওয়ানোর জন্য ধান, চাল গুদামে আটকে রেখেছে। না খেয়ে থাকা মানুষের খাওয়ার জন্য চাল, আটা, গম আনার জন্য বজরা পাওয়া যাচ্ছে না। খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। ওদিকে ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মণের চালের দাম বাড়িয়ে চল্লিশ টাকা মণ করে দিয়েছে। চারদিকে বড়ো অরাজক অবস্থা। ইংরেজরা বলেছে, বাংলার মানুষ যদি মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। যুদ্ধের সরঞ্জাম আগে পৌঁছাবে। ট্রেনে অস্ত্র যাবে, তারপর যদি জায়গা থাকে তবে রিলিফের খাবার যাবে।
ইংরেজদের কথা ভালো লাগেনি শেখ মুজিবের। রাস্তার পাশে মানুষ আর কুকুর একসঙ্গে ডাস্টবিনে খাবার খোঁজে। খাবার পেলে মানুষ আর কুকুর কাড়াকাড়ি করে সেই খাবার খায়। খেতে দিতে না পেরে সন্তানকে রাস্তায় ফেলে বাবা মা কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে। এমন ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়েকে বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করে। কেউ কিনতে রাজি হয় না।
শেখ মুজিবের কষ্ট হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী হয়েছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁকে ভালো চেনেন। শেখ মুজিব তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক এসেছেন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল পরিদর্শনে। সঙ্গে এসেছেন খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র। স্কুল পরিদর্শন শেষ হয়েছে। শেরে বাংলা ফজলুল হক আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁরা ডাকবাংলোতে ফিরে যাবেন। হেঁটে যাওয়ার পথ অত্যন্ত সরু। ধীর পায়ে হাঁটতে হচ্ছে। তাঁদের সামনে এসডিও কাজী গোলাম আহাদ। অল্প কিছুদিন হলো তিনি প্রমোশন পেয়ে এসডিও হয়েছেন। নিজের কাজের পারদর্শিতা দেখাতে তৎপর হয়ে আছেন। তিনি অত্যন্ত তটস্থ হয়ে আছেন কখন তার কোন কাজে ভুল বের হয়ে পড়ে। তবে এখন পর্যন্ত তার কাজে কোনো ভুল ধরা পড়েনি। সবকিছু বেশ ভালোভাবে সমাধা হয়েছে।
এসডিও কাজী গোলাম আহাদ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তার মনে হচ্ছে পিঠ দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোতের মতো কিছু নেমে যাচ্ছে। তিনি হতভম্ব চোখে সামনে তাকিয়ে আছেন। কয়েকজন ছাত্র পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখমুখ রুক্ষ দেখাচ্ছে। সবার চোখে কেমন অদ্ভুত প্রতিবাদ আর ক্রোধের ভাব। এসডিও সাহেব রেগে গেলেন। তার মাথা দিয়ে মনে হচ্ছে আগুন বের হচ্ছে। তিনি প্রধান শিক্ষক গিরিশ বাবুকে কাছে ডাকলেন। দাঁতে দাঁত ঘসে বললেন, কী হচ্ছে এসব? তাড়াতাড়ি ছেলেদের রাস্তা থেকে সরান। পথ ক্লিয়ার করুন।
গিরিশ বাবু থতমত খেয়ে গেছেন। তার ভেতর ভ্যাবাচেকা খাওয়া ভাব চলে এসেছে। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। ছেলেদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শেখ মুজিব। তিনি তাকে চেনেন। কোনো কিছুতে হার মানে না। অসম্ভব দুরন্ত ও ডানপিটে। এরভেতর কয়েক ঘন্টা জেল হাজতে থেকে এসেছে। গিরিশ বাবু আমতা আমতা করে বললেন, আচ্ছা-আচ্ছা আমি দেখছি।
গিরিশ বাবু ছেলেদের দিকে ছুটে গেলেন। কাতর গলায় বললেন, বাবারা পথ ছড়ো। প্রধানমন্ত্রী বিশ্রামে যাবেন। তিনি স্কুল পরিদর্শন হেতু পরিশ্রান্ত হয়েছেন।
ছেলেরা পথ ছাড়ল না।
শেখ মুজিবের চোখে ভারী গ্লাসের চশমা। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় তার চোখে গ্লুকোমা রোগ হয়। ডাক্তার চিকিৎসা করে চশমা দিয়েছেন। চশমার কাচের ভেতর দিয়ে তার চোখ দেখাচ্ছে স্থির। যেন পলক পড়ছে না।
প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক এগিয়ে এসেছেন। পরনে আচকান। মাথায় লাল ফেজ টুপি। বিশালদেহী সেই মানুষকে আরও বিশাল দেখাচ্ছে। তাঁর পেছনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আড়াল হয়ে গেছেন।
ছাত্রদের সামনে এসে শেরে বাংলা ফজলুল হক বললেন, তোমরা কী চাও? পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
গিরিশ বাবু আচমকা অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন। অনুমান করতে পারছেন না শেখ মুজিব কী বলবে। তিনি শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছেন। এসডিও কাজী গোলাম আহাদ দরদর করে ঘামছেন। তার কপালে বিনবিনে ঘাম। ঘাড়ের কাছে ব্যথা শুরু হয়েছে।
শেখ মুজিব এক পা সামনে এগিয়ে এলো। তার এগিয়ে আসার ভঙ্গি দৃঢ় ও অকুতোভয়। স্পষ্ট গলায় বলল, আমাদের হোস্টেলের ছাদ দিয়ে বর্ষাকালে পানি পড়ে। এতে ছাত্রদের বিছানাপত্র আর বইপুস্তক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই ছাদ মেরামতের ব্যবস্থা না করলে আমরা রাস্তা ছাড়ব না।
এসডিও সাহেব চট করে প্রধান শিক্ষক গিরিশ বাবুর দিকে তাকালেন। গিরিশ বাবুর মনে হলো সামনে সবকিছু কুয়াশার মতো সাদা হয়ে গেছে। তিনি চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না।
শেরে বাংলা ফজলুল হক গম্ভীর গলায় বললেন, কত টাকা লাগবে?
শেখ মুজিব বলল, বারোশো টাকার মতো।
শেরে বাংলা ফজলুল হক খুশি হয়েছেন। তিনি মুগ্ধ চোখে শেখ মুজিবের দিকে তাকিয়ে আছেন। শেখ মুজিবের এমন সাহস আর অনমনীয় ভঙ্গি তাঁর ভালো লেগেছে। তিনি ভাবছেন এ দেশের জন্য এমন সাহসী ছেলে দরকার। তিনি এসডিও সাহেবকে ডেকে বললেন, তাদের জন্য আমি বারোশো টাকা মঞ্জুর করলাম। অনতিবিলম্বে তাদের হোস্টেলের ছাদ মেরামতের ব্যবস্থা করুন।
গিরিশ বাবু শীতল আবহাওয়া অনুভব করছেন। তাঁর মনে হচ্ছে আশপাশে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। ঠাণ্ডা বাতাস ভেসে আসছে। সামনে দাঁড়ানো ছাত্ররা আনন্দ করছে। শেখ মুজিবের চেহারায় নমনীয় ভাব। তার চোখমুখে উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়িয়ে আছে।
শেরে বাংলা ফজলুল হক আরও এক পা সামনে এগিয়ে গেলেন। তিনি শেখ মুজিবের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন। শেখ মুজিবের কাঁধে হাত রেখেছেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। স্নেহমাখা গলায় বললেন, আজ থেকে তুমি আমার নাতি।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাকিয়ে আছেন। তিনি শেখ মুজিবকে দেখছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বুঝতে পেরেছেন ছেলেটি নির্ভিক এবং সৎ। ঠিকমতো গাইড করতে পারলে এই ছেলে আগামীদিনে একজন বিশাল রাজনীতিবিদ হয়ে উঠবে।
শেখ মুজিব কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে এসেছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন দিয়ে শেখ মুজিবের কথা শুনছেন। শেখ মুজিব বললেন, যুদ্ধ করে ইংরেজ আর না খেয়ে মরে বাঙালি। যে বাঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলাদেশ দখল করে তখন বাংলার এত সম্পদ ছিল যে, একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত। সেই বাংলাদেশের এই দুরবস্থা। মানুষ না খেয়ে রাস্তার পাশে মরে পড়ে আছে!
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বললেন, আমাকে কী করতে বলো?
শেখ মুজিব বেশ জোর দিয়ে বললেন, দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যাচ্ছে। আপনি মন্ত্রী। মানুষকে বাঁচানোর দায়িত্ব আপনার আছে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বললেন, কী করতে হবে আমাকে?
শেখ মুজিব বললেন, লঙ্গরখানা খুলে দিন। মানুষ যেন না খেয়ে মারা না যায়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাতারাতি বিরাট সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট গড়ে তুললেন। ‘কন্ট্রোল’ দোকান খোলার ব্যবস্থা করলেন। গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। অনেকগুলো লঙ্গরখানা খোলা হলো। দিল্লিতে গিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে বাংলাদেশের ভয়াবহ অবস্থার কথা জানালেন। সাহায্য দিতে বললেন। চাল, আটা, গম বজরায় করে বাংলাদেশে আনতে শুরু করলেন।
লঙ্গরখানায় দিনে একবার খাবার দেওয়া হয়। সারাদিন লঙ্গরখানায় কাজ করেন শেখ মুজিব। রাতে বেকার হোস্টেলে ফিরে আসেন। কোনোদিন আবার পার্টি অফিসে গিয়ে টেবিলে শুয়ে থাকেন। ক্লান্ত শরীরে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন। আজ তিনি লঙ্গরখানার কাজ শেষ করে বেকার হোস্টেলে ফিরছেন।
রাস্তার ওপাশে যে কাতর স্বরে কাতরাচ্ছে তার আওয়াজ ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসছে। এখন শুধু শোনা যাচ্ছে সে বলছে, একটু ফেন দাও।
শেখ মুজিব রাস্তার ওপাশে এগিয়ে গেলেন। আবছা আলো অন্ধকারে তিনি দেখলেন রাস্তার পাশে এক বাড়ির বাইরের দরজার সামনে একজন মহিলা কাত হয়ে শুয়ে আছে। পরনের কাপড় ছিঁড়ে গেছে। তার শরীরের হাড় দেখা যাচ্ছে। সে বাড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে মিনতি করছে, একটু ফেন দাও।
কেউ দরজা খোলেনি। দরজা খুলবে বলে মনে হচ্ছে না। এই মহিলা এরকম করে একটুখানি ফেনের আর্তি জানাতে জানাতে হয়তো এই বাড়ির দরজার সামনেই মরে যাবে।
শেখ মুজিব বুঝে উঠতে পারছেন না কী করবেন। তাঁর শুধু মনে হচ্ছে এই মানুষকে বাঁচাতে হবে। কীভাবে তাকে বাঁচানো যায় সেই চিন্তা করছেন। তিনি আর সেখানে দাঁড়ালেন না। দ্রুত হেঁটে হোস্টেলে চলে গেলেন।
হোস্টেলে ফিরে শেখ মুজিব দেখলেন বন্ধুরা খেতে বসেছে। খাবার আয়োজন তেমন বিশেষ কিছু না। তবে আজ ফুলকপি দিয়ে পোনা মাছ রান্না হয়েছে। মাছ প্রতিদিন রান্না হয় না। ভাত, সীম ভাজি আর ডাল আছে। ভাত আর ডাল থেকে গরম ধোঁয়া উঠছে।
নুরুদ্দিন নামে শেখ মুজিবের একজন বন্ধু আছেন। এখানে থাকেন। তিনিও খেতে বসেছেন। নুরুদ্দিন বললেন, তাড়াতাড়ি মুখহাত ধুয়ে এসো। ভাত-তরকারি ঠান্ডা হয়ে যাবে। যে শীত পড়েছে, গরম-গরম খেলে ভালো লাগবে।
শেখ মুজিব কিছু বললেন না। তিনি চুপচাপ থালায় ভাত বাড়লেন। তার ওপর সীম ভাজি আর ফুলকপি দিয়ে রান্না মাছের তরকারি নিলেন। একপাশে খানিক ডাল তুলে নিলেন। পাশে রাখা সরপোশ দিয়ে খাবারের থালা ঢাকলেন। বন্ধুরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তাঁরা কিছু বুঝতে পারছেন না শেখ মুজিব কী করছেন। তাঁদের ভেতর স্তম্ভিত ভাব চলে এসেছে।
থালা হাতে শেখ মুজিব উঠে দাঁড়ালেন। নুরুদ্দিন বললেন, কোথায় যাচ্ছ?
শেখ মুজিব বললেন, তোমরা খেয়ে নাও। আমি এখনি আসছি।
তিনি যেমন দ্রুত এসেছিলেন তেমনি খাবার নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
শেখ মুজিব ফিরে এসেছেন রাস্তার পাশের সেই বাড়ির কাছে। যেখানে একজন বুভুক্ষু নারী ক্ষুধার যন্ত্রণায় একটু ফেনের জন্য কাতরাচ্ছিল। তিনি দেখলেন সেই মহিলা আগের মতোই বাড়ির দরজার সামনে কাত হয়ে পড়ে আছে। তবে এখন আর কোনো সাড়াশব্দ করছে না। সে বেঁচে আছে কিনা শেখ মুজিব বুঝতে পারলেন না। তিনি কাছে গিয়ে ডাকলেন, শুনছেন মা! উঠুন, আপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।
খাবারের কথা শুনে ক্ষুধার্ত মহিলা খানিকটা নড়ে উঠল। বেশ কষ্ট করে চোখ মেলে তাকাল। তার চোখের সামনে সবকিছু অস্পষ্ট। সে ভালোমতো কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কতদিন খেতে পায়নি। ক্ষুধায় কষ্টে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অবশ হয়ে আসছে পুরো শরীর। উঠে বসার মতো শক্তি তার শরীরে অবশিষ্ট নেই।
শেখ মুজিব তাকে ধরে তুলে বসালেন। মহিলা উঠে ঝিম ধরে বসে থাকল। তাকে কী করতে হবে সে যেন বুঝতে পারছে না।
খাবার পরে পানি খাওয়া দরকার। পানি আনা হয়নি। খাবার আগে হাত ধোয়া দরকার। শেখ মুজিব চিন্তিত হলেন। তিনি পানির জন্য এদিকওদিক তাকালেন। হঠাৎ তাঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মহিলার কাছে একটা ঘটি আছে। সেটা হাতে নিয়ে শেখ মুজিব উঠে পড়লেন। এখন পানির সন্ধান করতে হবে। রাস্তার ওপাশে পানির কল পাওয়া গেছে। শেখ মুজিব হেঁটে গিয়ে ঘটি ভরতি করে পানি নিয়ে এলেন।
তিনি পানি নিয়ে মহিলার কাছে ফিরে এসেছেন। মহিলার চোখে বিস্ময়। মনে হচ্ছে সে এখনো বুঝতে পারছে না ঘটনা কী ঘটছে। তার ভেতর এলোমেলো ভাব। মহিলা কাতর চোখ মেলে শেখ মুজিবের দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়াবহ ক্ষুধায় তার পেট মোচড় দিয়ে উঠেছে। সে বলল, একটু ফেন দাও।
শেখ মুজিব তার সামনে ভাতের থালা মেলে ধরলেন। মহিলা হকচকিয়ে গেছে। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্ট থেকে আসা আলোতে ভাতের থালা চকচক করছে। ভাতের ওপর তরকারি, ডাল। মহিলার দুই চোখ ঝিকমিক করে উঠেছে। কতদিন পর ভাতের সন্ধান পেয়েছে। একটুও দেরি করল না। ছেঁড়া শাড়িতে হাত মুছে থাবা দিয়ে ভাত তুলে নিলো মুখে।
হামহাম করে ভাত খাচ্ছে মহিলা। শেখ মুজিব তার দিকে তাকিয়ে আছেন। গাবগাব করে কারও খাওয়ার দৃশ্য এমন সুন্দর হতে পারে তিনি আগে কখনো খেয়াল করেননি।
মহিলা কয়েক গ্রাস ভাত খেয়ে শেখ মুজিবের দিকে তাকাল। তার মুখে হাসি। সে হাসছে। তার মলিন চোখ দুটো হাসছে। সেই চোখে পানি চিকচিক করছে। অনেকদিন পর ভাত খেতে পাওয়ার আনন্দে চোখে পানি চলে এসেছে।
শেখ মুজিব মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি মুগ্ধ চোখে একজন তৃপ্ত প্রশান্ত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন