রেজাউল করিম মুকুলের প্রবন্ধ


হৃদয় মাঝে চিরঞ্জীব, শতবর্ষে শেখ মুজিব

১৯৭১ এর আগে পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ কখনোই স্বাধীন ছিলো না। সুলতানী আমল থেকে মোঘল আমল, ইংরেজ আমল থেকে পাকিস্তানী আমল সবসময়ে এদেশ কারো না কারো দখলে-শাসনে ছিলো। আর বাঙালিরা ছিলো নিজ দেশে পরবাসী, বিদেশি কোন সম্রাট; সুলতানের শাসিত প্রজা। আস্তে আস্তে সময়ের কালস্রোতে বাঙালি বুঝতে শিখেছে, নিজ জন্মভূমিতে পরাধীন থাকতে অস্বীকার করেছে, সোচ্চার হয়েছে, আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে; পরাজিত হয়েছে, আবার জেগে উঠেছে, দলিত মথিত হয়েছে পশুর মতো। এ অবস্থাটি চলেছে হাজার বছর ধরপাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে ভয় পেয়েছিলো, ফাঁসির আদেশ থাকা সত্ত্বেয় সাহস ম করেনি। হাজার মাইল দুরের অবাঙালি শাসকরা বুঝতেই পারে নাই ১৯৭০ এর নির্বাচনে শতভাগ বাঙালি শেখ মুজিবর রহমানকে সমর্থন দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা চাইবে। যখন বুঝতে পেরেছে দেখে যুদ্ধক্ষেত্রে হাজার বছরে জন্ম নেয়া স্বাধীনতাকামী সাড়ে লাখো মানুষের শেষ উত্তরাধিকারী একজন শেখ মুজিব যার পেছনে আরো মুজিব, সাড়ে সাত কোটি মুজিব। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী এ দেশে যে গণহত্যা চালায় তার অর্ধেক কৃতিত্ব জামায়াতের রাজাকার, আলবদরদের। এরাইতো পাক সেনাদের চিনিয়ে দিয়েছিলো নিজ গ্রামবাসী, মহল্লাবাসী আর প্রতিবেশিদের ঘরবাড়ি। বঙ্গবন্ধুর সঘোষিত খুনিদের লালন পালন, পরিচর্যা, যত্ন-আত্বি করেছেন জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করার বিচারক পাওয়া যায়নি। যেওবা দুই একজন পাওয়া যায় তারাও বিব্রতবোধ করেন। আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ তার গোটা মেয়াদকালে বিচারপতি খুঁজে পাননি। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি যখন ক্ষমতায় থাকে তখন বঙ্গবন্ধু নামটাই হারিয়ে যায়। ৭ মার্চের ভাষণটা আর্কাইভে চলে যায়, বঙ্গবন্ধুর জায়গায় লেখা হয় মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান আর স্বাধীনতার ঘোষকও বদলে যায়। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পরবর্তী বছরগুলোতে ১৫ আগস্টের নাম ছিলো নাজাত দিবস।

মুঘোল বাদশা বাবুর তার জীবনস্মৃতি গ্রন্থ, বাবরনামাতে লিখেছেন, ‘স্বয়ং সুলতান পদের মহাত্ম এই যে যে লোকই তাহাকে হত্যা করে সেই সুলতান হইয়া সিংহাসনে বসে আমীর, উজির, সৈনিক, কৃষক সঙ্গে সঙ্গে তাহাকে মানিয়া নেয়।’ বাবুরের উক্তি ঐতিহাসিকভাবে সত্য পাল রাজাদের আশ্রিত সুদূর কর্ণাটক থেকে আসা অবাঙালি সেনরা সুযোগ বুঝে বাংলার সিংহাসন দখল করে নিয়েছিলো খলজীরা খলজীদের হাতেই নিহত হয়ে সিংহাসন হারায় বাংলার অন্যতম নৃপতি আযম শাহ তার ১৭ জন ভাই পিতাকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন দখল করেছিলেন রাজা গনেশর ষড়যন্ত্রে আযম শাহ নিহত হয়েছিলেন গনেশের ধর্মান্তরিত পুত্র যদু জালাল উদ্দিন গনেশকে হত্যা করে এবং যদুর পুত্র নিহত হলে বাংলার ক্ষমতা চলে যায় ইলিয়াস শাহী বংশধারার রুকনুদ্দিন বারবাক শাহের দখলে রুকনুদ্দিন তার প্রাসাদ পাহারা দেয়ার জন্য সুদূর আবিসিনিয়া থেকে নিয়ে আসেন আট হাজার হাবসি দাসকে এদের অধ্যক্ষ খোজা বারবাক রাতের অন্ধকারে সুলতানকে হত্যা করে নিজেকে সুলতান ঘোষনা করে  ১৪৮৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দ ছয় বছর বাঙলা শাসন করেছিলো চারজন হাবসী দাস ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে বাঙলার সুলতান ছিলেন রুকনুদ্দিন বারবক শাহ তিনি তার প্রসাদ পাহাড়া দেয়ার জন্য সুদূর আবিসিনিয়া থেকে আট হাজার হাবসীকে বাঙলায় নিয়ে এসেছিলেন পাহাড়াদারের চাকরি দিয়ে একদিন রাতের অন্ধকারে এই পাহাড়াদার হাবসীরা ঘুমন্ত সুলতানকে হত্যা করে এবং এদের অধ্যক্ষ খোজা নিজেকে সুলতান শাহজাদা ঘোষণা করে বাংলার সুলতান হয়ে যায় প্রসঙ্গে মুঘোল বাদশা বাবুর তার জীবনস্মৃতি বাবুরনামা লিখেছেন, ‘স্বয়ং সুলতান পদের মজা এইযে, যে লোকই তাহাকে হত্যা করে সেই সুলতান হইয়া বসে আমির, উজির, সৈনিক এবং প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গে তাহাকে মানিয়া লয়।’ বাদশা বাবুরের উক্তির যথার্থতা আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করি বৈকি ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট ঘুমন্ত রাষ্ট্রপতিকে হত্যাকারী সুবিধাভোগী সেই দাস পাহাড়াদার প্রজন্ম আজও ওঁৎ পেতে আছে রক্তের স্বাদ পাওয়া লোভী বাঘের মতো 
হাবসি দাস সুলতান মুজাফ্ফর এর দুঃশাসনে অতিষ্ট প্রজাবিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় তারই উজির সৈয়দ হোসেন এবং সুলতান হয়ে যায় ইনিই বিখ্যাত প্রজাহিতৈষী কুমিল্লার চাঁদপুরে প্রতিষ্ঠিত আরবি আলাউদ্দিন হোসেন শাহ অন্যদিকে দিল্লিতে বাদশা বাবুরের সামান্য কর্মচারি শেরখান শূর শুধু বাংলাই নয় বাদশা হুমায়ুন কে বারবার পরাজিত করে দিল্লিই দখল করে নেন মুঘোল বাদশা আওরঙ্গজেব তার নিজ ভাইদের হত্যা করে সিংহাসন দখল করে নিয়েছিলো বাংলার ক্ষমতা দখলের ইতিহাস অতি প্রাচীন, করুন মর্মান্তিক ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, নভেম্বরে জেলহত্যাকাণ্ড, নভেম্বরে বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল খালেদ মোশারফ, কর্নেল তাহেরসহ সৈনিক হত্যা শেষে জিয়াউর রহমান মনজুর হত্যাকান্ড ছিলো ক্ষমতা দখল বা রক্ষার যুদ্ধ এসব যুদ্ধে দেশের কৃষক শ্রমিকরা অংশ নেয় নাই গোলাম আযম, মুজাহিদ কিংবা সাকা চৌধুরীরা একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলো যাতে দেশ পাকিস্তান থাকে, স্বাধীন না হয় ক্ষমতা দখলের ধারাটি আজও বিদ্যমান এবং দস্যুগোষ্ঠী খুবই তৎপর তাইতো বেহুলা বাংলা আজও দুঃখীনি

 লেখক : রেজাউল করিম মুকুল, রংপুর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন