নারী ও নিকোটিন
||এক||
—মা প্রিয়া, এই ভোরে বসে বসে কী করছিস?
—কিছু না, বাবা।
—কিছু তো করছিস।
—কী করি করি, তোমাকে বলবো কেন? এই ভোরে আমার জানালার কাছে আর কখনো আসবে না। যাও ঐ দিকে হাঁটো।
'ঠিক আছে, আসবো না। থাক।'—বলেই বিষ্ণুর বাবা চলে যাচ্ছিল। 'বাবা, একটু দাঁড়াও।'—মেয়ের ডাক শুনতেই ফিরে তাকালো।
—বাবা, আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করছি, কিন্তু হচ্ছে না। আমার এক বন্ধু তুখোড় কবিতা লেখে। তুমি লিখতে জানো, বাবা?
'না রে মা। তোর মা ভালো কবিতা লিখতো।'—বলেই বিষ্ণুর বাবা চলে গেলেন। হঠাৎ বিষ্ণুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। যখন সে ক্লাস সিক্সে, অজানা কারণে মা কে হারায়।
বিষ্ণুপ্রিয়া। মেয়েটির কবিতা লেখার বড়-ই শখ। রুমের দখিন জানালা খুলে প্রতি প্রভাতে ডায়েরি আর কলম নিয়ে বসে। অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে কয়েকটি শব্দের জন্য, আর কলমে-দাঁতে যুদ্ধ চালায়। একটির পর একটি শব্দ-বাক্য-পৃষ্ঠা কেঁটে-ছিঁড়ে ফেলে। কাব্যিক শব্দ একটিও মনে হয় না ওর কাছে। না, এ জীবনে সে আর লিখতে বসবে না—প্রতিদিন সিদ্ধান্ত শেষের, প্রতিদিন চেষ্টা নতুনের। অবসরে কবিতার বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকে। এভাবেই কবিতার সাথে সখ্যতা, কবিতার প্রতি প্রেম, কবিদের সাথে সখ্যতা। এক ঘনিষ্ঠ কবি বন্ধু আছে ওর, যার কাছে থেকে রোজ দু'বেলা প্রস্তাব পায় প্রেমের। কিন্তু প্রতিবারেই ঠাট্টার ছলে প্রত্যাখ্যান করে।
—এই বিষ্ণু, বাস না রে ...একবার শুধু বেসেই দেখ না ...
—বাসলে কী দিবি রে অনি...?
—কবিতার সমুদ্রে তোকে ডুবে মারবো!
—তাহলে বেসে লাভ কী, মরেই তো গেলাম?
—ধুর, এই মরা তো মরা নয়। তোর সারা জীবনের কাব্যতৃষ্ণা মেটাবো।
—ও ...আচ্ছা। আচ্ছা বাসলাম।
—সত্যি?
—হু, সত্যি।
—তোর সাথে আমার বিয়ে হবে?
—না।
—কেন হবে না?
—তুই আমার ফ্রেণ্ড, তোকে বিয়ে করতে যাবো কেন?
—তাহলে বললি বাসিস আমাকে?
—বাসলেই বিয়ে করতে হবে বুঝি? বন্ধু বন্ধুকে ভালোবাসবে না? যা আর বাসবো না ...
—সরি সরি ...তুই বাসলেই চলবে। বিয়ে-টিয়ে করতে হবে না।
—প্রমিস?
—প্রমিস।
—মি. অনিকেত, এই বিষ্ণুপ্রিয়ার কাছে আজ কততম প্রমিস করলেন?
—একশত চার।
—কাল একশত পাঁচ হবে না তো?
—চল বিষ্ণু হাটি...
—চল...
অনিকেত। কবিতা লেখায় হাত আছে। দুর্দান্ত সব কবিতা লেখে নিয়মিত। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ওর লেখা ছাপে। বন্ধুরা ওর কবিতার ভীষণ ভক্ত। 'সমুদ্র সঙ্গম' নামক একটি কবিতার মাধ্যমে বন্ধু মহলে কবি হিসেবে পরিচিতি পায় সে। এ হলো বিষ্ণুপ্রিয়ার সেই প্রেমিক কবি বন্ধু। কবিতাসূত্রে ঘনিষ্ঠতা প্রগাঢ়। গত একশত চার দিন ধরে বিষ্ণুপ্রিয়াকে প্রেম প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
—রুমমেট প্রেম-ট্রেম করবে না আর?
—আরে না। ফালতু একটা বস্তু এই 'প্রেম'।
—আরে তোমার কয়েকটা গেছে তো, এখন ফালতু মনে হবেই। এখন পর্যন্ত একটা প্রেম জুটলো না কপালে।
—কেন, তোমার বিষ্ণুর খবর কী?
—ধুর, ওটা প্রেম বোঝে না। প্রতিদিন দু'বার করে বলি, উড়িয়ে দেয়।
'তাহলে সিগারেট খাওয়া শুরু করো, নাও একটা টান দাও। একটা জ্বলন্ত সিগারেট মানুষ কে সব ভুলে থাকতে সাহায্য করে।'—হাতের সিগারেট টা অনিকেতের দিকে বাড়িয়ে দেয় রূপম।
অনিকেত একটা টান দিয়ে কাশতে কাশতে সিগারেট অ্যাশ ট্রেতে দুমড়ে রেখে বলে, 'রুমমেট, এটা ক্যামনে খাও? তুমি কি সিগারেট ছাড়বে না?'
'উঁহু'—বলে হাতের আঙুলের ফাঁকে জ্বালানো সিগারেটে আরেকটা টান দেয় রূপম।
রূপম। ভবঘুরে স্বভাবের। মেয়েদের পিছনে বছর তিনেক শরীর-মন-মাথা ঘামিয়ে নামের সামনে 'ছ্যাঁকা' শব্দটি জুটয়েছে। পরিচিত মহলে 'ছ্যাঁকা রূপম' নামে সমাদৃত। ব্যাপক মাত্রায় ধূমপায়ী। মধ্যবয়সী মা আর সদ্য নাবালিকা পেরুনো বোন বাসায় থাকা সত্ত্বেও নারীকুল ওর কাছে ঘৃণার বস্তু। ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট নারী শূন্য, ওর বন্ধু মহল নারী শূন্য। এই বাইশ বছর বয়সেই নিজেকে চিরকুমার ঘোষণা দিয়েছে। তিন-চার মাস অন্তর বাসায় যায়। দ্রোহের কবিতা পছন্দ, বিচ্ছেদের গল্প ওর কাছে সার্থক সাহিত্য। মেস লাইফ প্রিয়। এরই রুমমেট অনিকেত, যাকে সে প্রতিদিন সিগারেটে একটি করে টান দেওয়ায়।
||দুই||
—এ বিষ্ণু, কিছু ভেবে দেখলি?
—প্রতিদিন ভাবি রে, একটা কবিতাও আসে না।
—আরে কবিতা না, আমার কথা কী ভাবলি?
—তোর কথা...আজ আবার শুরু করলি? তুই যে কালটু, তোর সাথে আমার যায় নাকি?
—নিজে তো আটার বস্তা। যা তোকে লাগবে না। এখনো তেরোটা অপেক্ষমাণ রেখেছি, একটা বেছে নিবো।
—নিস। চল কিছু খাওয়াও এখন।
—পারবো না। তোকে খাওয়ায় কী লাভ?
'চল আমি খাওয়াবো।' বিষ্ণু অনির হাত টেনে নিয়ে গেলো।
ক্যান্টিনে দু'জনে খাচ্ছে আর গল্প করছে।
—আগামী বই মেলায় একটা বই বের করবো, কিছু টাকা দিস।
—আমাকে বন্ধক রেখে কারো কাছে টাকা নিস।
—আচ্ছা।
—তুই আমাকে বন্ধক রাখতেও রাজি?
ক্যান্টিনের এক কোণায় রূপম একা এসে বসলো। দেখেই ডাক দিলো অনিকেত, 'রুমমেট, আসো খাই।'
'খাও তোমরা।'—বলে রূপম দ্রুত খেয়ে চলে গেলো।
—তোর রুমমেট টা বদলাবে না রে?
—না। তুই চেষ্টা করতে পারিস।
—কাজ নেই তো আর। তোর রুমমেট যা সিগারেট খায়। সিগারেট খাওয়া মানুষ আমার একদম অপছন্দ।
—তোর বর যদি বিয়ের পর সিগারেট খায়?
—সেদিনই ডিভোর্স।
—ঠিক আছে, তোকে কিছুই করতে হবে না। তুই শুধু ফোনে রূপম কে পটাবি। পারবি?
—কী দিবি?
—কী চাস?
—তোর বাসায় গিয়ে তোর মায়ের হাতের রান্না খাবো।
—ঠিক আছে। ফোন নম্বর নে। ও কিন্ত তোকে বিষ্ণু নামে চেনে।
—প্রিয়া নামে তো চেনে না?
—হু।
সন্ধ্যার পর। রূপম শুয়ে আছে; শরীর টা ম্যাজম্যাজ করছে। অনিকেত পড়ার টেবিলে; ফোন চাপছে। রূপমের ফোনে একটি অপরিচিত নম্বরের কল বাজছে। রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে, 'আমি প্রিয়া বলছি, তুমি নিশ্চয় রূপম?'
—হ্যাঁ।
—ব্যস্ত?
—না। কী বলবেন সোজা বলুন।
—আমাকে তুমি করে বলতে পারো। তোমাকে ক্যাম্পাসে প্রায়ই দেখি।
—তো?
—তোমাকে আমার ভালো লাগে।
রূপম তড়িৎগতিতে ফোনটা রাখলো।
—রুমমেট, কে?
—আরে যত্তসব আজিব প্রাণী কই থেকে যে আসে। পিয়া না টিয়া, ক্যাম্পাসে দেখে ভালো লেগেছে। আজগুবি।
—সমস্যা কী? চালাও।
রুপম সিগারেট ধরিয়ে বললো, 'তুমি বুঝবে না রুমমেট, এসব ভীষণ ক্ষতিকর।'
—সিগারেট কি ক্ষতিকর নয়?
—হু, শারীরিক। একজন নারী শারীরিক ও মানসিক একসাথে দু'ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
—রাজা আম্বুর না কার জানি তৃতীয় রাণী বলেছিলেন, 'প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে একজন নারীর অবদান থাকে ...'
অনিকেতের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রূপম বলে, 'একজন নারী নয়, একজন সফল ও একনিষ্ঠ নারী।'
—যাই হোক, নারী তো?
—না রুমমেট, তুমি যাই বলো আমি জানি এরা কতটা সমস্যার বস্তু। কবি নজরুল কি সাধে বলেছিলেন,
'নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা
চায় তত আরো!
ইহাদের অতিলোভী মন
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়,
যাচে বহু জন।...'
অনিকেত আর রূপমের আজকের সন্ধ্যেটা কেটে গেলো এভাবেই। রূপমের শরীরের ম্যাজম্যাজ এখনো থামে নি। অনিকেত বিষ্ণু কে ফোন দিয়ে হেসে অস্থির, 'আমার মা'র হাতের রান্না খাওয়া এত্ত সহজ!'
—ভালো হয়েছে, চুপ থাক।
—ঠিক আছে।
—কাল ক্যাম্পাসে আয়, একটা কথা আছে।
—কাল তো শুক্রবার, ফোনেই বল।
—শুক্রবার তাতে কী? আমি ডেকেছি, তুই আসবি।
—আচ্ছা।
রাতে টিভি রুমে বাবা-মেয়ে গল্প করছে। প্রসঙ্গক্রমে বিষ্ণুর বাবা বললেন, 'যুবক বয়সে ফ্রেণ্ডরা মিলে ধূমপান করতাম। বিয়ের পর তোর মা'র জন্য আর হলো না। তুইও তোর মা'র মতোই হয়েছিস।'
—হু।
—ভাবছি শুরু করবো আবার...
—করে দেখো, বাসা থেকে বের করে দিবো তোমকে।
—তাই! আচ্ছা করবো না।
—মনে থাকে যেন। চলো খাবো এখন।
—চল...।
||তিন||
মাঝে তিনদিন বিষ্ণু অনিকেতের দেখা পায় নি। আজ হঠাৎ ক্যাম্পাসে দেখা ক্যাম্পাসের বড় বটগাছটার নিচে।
—এই তিনদিন কই ছিলি?
অনিকেত মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে।
—চুপ করে আছিস কেন, বল কোথায় ছিলি? ক্যাম্পাসে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি, কতবার ফোন দিয়েছি, তুই অন্তত ফোন টা রিসিভ করতে পারতি?
অনিকেত নিরুত্তর।
বিষ্ণুর কণ্ঠে উত্তেজনা, 'প্রতিটা দিন জ্বালাতি ভালোবাসি বলে বলে। আজ চুপ করে কেন? জ্বালাও আমাকে, বল আজ কত ভালোবাসিস?'
অনিকেত নিশ্চুপ; চোখে জল।
—ভাবছিস প্রতিবারেই তো না বলি, তাই আর বলবি না। তোকে বলেছিলাম না, একটা কথা আছে। গত তিনদিন সেই কথাটি বলতেই এসেছিলাম, কিন্তু তুই নেই। শুনবি না আজ?
—বল।
—ভালোবাসি তোকে। আগের মতো ভালোবাসা নয়, এটা প্রেম। তোর আমার বিয়ে হবে।
অনিকেত চোখে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে বিষ্ণুর দিকে।
—কি রে কথা বলছিস না কেন, বাসবি না? বিষ্ণুকে তোর প্রিয়া বানাবি না?
অনিকেত গম্ভীর কণ্ঠে বললো, 'না।'
—দুষ্টুমি হচ্ছে? ভাব নিচ্ছিস?
—না। তোকে অনেক ভালোবাসতাম, আর বাসি না।
বিষ্ণু মুহূর্তেই নিশ্চুপ হয়ে গেলো।
—আমি তোর সাথে আর কখনই এভাবে বসবো না। তুই শুধু না, কোনো নারীর সংস্পর্শ আমি চাই না। আমি এখন থেকে ধূমপান করবো, দ্রোহের কাব্য লিখবো। আমি রূপম হবো।
অনিকেতের চোখে জল। বিষ্ণু নরম কণ্ঠে বললো, 'চুপ কর অনি, কাঁদিস না। তোর কী হয়েছে, আমাকে খুলে বল প্লিজ।'
অনিকেত চোখ মুছলো। একটু পর ধিরে ধিরে বললো, 'রূপম আর নেই, আমার রুমমেট মরে গেছে।'
দুজনেই চুপ।
একটু পর অনিকেত বললো, 'ডাক্তার বলেছেন, অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে ওর রক্ত দূষিত হয়েছিলো, ফুসফুস কাজ করছিলো না। কিন্ত আমি জানি ওর মৃত্যুর কারণ নারী। আমিও চাই না আমার জীবনে কোনো নারী আসুক। আমি ধূমপান করবো। আর আমি জানি তুই ধূমপায়ীদের অপছন্দ করিস।'
বিষ্ণু কিছু না বলেই উঠে চলে গেলো।
—বাবা, এটা তোমার জন্য।
—কী করবো আমি?
—খাবে।
—তুই আমাকে সিগারেট খেতে বলছিস?
—হ্যাঁ, কোনো সমস্যা?
—না। তুইতো ধূমপান অপছন্দ করিস?
—আর করি না। ভেবে দেখলাম তোমার ধূমপান করা উচিৎ।
—আচ্ছা। দে দেখি...
দু'দিন পর। অনিকেত ওর রুমে শুয়ে আছে। রূপমের বেড, পড়ার টেবিল তেমনি আছে। টেবিলের ওপর পরে আছে মুখ খোলা একটি সিগারেটের প্যাকেট, দেয়াশলাই, ছাঁই, দুমড়ানো সিগারেট আর পোঁড়া কাঠি সহ অ্যাশ ট্রে।
কী যেন ভেবে বিষ্ণু কে ফোন করলো। রিসিভ করলো না। আবার দিলো, কেটে দিলো। আবার দিলো, রিসিভ করলো। অনিকেত বললো, 'কেমন আছিস?'
বিষ্ণু গম্ভীর কণ্ঠে বললো, 'ভালো।'
—ক্যাম্পাসে আসবি না?
—না।
—সেদিনের জন্য সরি।
—তো?
—আমার মা'র হাতের রান্না খাবি না?
—না।
অনিকেত একটু চুপ থেকে বললো, 'ভালোবাসি।'
ফোনটা কেটে গেলো। আবার ফোন দিলো অনিকেত, কেটে দিলো। আবারো দিলো, বিষ্ণুর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।
অনিকেত রূপমের টেবিলের ওপর থেকে একটি সিগারেট ধরালো। টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেই যেন হৃদপিণ্ড হতে বিষ্ণু নামটি উড়ে গেলো।
♦
শিস খন্দকার
রংপুর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন