রোস্তন মিয়ার কবর
||এক||
প্রায় ত্রিশ বছরের পুরনো কবরে শুয়ে থেকেও নিজের ছেলেকে চিনতে কোনধরণের অসুবিধা হয় না মৃত রোস্তন মিয়ার। আরজ যে বছর গ্রামের স্কুল থেকে শহরের স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়, সেবছরই কুয়াশাবৃত এক শীতের সকালে রোস্তন মিয়া নীরব নিঃশব্দে পরজগতে পাড়ি জমায়। তখন বাপহীন আরজ, গোঁড়া নড়বড়ে গাছের মতোই হেলে পড়ে, পড়ালেখা ছেড়ে দেয়। এবং মানুষের মুখে মুখে এতিম আরজকে নিয়ে দুঃখমিশ্রিত বাণী ভাসতে শুরু করে— বাপই তো সব, বাপ না থাকলি কি আর কিছু ভাল্লাগে, আরো ঐটুকুন ছুড়া বাপ হারায়ছে। এ দুখখোর কি শ্যাষ আছে!
কিন্তু না, সেই দুঃখের শেষ থাকলো। বাপ মারা যাওয়ার পরে প্রায় তিনমাস চট্টগ্রামে নানাবাড়ি গিয়ে ঘুরে আসার পর আরজ আলী বাপ হারানোর শোক অনেকাংশই ভুলে গেল। এবং আগের মতোই সবকিছু করতে লাগলো। তারপর কতো বছর, দিন রাত আর ঘড়ির কাঁটার সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে সেই বালক আরজ এতদিনে হয়ে উঠেছে ৪২/৪৩ এর একজন বয়স্ক আরজ আলী সাহেব।
আজ সকাল থেকেই ছেলের মন খারাপ দেখে রোস্তন মিয়ারও মন ভালো নেই, পাকা বারান্দার এককোণে তামাটে মুখ করে বসে আছে আরজ আলী, তার কপালে গভীর চিন্তার তিনখান ভাঁজ লম্বালম্বী পড়ে আছে। এমন হতো যে, রোস্তন মিয়া বেঁচে থাকতো, তাহলে নিজপুত্রের সমস্যার জন্য একটা উপায় বের করে দেবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সে রাস্তা বন্ধ, এখন তার দিনরাত শুধুই পুকুরপাড়ের গোরস্থানে শুয়ে শুয়ে, উপায়হীনভাবে ছেলের বিপদ-আপদ দেখে যেতে হয়। আরজ আলীর জন্য তার খুব মায়া হয়। সেই হিসেবে আরজ আলীর দিকে তাকালে নিজের বাপের প্রতি কতটুকু টান আছে, তা কেউ অতিসহজেও বুঝে নিতে পারে আবার নাও পারে। যেমন, আরজ আলী এই সদ্যাতীত চার পাঁচ বছর বাদে মাঝের ২৫/২৬ বছরের ভেতরে বাপের কথা মনেই করেনি, কেমন যেন সে এটাও ভুলতে বসেছিল, একজন পিতার মাধ্যমে তার পৃথিবীর মুখ দেখা হয়েছে। কিন্তু একসময় যখন আরজ আলী বাপের লাগানো বড় বড় মেহেগুণী গাছ বেচে তার ছেলে হাসানকে বিদেশ পাঠায়, এবং দু'মাস যেতে না যেতেই হাসানের বেতনে পুরো বাড়ি ঝলমল করে ওঠে। তখন আরজ আলীর মনে পড়ে বাপের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের কথা, সেইকালে যদি রোস্তন মিয়া মেহেগুণীর চারা না পুততো, তাহলে কি আজীবনেও এমন সুখ পরিবার দেখার ভাগ্য হতো তার?
তারপর থেকে পুরো ৪/৫ বছর ধরে প্রতি শুক্কুরবার নামাজের পরে অাধাশুদ্ধ দোয়া-দরুদে রোস্তন মিয়ার কবর যিয়ারত করে।
আরজ আলীর বৌ রহিমা বেগম রান্নাঘর থেকে এসে ঘরের বারান্দায় উঠতে উঠতে দেখল, তার স্বামী পীরবাবার মতো গভীর ধ্যানে কী যেন ভাবছে। রহিমা বেগমের বুঝতে বাকী রইল না আরজ আলীর চিন্তার বিষয় জানতে। সে একটু আবদারসূচক চেঁচানি দিয়ে বলল— দিন নেই রাত নেই, সারাদিন কী এরাম করে ভাবছাও, এত টেনশন কল্লি কি মানুষ বাঁচে!
বৌয়ের কথায় ধ্যানভঙ্গ হয়ে ফ্যালফ্যাল চেহারায় তাকিয়ে থাকে আরজ আলী বলে— না, সিরাম কিছু না। ভাবছি মা'র কথা। ঐ সুমায় মা কী করে সহ্য করে নেবে এরাম কাজডা।
—সে সুমার কথা সে সুমায়, এ্যাখন ঐ নিয়ে টেনশন করাত তো কোনো ইয়ে দেখছিনে। আসো, রুটি দিছি, মুরগীর গোশতের ঝোল দিয়ে খেয়ে ন্যাও।
আরজ আলী সকাল থেকে না-খাওয়া পেটে মুরগীর ঝোল আর রুটির কথা শুনে একটু দ্রুতই উঠে দাঁড়াল, এবং বৌয়ের পেছন পেছন খাওয়ার ঘরের দিকে ঢুকলো।
||দুই||
রসুলপুর নামের এই ছোট্ট বসতিতে একমাত্র আরজ আলীর ছেলেই বিদেশের টাকা ঘরে আনে, তাছাড়া বাকী ঘরের প্রায়ই কৃষী কাজ করে। তাদের কাছে বিদেশে চাকরি করা মানে দুনিয়াতে বসে জান্নাতী সুখ উপলব্ধি করা। সুতরাং সমস্যা হলো, বাইরে থেকে আরজ আলীর বাড়িতে যে অতিরিক্ত জান্নাতী ফুর্তি দেখা যায়; এটা কেউ এত সহজে সহ্য করতে পারে না। মানুষ রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সামান্য দিনের খাবার যোগাড় করতে হিমশিম খায়; আর সেখানে আরজ আলীর পরিবার খেয়ে দেয়ে আরো নেচে গেয়ে বেড়ানোরও সুযোগ পাচ্ছে। এই অন্যায় কিভাবে মেনে নেবে অবুঝ রসুলপুরবাসী? প্রথম প্রথম আরজ আলীদের পেছন-বাড়ির হাসমতের মা প্রতিদিন অন্তত দুবার করে এসে রহিমা বেগমের কাছে দাবী ভরে বলত— ভাবি, হাসমত তো হাসানের আপন ভাইর মতো হয়েই গ্রামে থাকতো। এখন কোনো কায়দা মায়দা করে ওরেও বিদ্যাশ পাঠানি যায় না? দুই ভাই একসাতি থাকবি। দ্যাখো ভাবি। ইট্টু দ্যাখো।
রহিমা বেগমের মনে পড়ে না কবে আবার হাসমত হাসানের সাথে ভাইয়ের মতো আচরণ করলো। বরং তার মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথা, যেদিন নতুন বিহারিবাড়ির গাছ থেকে হাসান আর হাসমত সুপারি চুরি করতে যেয়ে ধরা পড়লো, তখন হাসমত ও হাসমতের মা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সাড়া গ্রামবাসীকে হাসানকেই চোর প্রমাণ করেছিল। কিন্তু কয় বছরের ব্যাবধানে হাসমতের মা'র কথা চেঞ্জ হয়ে গেল। এখন রহিমা বেগম হাসমতের মা'র কথায় খানিক্ষণ চুপ করে থেকে থেকে বলে— ঠিকাছে, ভাবি। আমি হাসানেস সাতি কতা কয়ে দ্যাকপানে, ও অনেক ব্যস্ত থাকে তো।
অবশেষে একদিন এই ছোটখাটো নাটকের অবসান হলো। হাসমতের মা যাচ্ছে তাই বলে মুখ খারাপ করে গেল আরজ আলীর বাড়ির পরে এসে। এবং হাসানের পরে অভিশাপেরও বুলি থুবড়ে গেল। আর তারপর থেকে বড়সড় শত্রুতে পরিণত হলো হাসান ও হাসমত পরিবার। এভাবে নানা বাহানা করে করে আশপাশের আরো দুই-চার ঘর আরজ আলীদের সাথে সকাল সন্ধ্যা ফেতনা সৃষ্টি করার সূত্র খুঁজতে থাকে। একান্ত যদি কিছু খুঁজে না পায়, তারা রাত্রে বেলা আরজ আলীদের পুকুর থেকে জাল ফেলে মাছ ধরে। একদিন আরজ আলী মাছ ধরার শব্দ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে যেইনা অন্ধকারে চোর ধরতে গেলো। তখনই হলো হিতে বিপরীত, মুখে গামছা জড়ানো ৫-৬ জন যুবক ছেলে আরজ আলীকে উল্টো ধাওয়া করলো। চল্লিশোর্ধ আরজ আলী মাছের মায়া ছেড়ে দিয়ে হাফাতে হাফাতে বাড়ির দিকে দৌড়াল। দিন যেতে যেতে অবস্থা এমন হলো যে, এ ফেতনা সে ফেতনায় রসুলপুরে তাদের বসবাস করা একরকম দুর্বিষহ হয়ে উঠলো।
এরই মধ্যে হঠাত করে একদিন সিঙ্গাপুর থেকে হাসান ফোন করে আরজ আলীকে বলে— আব্বা, শহরে বাড়ি করার চিন্তা ভাবনা করো, সামনে আমি বিয়েশাদী কল্লি ওখানে থাকা যাবি না। গ্রামের মানুষ টিকতি দেবে না।
ছেলের এই কথায় আজন্ম গ্রামে থাকা আরজ আলীর মনেও শহরে বসবাসের প্রচণ্ড লোভ জন্মায়। পরে সে রাত-দিন, ঘুম খাওয়া বাদ দিয়ে মনে মনে শুধু আটতে থাকে, এইখানের জায়গা-জমি বিক্রী করে শহরে বাড়ি করবে। কিন্তু আরজ আলীর এই আইডিয়া যখন তার বৌ ছাড়িয়ে মা রাশিদা বানুর কানে পৌঁছালো। তখন যেন বাড়ি বিক্রির আইডিয়া হঠাৎ করেই মাটিতে গেঁড়ে গেল। রাশিদা বানু ছাফ ছাফ জানিয়ে দিলেন— এই বাড়ি কোনমতেই ব্যাচা যাবেনা, ইডার সাতে আমার জান পরাণ মিশে আছে। এই অলুক্ষনে বুদ্দি কোথায় পালি তুই, তোর আব্বার আত্মা তো কষ্ট পাবি।
মা মান্য করা আরজ আলী বোকার মতো চুপ করে থাকে। ওদিকে পুকুর পাড়ে গোরস্থানে শুয়ে শুয়ে রোস্তন মিয়া একটু হলেও মনে সস্তি ফিরে পায়, রাশেদা বানুর কথার পরে খুব সন্তুষ্ট হয় সে। রোস্তন মিয়ার মনে পড়ে বেঁচে থাকাকালীন সময়ের একটি ছবির মতো সংসারের কথা, একটি মাটির ঘর ছিল, ভাইবোনহীন আরজ হাফপ্যান্ট পরে ধুলোর উঠোনে খেলাধুলা করতো প্রতিদিন। ররোস্তন মিয়া সন্ধ্যের সময় হাঁট থেকে ফিরে আদর করে আরজকে তুলতে যেত, তখন আরজ জেদ করে কাঁদতো। রাশিদা বানু ছেলের পরে দরদ দেখিয়ে বলত— থাক, ওর যখন উঠতি মন চায় ও ওঠপেনে। ফাউ কান্দায়ে না।
রোস্তন মিয়া আবারো ধুলোয় ছেড়ে দিতো আরজকে। সাদাকালো এ্যালবাম মনের উপরে ভেসে এলে চোখের কোণে পানি জমে যায় মৃত রোস্তন মিয়ার।
||তিন||
ঠাণ্ডা আবহাওয়া চারিদিক, শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে, এমন এক সকালে রোস্তন মিয়া কাউকে দেখতে পাচ্ছে না বাড়ির ভেতরে। কোথায় তার ছেলে আরজ? বা কোথায় তার প্রিয় স্ত্রী রাশিদা বানু? নিজে মৃত বলে কাউকে ডেকেও জিজ্ঞেস করতে পারছে না ছেলে বৌয়ের কথা, ফলে তার খুব খারাপ লাগতে শুরু করেছে এখন। হঠাত বাড়ির পেছনের দিকে তাকাতেই সে চমকে উঠলো, আরজ আলীর সাথে আরো দুই-তিন জন লোকের কী যেন জায়গা-জমি বিক্রির কথা চলছে! তার মানে কি শেষ পর্যন্ত আরজ আলী, রাশিদা বানু এই মৃত রোস্তন মিয়াকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে শুরু করেছে! আর যাদের কোনদিনও দেখেনি, চেনেনি। তারা রোস্তন মিয়ার কবর ভেঙ্গে তার উপরে ঘরদোর তুলবে। অসহায় রোস্তন মিয়া পলকহীন দৃষ্টিতে শুধু মাথার উপরের মাটিটুকু দেখতে থাকে, নিজ কবরটার অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আতংক নিয়ে...!
♦
আবু উবায়দাহ তামিম
খুলনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন