নাদিয়া জান্নাত -এর গল্প

আমি একজন যুদ্ধাপরাধীর সন্তান
নাদিয়া জান্নাত


   কাজটা যতটা জটিল হবে ভেবেছিলাম ততটা জটিল হলো না। কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই শেষ হলো। মাত্র কয়েক মিনিটেই একটা জলজ্যান্ত মানুষকে মারা সহজ বিষয় না। তবে বাবা নিজেই কাজটা সহজ করে দিয়েছেন। দিয়েছেন বললে হয়তো তাকে সম্মান জানানো হবে। আমি চাই না এই মানুষ রুপী পশুটা কোন ভাবে আমার কাছ থেকে সম্মান পাক।
   আমি দিয়া। আমার বাবার একমাত্র সন্তান। বাবা মসজিদের ঈমাম। সবাই তাকে দূতের মতো ভালোবাসে, সম্মান করে। এই পবিত্ররূপী পাপিষ্ঠ লোকটার পিছনের ইতিহাস সবার অজানা।
   সময়টা ছিল ৭১ এর মাঝামাঝি। হানাদার বাহিনীদের সাথে বাবার সম্পর্ক টা ছিল মাঝামাঝি ধরণের। একদিন কমান্ডার সাহেব আমাদের বাড়িতে এলেন।তাকে দাওয়াত করা হয়েছিল। কচি মুরগির তরকারি, সাথে বোরহানী। তৃপ্তি নিয়ে খেলেন কমান্ডার সাহেব। এরপর দেখতে চাইলেন আমার রূপবতী তরুণী মাকে।
   ...এরপর প্রায়ই তিনি আসতেন আমাদের একতলার বাড়িতে। মা এসব পছন্দ করতেন না। কিন্তু উপায় নেই। বাবার সঙ্গে তর্ক আর যুক্তিতে পেরে উঠলেন না মা। তর্ক, যুক্তি...পাল্টা যুক্তি। অবশেষে বাবার হাতের বলিতে রূপান্তর। 
   আমার বয়স তখন ছয়। সবকিছুই আমার চোখে ঝাপসা। তবে মনে আছে, একদিন আমার নরপশু বাবা কমান্ডারের হাতে তুলে দিলেন আমার রূপবতী তরুণী মাকে। কমান্ডারের গাড়ির পিছে আমি দৌঁড়িয়েছিলাম দিশাহারার মতো।
   ওরা আমার মাকে চেয়ারে বসালো। তারপর আরো কতকগুলো পশু এসে এমন ভাবে আমার মাকে নিয়ে...। অবশেষে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো। কি বিভৎস সব কাহিনী। মায়ের চিৎকারে আকাশ বাতাস সব কেঁপে উঠলো। হঠাৎ এক যুবক এসে তার শার্ট-গেঞ্জি দিয়ে যতটা সম্ভব আবৃত করল আমার মাকে।
   সেদিনের সে যুবককে আর দেখিনি কখনো। শুনেছিলাম তার রক্তে হলি খেলেছিল পশুরা। মা যখন পালিয়ে এলো সেনা ক্যাম্প থেকে,তখন বাবা তাকে আর গ্রহণ করেন নি। এরপর আমার চপলা স্নিগ্ধ মা হয়ে যান প্রতিবাদী। তার একটা যুদ্ধ সন্তানও জন্ম নেয় কিছু দিন বাদে। কিন্তু নিষ্ঠুর সমাজের কাছে সে একঘরে।
   সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়। পাশের বাড়ির রহিমা খালার মেয়ে রত্না আপাকে প্রলোভন দেখিয়ে ভোগ করতে চেয়েছিল পশুটা। এর প্রমাণ এখনো আছে পশুটার ডান হাতে। নিজের সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য বটি দিয়ে কুপিয়েছিল রত্না আপা। বাবার ডান হাতে। বাবা এখন হাফ হাতা শার্ট পড়ে না। পড়ে লম্বা হাতাওয়ালা পাঞ্জাবি। যাতে তার পাপ চিহ্ন সহজে চোখে না পড়ে। যখন কেউ দেখে ফেলে সে কাটা দাগ, তখন সে শুরু করে যুদ্ধের কাহিনী।
   ৭১ এ দেশকে মুক্ত করার জন্য সে নাকি লড়েছিল সেনাদের বিরূদ্ধে। তখনই কেঁটে যায় তার ডান হাত। সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনে সে গল্প, আর গর্ববোধ করে তার জন্য। সমাজে সে এখন পরিচিত মানবপ্রেমী, দেশদরদী, কিংবা মুক্তিযোদ্ধা নামে। যখন সবার মুখে তার জয়গান শুনি, তখন ফ্লাশ ব্যাকে চলে আসে সে সব দিন। যখন মনে হয় আমার শরীরে একটা রাজাকারের রক্ত বইছে তখন ইচ্ছে হয় ক্ষত বিক্ষত করি আমার শরীর। আবার যখন মনে হয় আমার শরীরে একটা বীরাঙনার রক্ত, তখন গর্বে আমার বুকটা ফুলে যায়।
   যুদ্ধের এতটা বছর পরেও আমার পাপী বাবা শাস্তি পেল না। তাই নিজ হাতেই আইন তুলে নিলাম। নিজ হাতেই শেষ করলাম পাপিষ্ঠটাকে। আজ নিজেক অনেক বেশি পবিত্র মনে হচ্ছে। আমার মা কিংবা রত্না আপা যা পারেন নি তা আমি পেরেছি। এখন আমার পনেরো বছরের মেয়ে পানকৌড়ী বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে, ওর মা নিজ হাতে একটা যুদ্ধাপরাধীর বিনাশ করেছে।
   হয়তো একটু পরে খুনের অপরাধে আমার বিচারকার্য শুরু হবে। এ নিয়ে আমার কোন কষ্ট নেই। আমার চোখে আনন্দের জল। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য আমি দেয়াল ভেঙেছি। ওদের বেড়ে ওঠার জন্য্য সবুজ পৃথিবী প্রয়োজন। যেখানে নিশ্চিন্তে ওরা দম নিয়ে বাঁচতে পারবে।

নাদিয়া জান্নাত
রংপুর। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন