মৌনতার গল্প
লোকটি হাঁটে । বিষণ্ন, শ্লথ পায়ে । তার হাঁটার ভঙ্গি জানান দেয় এই যে হেঁটে চলা তার, জীবনকে বয়ে চলার এই যে বিড়ম্বনা তাতে সে বিরক্ত, ক্লান্ত । তার উদাস, নির্লিপ্ত, ক্লান্তিকর এই হেঁটে চলায় মনোবেদনায় কুঁচকে যাওয়া এবড়ো থেবড়ো পথ অযথাই বাঁক নেয় আরও, আরও বেশি এঁকেবেঁকে চলে । পথের দু'পাশের দৃশ্যগুলো কান পেতে শোনে লোকটির এই ক্লান্তিকর পদধ্বনি । যেন লোকটির দুঃখে সমবেদনা জানাতেই দৃশ্যগুলো কেঁপে কেঁপে ওঠে, হাওয়ায় কি এক ফিসফিসানি ছড়িয়ে দিয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের মগ্নতা গুঁড়িয়ে দেয় ।
লোকটি একমনে হেঁটে চলে । কোনোদিকে না তাকিয়ে, মাথা নিচু করে লোকটি হাঁটে । কিংবা আসলে পথই হেঁটে চলে, লোকটি দাঁড়িয়ে থাকে নির্বাক । লোকটির শরীরে শস্তা একটি শাল জড়ানো । শালের নিচে কি আছে ঠিক বোঝা যায় না । তবে গলার কাছে নাক বের করে থাকা কলারটা থেকে অনুমান করা যায় হয়তো লোকটির শরীরে, শালের নিচে একটি মেটে হলুদ রঙা গেঞ্জি । লোকটির এক হাতে একটি বুড়োটে লাউ । সেও লোকটির মতই বিষণ্ন, নেতানো । সবুজ রঙটা জ্বলে যাওয়া, বয়স্ক শরীরে তার খসখসে, শক্ত চামড়া । যে দামে সে বিকিয়েছে লোকটির কাছে তাতে তার চেয়ে কচি লাউ এ বাজারে মেলে না । সে কারণে লাউটিকে বেশ নির্লজ্জের মতোই ঝুলতে দেখা যায় লোকটির হাতে । নিজের প্রায় শুকনো, খড়খড়ে বোঁটাটি লোকটির হাতে গুঁজে দেয়ার আনন্দে সে বেহায়ার মতো দোলে । তার সে দুলুনি অগ্রাহ্য করেই লোকটি হেঁটে চলে । তার হাতে লাউ নয় কোনো । একটি গল্প, একটি জীবনের ক্লান্তিকর, গ্লানিময় বয়ে চলা । যে জীবনে শুধু অপ্রাপ্তির অবসাদ, বঞ্চনার কথকতা, অতৃপ্তির ঢেঁকুর ওঠা । লোকটি হাঁটে । কিংবা লোকটি দাঁড়িয়ে থাকে । পথ হেঁটে যায় । পথ হাঁটিয়ে নেয় লোকটিকে, লোকটির হাতের মুঠোয় থাকা লাউটিকে বয়ে নিয়ে যায় পথ । পথ, লোকটি, তার হাতের মুঠোয় থাকা লাউ, চারপাশের দৃশ্যাবলি ও অবয়ব এই সবকিছু আটকে থাকে আর একটি কঠিন, কঠোর মুঠোর মধ্যে । সময় । মুঠো একটুও আলগা না করে, সমস্ত নিজের শক্ত থাবায় আটকে সে বয়ে চলে । বাকি সমস্ত দাঁড়িয়ে থাকে অবিচল, স্থির । সময় বয়ে চলে, আপন মনে সে হাসে, কাঁদে । মুঠোয় থাকা জড় পদার্থগুলোর জন্য করুণায় কেঁপে কেঁপে ওঠে । লোকটি সে কাঁপনকে ভাবে জীবন, পথ ভাবে বয়ে চলা, লোকটির হাতের লাউটি ভাবে বিকোনো ।
লোকটি তবু হাঁটে, পথ বয়ে চলে, লাউটিও লোকটির হাতের মুঠোয় গলে গিয়ে দুলতে থাকে, সময়ের পেন্ডুলাম । লোকটি মনে মনে ভাবে আর সে ফিরবে না কোথাও, কোনোদিন । কোনো গন্তব্যে সে পৌঁছবে না আর । মাথা নিচু করে, আনমনে সে হাঁটে । তার পরনে ময়লাটে, কালচে একটি লুঙ্গি । একহাতে বুড়োটে একটি লাউ, অন্য হাত অদৃশ্য লোকটির । আছে কি নেই বোঝা যায় না । হয়তো শালের নিচে লুকোনো । অথবা নেই । লাউটি নিয়ে লোকটির এই পথ চলা জানান দেয় তার একটি গন্তব্য আছে, সেখানে কেউ একজন অথবা কয়েকজন অপেক্ষায় আছে যাদের কাছে লাউটি অর্থবহ । যে বা যারা অপেক্ষায় আছে হয়তো তারা অভুক্ত অথবা অর্ধভুক্ত । লাউটির চেহারা সে কথা বলে । লোকটির হাঁটার ভঙ্গি, পরনের পোশাকও তেমন স্বাক্ষ্য দেয় । কিন্তু লোকটির হাঁটার মধ্যে যে বিষণ্নতা, যে মন্থরতা, যে অনিশ্চয়তা তাতে একথা স্পষ্ট যে লোকটিকে তার গন্তব্য আকর্ষণ করে না । কিংবা গন্তব্য লোকটির শরীরকে হয়তো টানে, টেনে নেয়, কিন্তু লোকটির মনকে তা টানে না । লোকটি তাই এক অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে পড়ে পথ চলে নিরুপায়, নিষ্প্রাণ । সময় তাকে বাধ্য করে সেই অনাকর্ষক গন্তব্য বরাবর হেঁটে যেতে । লোকটিও হেঁটে যায়, যন্ত্রের মতো, বোধহীন । হাতে দোলে বুড়োটে লাউয়ের শরীর । একটি গল্প, কিংবা অনেকগুলো গল্প । দোলে সময়ের পেন্ডুলাম । বুক বিছিয়ে দিয়ে পথ তাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয় । কাঙ্ক্ষিত হোক বা না হোক । তারপর সময় তার ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় । পাগলা ঘণ্টা । পেন্ডুলামের দুলুনি থেমে যায় । লোকটি দেথে পথ ফুরিয়ে যায় হঠাৎ । মৌনতার ভেলায় চড়ে সে হেঁটে এসেছে এতক্ষণ যে পথ, বয়ে এনেছে হাতের মুঠোয় যে সময়ের পেন্ডুলাম অথবা একটি লাউ কিংবা একটি বা কয়েকটি গল্প তা হঠাৎ করে নাই হয়ে যায় । অদ্ভুত এক শূন্যতায় সে দাঁড়িয়ে যায় । যেখানে সামনে বা পেছনে, ডানে বা বামে কেউ নেই, কিছু নেই । সময় নেই, সময়ের পেন্ডুলাম নেই, বুড়োটে কোনো আটপৌড়ে লাউ কিংবা এক বা একাধিক কোনো গল্প নেই । লোকটি অবাক হয় । নির্লিপ্তির কুয়াশা চিরে তার ক্ষয়াটে, বিষণ্ণ মুখে, চোখে ভেসে ওঠে নিখাদ বিস্ময় । জেগে ওঠে অভূতপূর্ব ভয় । পথ, যে তাকে নিয়ে এলো এই অদ্ভুত শূন্যতায়, অথবা সে ই পথ বেয়ে চলে এলো যে অপার্থিব নির্জনতায়, কোথায় সে পথ? কোথায় আর আর সবাই? লোকটির হঠাৎ কতিপয় মুখ মনে পড়ে, হঠাৎ যেন লোকটির সামনে ভেসে ওঠে স্পষ্ট, স্বচ্ছ একটি আয়না । সে আয়নায় লোকটি প্রতিবিম্বিত হতে দেখে কয়েকটি মুখাবয়ব । লোকটির হঠাৎ মনে হয় মুখগুলো কোনো একদিন বড় প্রিয় ছিলো তার, বড় আপনার । লোকটি হঠাৎ নিজের মধ্যে তীব্র এক কম্পনানুভব করে । তার মনে হয়, আয়নায় প্রতিবিম্বিত ঐ মুখগুলিকে সে কোনো একদিন বড় ভালোবেসেছিলো । অথবা ঐ মুখগুলি তাকে । অথচ জানানো হয়নি । কিংবা জানানো হয়েছিলো, গুরুত্বটা বোঝা যায়নি । মনে হয় ঐ মুখগুলির কিছু প্রত্যাশা ছিল তার কাছে, তারও ছিলো কিছু, ঐ মুখগুলির কাছে । হয়নি । পুরণ হয়নি সে সব । বোঝা যায়নি সবটা । লোকটিকে হঠাৎ করে কেউ যেনো তীব্র তাগাদা দেয় ফিরে যাওয়ার । লোকটির মনে হয় তীব্র কোনো আকর্ষণ লোকটিকে পেছন থেকে টানে । লোকটির মধ্যেও ততক্ষণে আকাঙ্ক্ষার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে, তছনছ করে দেয় তার নিরাসক্তির দেয়াল, গুঁড়িয়ে দেয় তার নিস্পৃহতার অবরোধ । লোকটি পা বাড়াতে চায়, হাতের মুঠোয় পুনরায় নিতে চায় সময়ের সেই পেন্ডুলামটি, একটি বুড়োটে লাউ অথবা একটি বা কয়েকটি গল্প । কিন্তু ততক্ষণে শূন্যতা তার জালে আটকে নিয়েছে লোকটিকে । লোকটি সবিস্ময়ে দেখে, সামনে, পেছনে, ডানে, বামে, উপরে, নিচে অনন্ত শূন্যতা ঢেউ ভাঙে কেবল । সময় আলগা করে নেয় তার মুঠো । লোকটি ছিটকে পড়ে সময়ের মুঠো থেকে । আয়নায় প্রতিবিম্বিত মুখগুলো মুছে যায় । লোকটির কানে হঠাৎ কিছু একটা ভাঙার শব্দ বাজে । প্রবল বিস্ময়ে লোকটি দেখে কেউ নেই, কিছু নেই । হঠাৎ করেই লোকটির মনে হয়, নেই, সে নিজেও নেই কোথাও আর । অন্ধকার, নাকি শূন্যতা ঠিক বোঝে না লোকটি, শুধু বোঝে কিছু একটা তাকে টেনে নেয় । আর তখনই লোকটির মনে হয় সে আসলে কেউই ছিল না কোনোদিন । এই মুহূর্তটুকু, এই অন্ধকার বা শূন্যতা এই ই সত্যি, আর যা ছিল বলে ভেবেছিল সে, এমনকি ‘সে’, ‘নিজে’ ইত্যাদি যে বোধ তাও এক চরম ভ্রান্তি ও ভুল । বর্তমান এই অবস্থাটুকুই সমস্ত ভাবনার সূচনা ও শেষ । লোকটি অতঃপর থেমে যায় । বুঝে যায় মূলত তার আর কোনো গন্তব্য নেই । কোনো গল্প নেই । সমস্ত ছেড়ে গেছে তাকে । এমনকি তার গ্লানিময় জীবনের বাহক, কায়ক্লেশে যে এ পর্যন্ত বয়ে এনেছে ‘লোকটিকে’, সে শরীরটাও । লোকটি অবশেষে একটি দীর্ঘশ্বাসে মিশে যায় । অথবা মস্ত একটি দীর্ঘশ্বাসই আদতে গিলে নেয় লোকটিকে লহমায় । অদ্ভুত নীরবতা গ্রাস করে নেয় লোকটিকে । অচেনা এক নির্জনতার সমুদ্রে ডুবে যেতে যেতে লোকটি টের পায় ভুল একটি ঢেউ তাকে ছুঁড়ে দিয়েছিল অর্থহীন এক শব্দ জগতে । অন্য আরেকটি ঢেউ তাকে টেনে নেয় পুনরায় । শূন্যতা ঢেউ তুলে যায় । অন্ধকার ডানা মেলে দেয় । সমস্ত স্থির, অবিচল । গল্প বয়ে চলা লোকটি ক্রমশ নিঃসীম এক গল্পে মিশে যায় । অথবা গল্প হারিয়ে যায় লোকটির আড়ালে । কেউ নেই, কেউ কোথাও নেই । শূন্যতা আছড়ে পড়ে শূন্যতার শরীরে । শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ে ঢেউ ঢেউ শূন্যতার সমুদ্রে । অতঃপর শুরু হয় শূন্যতার কথকতা, অসীমের গল্প । গল্প চলে নিরন্তর, অবিরাম । মৌনতা বলে যায় লোকটির গল্প, অসীমের গল্প ।
©লেখিকা : শিল্পী নাজনীন, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন