ক্রুশবিদ্ধ যিশু ও এক চোরের গল্প
চোখে ঘুম নিয়ে বাবার ব্যথাকাতর মুখের দিকে করুণ চেয়ে থাকে নীতু। খুব কষ্ট হয় তার। বাবাকে এমন করে কখনো কাঁদতে সে দেখেনি। আচমকা বাবার অস্ফুট কাতরানিতে ঘুম ভেঙে সে দেখছে বাবার মাথা দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে। প্রবল আতঙ্ক আর বিস্ময়ে সে তার অদ্ভুত সুন্দর দুটি বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে। ভয়ার্ত গলায় বলে— 'তোমার কী হইচে বাজান? তোমার মাথা দিয়ে রক্ত পড়তাচে ক্যা?'
'কিচু অয় নাই রে মা! কিচু অয় নাই! পইড়া গিচি, পইড়া গিয়া দরদ পাইচি! চোট পাইচি মাথাত!'— নীতুকে শক্ত করে একহাতে বুকের সাথে আঁকড়ে অন্যহাতে নিজের মাথাটা চেপে রেখে জবাব দেয় বিলু। অদূরে আম্বিয়া রাগে গজগজ করতে করতে উঠোনের কোণায় মাথা তোলা গাঁদাফুলের গাছ থেকে একমুঠি পাতা ছিঁড়ে দারুণ ছন্দ তুলে পাটায় রেখে শিল দিয়ে বাঁটে। মধ্যরাতে শিলপাটার এই তুমুল নিনাদ চিরে দেয় রাত্তিরের মগ্ন নিস্তব্ধতা, ধ্যানী মৌনতা। কুপির ম্লান আলো আম্বিয়ার মুখে পড়ে, তার নাকফুলটা সে আলোয় চিকচিক করে ওঠে। বুকের মধ্যে ধ্বক করে ধাক্কা লাগে বিলুর। আর কতদিন জ্বলবে আম্বিয়ার নাকের ঐ জ্বলজ্বলে নাকফুলটা? আজ একটুর জন্য সে ফিরতে পেরেছে প্রাণ নিয়ে, ইটটা ঠিকমত এসে পড়েনি তার মাথায়, নইলে…
মাথার চুল সরিয়ে, রক্তে লেপ্টে যাওয়া চুলগুলো যত্নে হাত দিয়ে উল্টে আম্বিয়া গাঁদা পাতার রস লাগিয়ে দেয় তার মাথায়, বাঁটা পাতা ঘন করে লাগিয়ে দেয় ক্ষতে। রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায় আস্তে আস্তে। 'যেমন আকাইম্যা মানুষ, তেমন তার শাস্তি!'— রাগত, গম্ভীর কণ্ঠে স্বগতোক্তি করে আম্বিয়া। তার কণ্ঠে লুকোনো উদ্বেগটুকু ঢাকা পড়ে না তাতে। সে তবু নির্লিপ্তি কণ্ঠে ঢেলে বিলুকে প্রশ্ন করে— 'দরদ কুমচে ইকটুও?'
—'হয় কুমতাচে, কুইম্যা যাইবো, চিন্তা করিছ না।'
'আমার আর খ্যায়া কাম নাই, উনার আকাইম্যা দরদ নিয়্যা চিন্তা করতাচি!'— বলেই কুপিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় সে। নীতুকে একটানে নিজের দিকে নিয়ে বিছানায় যায়। শুয়ে পড়ে। নীতু মৃদু আপত্তি করতেই বলে ওঠে— 'শুইয়া পড় হারামজাদি! রাইতদুফুরে বাপের লগে সোহাগ করন লাগতো না আর!'
আর কোনো উচ্চবাচ্য করে না নীতু। শুয়ে পড়ে আম্বিয়ার গা ঘেঁষে। বাবার জন্য খুব চিন্তা হয় তার। বাবার মাথা দিয়ে গলগল করে নামা রক্তের স্রোত তাকে কাতর করে তোলে। তার ইচ্ছে করে বাবাকে জড়িয়ে, তার কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে সে বসে থাকে, বাবার ঘামে ভেজা শরীরের গন্ধটা নাক দিয়ে টেনে নেয় আশ্লেষে। কিন্তু মাকে বড় ভয় করে সে। মা'টা খুব রাগী তার। কথা না শুনলেই চুল টেনে ধরে ইচ্ছেমত মারে। তাই সে ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে শুয়ে শুয়ে বাবার রক্তে ভেজা মুখটা কল্পনা করতে থাকে। ঘুমিয়েও পড়ে এক সময়। ঘুমের মধ্যে সে ফুঁপিয়ে ওঠে, ভয় পেয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে। আম্বিয়া বুকের মধ্যে টেনে নেয় মেয়েকে, চোখ বেয়ে জল গড়ায় তার। অন্ধকারে কেউ দেখে না সে জল। বিলু দরজা খুলে বাইরে, অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকে। ঘুম আসে না তার। মাথার ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ছে, আম্বিয়াকে বলেনি সে। বললে আরও রাগ করবে আম্বিয়া, মাঝরাত্তিরে শুরু করবে তুমুল চেঁচামেচি।
বারান্দার পৈথানে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে বিলু। অন্ধকার রাত নিকষ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে বিলুর অবসন্ন, ক্লান্ত, অভুক্ত, অসুস্থ শরীরের দিকে। ঠোঁট টিপে বিদ্রুপ করে হয়তো, হয়তো সে হেসে ওঠে খলখল বিলুর এই বিপর্যয়ে, এই ভাগ্যের হাতে লাথি খাওয়া, পরাজিত, আহত বিলুর চোখে চোখ পড়ে তার চোখে হয়তো নেচে ওঠে নিখাদ কৌতুক। বিজলির চমকে সে জানান দেয় তার সে আমোদ। ভাদ্রের গরম নেই আজ। সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি নেমেছে টিপ টিপ টিপ। বেশ ঠাণ্ডা নেমেছে সেই সাথে। গ্রামের খেটে খাওয়া, নিরন্ন, অভাবী মানুষগুলো প্রচন্ড গরমের পর হঠাৎ নামা এই আয়েশি শীতলতায় আচ্ছন্ন, বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সন্ধ্যা নামতে না নামতেই। সুযোগটা নিয়েছিল বিলু। অনেকদিন থেকে তার মন্দা যাচ্ছিল দিন। সারাদিনের অবিশ্রান্ত বর্ষণে অতিষ্ট সে। ভারী বৃষ্টিতে কাজ নেই এখন গ্রামে। তার মত আধা গৃহস্থ, আধা শ্রমিকদের বড় দুঃসময় এখন। এসময়ে গ্রামের মানুষের হাতে টাকা থাকে না। কাজে নিতে চায় না কেউ। না কেউ ক্ষেতের কাজে ডাকে, না গৃহস্থালির কাজে। ধার দেনা করে, মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা এনে সে অনেকদিন হলো পেট চালাচ্ছে ইদানিং। এনজিও থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি দিতে না পারায় বাড়িতে এসে তাগাদা দিচ্ছে তারা অনেকদিন। আম্বিয়ার পোষা ছাগল আর মুরগি বেচে খাওয়া হয়ে গেছে ঢের আগে। অতঃপর হতাশ, নিরুপায় বিলু প্রায় ভুলে যাওয়া পিতৃপুরুষের পুরনো পেশাটাই আরেকবার ঝালিয়ে নিতে চেয়েছিল বাধ্য হয়ে। অনেকদিন থেকে তক্কে তক্কে ছিল সে। কিন্তু সুযোগ মিলছিল না তার। ভাদ্রের তালপাকানো এই গরমে রাতে মানুষের ঘুম বড় হালকা। এই সময়ে তাই সে ভরসা পাচ্ছিল না ঝুঁকিটা নিতে। হঠাৎ আজ আবহাওয়াটা অনুকূলে ছিল খুব। সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি নেমেছিল অঝোরধারায়। গরমটাও ছিল না আজ। শীত শীত করছিল বেশ। সন্ধ্যার পর পরই সুনসান নীরবতা নেমেছিল পুরো গ্রামে। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ঘুমিয়ে পড়েছিল গ্রামটা নিশ্চিন্তে। বিলু জেগে ছিল উত্তেজনা আর আগ্রহে অধীর হয়ে। নীতু আর আম্বিয়া ঘুমিয়ে পড়লে সে পুরনো চাদরটা মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল অবশেষে। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার ছিল আজ। নিজের হাতটাও দেখা যায় না ঠিকমত। এসব কাজ সে ছেড়ে দিয়েছে অনেকদিন। তবু বছরের এই মন্দা সময়টাতে যখন অন্যকোনো কাজ থাকে না হাতে, পেটের দায়ে তাকে মাঝে মাঝে নামতে হয় আবার এই পুরনো পেশায়। তার বাপের বেশ নামডাক ছিল এ পেশায়। তার বাপের নামে গ্রামে বেশ জল্পনা কল্পনা চলে এখনো। গ্রামের লোকেরা তার বাপকে বলতো ট্যাংরা চোরা! এমন অদ্ভুত নামকরণের কারণ অবশ্য জানা নেই বিলুর। তবে চুরিতে তার বাপের দক্ষতা ছিল প্রবাদসম। চুরিতে তার বাপ ট্যাংরা চোরাকে কেউ কখনো ধরতে পারেনি। শোনা যায় সে নাকি কুফুরি মন্ত্র শিখেছিল। তাকে ধরার চেষ্টা করলে সে পাখি হয়ে ফুরুৎ করে উড়াল দিতো! পালিয়ে যেতো মুহূর্তেই! পুলিশও কখনো যুত করতে পারেনি তার বাপের সাথে। এহেন কিংবদন্তিতুল্য বাপের নিতান্তই অপোগণ্ড, অপদার্থ ছেলে বিলু। স্কুলে সে কয়েক ক্লাস পড়ার চেষ্টা নিয়েছিল, সেখানে ট্যেংরা চোরার ছেলে বলে বহুত লাঞ্চনা, গঞ্জনা ও অপমান সইতে হতো তাকে। তার বাপ পুত্রের এই অপমান বরদাস্ত করতে তীব্র আপত্তি জানিয়ে তার স্কুলগমন বন্ধ করেছিল। বিলুরও বড় আপত্তি ছিল না তাতে। খসখসে বইয়ের পাতা আর তারচেয়ে খটমটে ঐ পড়াগুলোর প্রতি কোনো অনুরাগ ছিল না তার। স্কুলের শিক্ষকগুলোও ছিল হাড় বজ্জাত! কথায় কথায় ট্যাংরা চোরার পোলা বলে খোঁটা দিতো তাকে, হাসি ঠাট্টা করতো। ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল আরো এককাঠি বাড়া। ফলে স্কুলে আর যেতে হবে না— এই পিতৃআজ্ঞা খুশিমনেই মেনে নিয়েছিল সে। তার ছিল রাতবিরাতে ঘোরার নেশা। দূর গ্রামের এক বংশিবাদকের কাছে তালিম নিয়েছিল সে। বেশ ভাল বাজাতো। কিন্তু সংসারে টিকতে গেলে ঐ একমাত্র বাঁশি বাজাতে পারার গুণটি তেমন কোনো কাজে যে আসে না সে কথা সে বুঝেছিল হুট করে ট্যেংরা চোরার পটল তোলার মধ্য দিয়ে। একমাত্র বোন আর মাকে নিয়ে যেন অকূল সমুদ্রে পড়েছিল সে। মাথার বাবড়ি চুলে উকুনের উৎপাত অগ্রাহ্য করে সে জীবনযুদ্ধে যোগদান করেছিল অতঃপর। মানুষের বাড়িতে সে জন খাটতো । নিতান্তই দিন আনি দিন খাই অবস্থার মধ্য দিয়ে সে ছোটবোন মাছুমাকে পাত্রস্থ করেছিল। বাপ ট্যাংরা চোরার সুনাম ঢাকতে বেশ কিছু নগদ অর্থের বিনিময়ে তবে সে মাছুমাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও পরে জেনেছে মাছুমার শ্বশুরবাড়ির সুনামের কাছে ট্যাংরা চোরার সুনাম ভারি নস্যি। মা মরে যাওয়ার পর সে আম্বিয়াকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে, নীতু এসেছে। নীতুর বয়স এখন আট। এখনও সে মানুষের বাড়িতে জন দিয়ে, কামলা খেটে দিনাতিপাত করে। কিন্তু এইসব বাদলা দিনে, যখন আর কোনো কাজ জোটে না কপালে তখন ট্যাংরা চোরার উত্তরসূরী হিসেবে সে ছোটবেলায় বাপের কাছে শেখা বিদ্যের কিছুটা ঝালাই করতে বের হয়ে পড়ে নিতান্তই বাধ্য হয়ে। যদিও বাপের সুনাম সে আজ পর্যন্ত রাখতে পারেনি। আম্বিয়ার ভারী রাগ তার উপর। সে বিলুর এই অক্ষমতা ক্ষমা করতে রাজি নয়। সে বলে যে কাজ পারে না বিলু তা কেন করতে যায় সেধে। তারচে বরং শহরে চলুক তারা, সেখানে কাজের অভাব নেই। আম্বিয়া তেমনই বলে আজকাল। বিলু ধ্বন্দে আছে। মাঝে মাঝে তারও ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যায় সে শহরে। সেখানে গিয়ে কোনো একটা কাজে লেগে পড়ে। একমাত্র স্ত্রী, কন্যার অনাহারি মুখ দেখতে ভালো লাগে না তারও।
চাদরটা ভালভাবে শরীরে মুড়ে, মুখচোখ বেশ করে ঢেকে সে বের হয়েছিল অতঃপর। গন্তব্য পাশের গ্রামের সাজাহান মোল্লার বাড়ি। হাড়বজ্জাত লোক, কিপটের কিপটে। কোনোদিন কারও হাতে কিছু দেয়নি। পালা-পার্বণেও কখনো তার বাড়িতে পাত পড়ে না কোনো গরিবের। অথচ দিন দিন অবস্থা কেমন ফুলে ফেঁপে উঠছে তার! যখন ফুলবাবুটি সেজে বাইক হাঁকিয়ে রাস্তায় বের হয় কে বুঝতে দেখে যে এমন কৃপণ লোকটা। বিলুর বহুদিনের ইচ্ছে লোকটার বাড়িতে গিয়ে বেশ বড়সড় দাঁও মারবে একদিন। যেন অনেকদিন আর খাওয়া পড়ার চিন্তা না করতে হয় তাকে। ওই ভুঁড়ি উঁচু, হুঁৎকো লোকটাকে দেখলেই কেমন অস্বস্তি হয় বিলুর। কুঁতকুঁতে চোখে যখন তাকায় বিলুর দিকে বিলুর মনে হয় লোকটা যেন তার মনের ভেতরে লুকিয়ে রাখা বহুদিনের মতলবখানা বুঝে ফেলেছে! মনে হয় এই বুঝি চেঁচিয়ে উঠবে, বলবে, চোর! চোর! ধর! ধর!
অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকায় বিলু। আকাশ অন্ধকার। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। বেশ পা টিপে টিপে পথ চলতে হয় তাকে। মাটির কাঁচা রাস্তাটা ভয়ানক পিছল। কাদাময়। একটু অসাবধান হলেই আছাড় খেতে হবে তাকে। কালো, হাতল ভাঙা আদ্যিকালের পুরনো ছাতাটা মাথায় দিয়ে বিলু পথ হাঁটে। বুকের মধ্যে কেমন একটু গুড়ুগুড়ু করে ওঠে তার, কেমন গা ছমছমে একটা অনুভূতি তাকে আঁকড়ে ধরে। মনের মধ্যে নীতুর কচি মুখটা সাঁতার কাটে, আম্বিয়ার ফর্সা ঘুমন্ত মুখটা ভাসে। কতদিন হলো পেটপুরে খেতে পারে না তারা। কতদিন দু বেলা দু'মুঠো অন্নের যোগান দিতে পারে না বিলু। নিজের অক্ষমতার লজ্জায় নিজেই কাঁটা হয়ে থাকে সে। এবার বন্যায় তিস্তা যেন ক্ষেপে উঠেছে আরো, ভাসিয়ে নিয়েছে সব। ফসলি জমিন সব জলের নিচে, মাঠে কাজ থাকলে তবে তো কাজ পাবে বিলু! অবস্থাপন্ন গৃহস্থদের অনেকেরই বাড়িতে হাঁটু অবধি জল, কারো বা আরো বেশি, এ অবস্থায় গৃহস্থালি কাজেও ডাকছে না কেউ। ত্রাণ নেই, হাতে গোণা দু চারজন যারা স্থানীয় নেতা বা পাতি নেতাদের কাছের মানুষ, তারা পেয়েছে, পাচ্ছে। বিলুর ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি। তার বাড়ির উঠোনে হাঁটু অবধি জল গড়াচ্ছে এখনো। কদিন আগে ছিল বুক সমান। তখন তারা ঘরের চালায়, খোলা আকাশের নিচে ছিল দু দিন, দু রাত। অভুক্ত। শুকনো কয়েক মুঠি চাল আর চিড়ে ভরসা ছিল তখন। এখন কিছুটা কমে এসেছে বন্যার প্রকোপ। জল নেমেছে অনেকটাই।
মোল্লার পাকা উঁচু বাড়িতে জল ওঠেনি তেমন। উঠোন অবধি উঠেছিল, নেমে গেছে আগেই। খুব সাবধানে, পা টিপেটিপে, বিড়ালের মত নিঃশব্দে বিলু বাড়ির প্রাচীর টপকে ঢুকে পড়েছিল ভেতরে। তারপর আরও বেশি সতর্কতার সাথে সে সেঁধিয়েছিল সাজাহান মোল্লার অন্দরমহলে। আগে বেশ কয়েকদিন সে ঘুরঘুর করে গেছে মোল্লা বাড়ির আশেপাশে। চিনে রেখে গেছে কোন ঘরে গেলে সে বড় দাঁও মারতে পারবে। সে অগত্যা খুব সাবধানে মোল্লার শোবার ঘরে ঢুকে পড়ে চাদরটায় মুখ মাথা বেশ করে মুড়িয়ে। শীতল আবহাওয়ায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে বেশ আরামে ঘুমুচ্ছে সাজাহান মোল্লা। ডিম লাইটে স্পষ্ট ফুটে উঠছে তার স্ফিত ভুঁড়ির ওঠা-নামা, নাসিকা গর্জনও চলছে সমানে। বিলুর একবার ইচ্ছে হয় ঘুমন্ত, স্ফীতউদর কৃপণ ঐ বদলোকটিকে ঘুমের মধ্যে ছাতার ভাঙা ডাণ্ডি দিয়ে দু-ঘা কষিয়ে দেয় আচমকা, তারপর দৌড়ে পালায়। কিন্তু নিজেকে সামলে নেয় সে। পাগলামি করার সময় এটা নয়। সে সাবধানে মোল্লার খাট থেকে চোখ সরিয়ে ঘরের অন্যপাশে রাখা সিন্দুকের দিকে তাকায়। ডিমলাইটের ঝাপসা আলোয় সে ধীরে ধীরে সহজাত ভঙ্গিতে এগোয় সেদিকে। সিন্দুকে ঝুলানো বড় লোহার তালাটি খুলে ফেলে অনায়াসেই, কোনো শব্দ ওঠে না তাতে। যা খুঁজছিল পেয়েও যায় সিন্দুকের এক কোণে। পুঁটলি করে রাখা বেশ ক খানা গহনা। কয়েক তোড়া নগদ নোটও পেয়ে যায় সেই সাথে। সেগুলো বগলদাবা করে, সিন্দুক বন্ধ করে বেশ সন্তুষ্ট মনেই স্থান ত্যাগ করছিল বিলু। হঠাৎ কি হলো তার! মোল্লার খাটের লাগোয়া খাটটিতে চোখ গেল। বউটার শোয়া এত বিশ্রি, কে জানতো! ফর্সা শরীরে কাপড় প্রা্য় নাই-ই বলতে গেলে! বড় একটা ঢোক গেলে বিলু। চোখ সরিয়ে নেয় লজ্জায়। সে চোর হতে পারে চরিত্রহীন মোটেই নয়। পাশে মোল্লার ঘুমন্ত মেয়েটি, নীতুর বয়সি। কি মিষ্টি দেখাচ্ছে, যেন নীতু শুয়ে আছে, রাজকুমারীর বেশে। আহা! নীতুকে যদি অমন একটা খাটে শোয়াতে পারতো সে! দীর্ঘশ্বাসটা বুকে চেপেই বের হয়ে আসছিলো বিলু ঘর ছেড়ে। হঠাৎ আবার বিপত্তি। মোল্লার মেয়ের মাথার কাছে কালো একটা কি যেন মাথা তুলে আছে! একটু একটু দুলছে, ফুঁসছে! ভাদ্র মাসের গরম, তার উপর বর্ষাকাল, তেনারা সব বেরিয়ে পড়েছেন, বসত বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন!
বিলু রুদ্ধশ্বাসে দেখছিল তাকিয়ে তাকিয়ে। সে কি চিৎকার করবে? তাহলে জেগে যাবে সবাই, ধরা পড়ে যাবে সে। চলে যাবে? সাপটি ফণা তুলেছে, ছোবল দেবে যে কোনো সময়! তাতে মোল্লার মেয়েটির মৃত্যু সুনিশ্চিত! আর ভাবতে পারে না সে। ছাতার ভাঙা হাতল তুলে সে সজোড়ে আঘাত করে উদ্যত ফণা লক্ষ্য করে। নীরব নিঝুম রাতে হালকা সে শব্দটিই বিকট হয়ে বাজে। নৈঃশব্দে ফাটল ধরে। মোল্লা কে, কে- বলে ধড়মড়িয়ে ওঠে, তার বউও আচমকা শব্দে চমকে জেগে উঠে নিজেকে ঢেকে ঢুকে নিতে ব্যস্ত হয়। অপ্রস্তুত, অসহায় বিলু দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটে দরজা লক্ষ্য করে। ভাঙা ছাতা, থেঁতলানো সাপ চোখে পড়ে না মোল্লার। সে শুধু চোখের কোণা দিয়ে দেখে আবছা একটি কালো ছায়া ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। অভিজ্ঞ চোখ মুহূর্তেই বুঝে নেয় যা বোঝার। সে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে কোমরে লুঙ্গি জড়াতে জড়াতে চেঁচায়— 'চোর! চোর! কে কুনঠে আছিস! ধর! ধর! চোর আসিচে ঘরোত্!'
ছুটন্ত অবস্থায়ই উঠোনের এককোণে জড়ো করে রাখা ইট থেকে সে হাতে তুলে নেয় একটি ইট । অন্ধকারেই মিলিয়ে আসা ছায়াটিকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে সবেগে ।
বারান্দার পৈথানে পা ঝুলিয়ে পানির মধ্যে পা দোলায় বিলু। পুঁটি বা টাকি মাছ হবে হয়তো, কুট্টুস করে কামড়ে দেয় তার পা। সেদিকে বড় মন দেয় না বিলু। সে একমনে চেয়ে থাকে অন্ধকারের দিকে, আকাশের দিকে। আকাশের মতই অন্ধকার ছেয়ে ফেলে তার মন। গহনা বা টাকার তোড়া কোথায় ছিটকে পড়েছে জানে না সে। উপরি পাওনা হিসেবে মাথা ফাটিয়ে এসেছে। চিকিৎসার কোনো প্রশ্নই নেই। সকাল হলে কি খাবে সে প্রশ্নটিই মুখ্য এখন। নীতুর ক্ষুধার্ত মুখ আর দেখতে ইচ্ছে করে না। সে বরং শহরেই চলে যাবে। অন্ধকারে বিলুর ক্ষুধার্ত, চিন্তাক্লিষ্ট মুখটা দেখা যায় না। শুধু হাতে জ্বলন্ত বিড়ির ওঠা নামা টের পাওয়া যায়। বিলুর মুখটা দেখা গেলে বুঝা যেত সে মুখ কোনো চোরের নয়, স্নেহময় এক পিতার। যে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেও বাঁচাতে জানে সন্তানের প্রাণ, ক্ষুধা আর গ্লানিকে অগ্রাহ্য করেও যে মুখে ফুটে থাকে অমলিন এক হাসি, যেন ক্রুশবিদ্ধ যিশু!
♦
শিল্পী নাজনীন
ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন