আল কাফি নয়ন -এর গল্প

অপার্থিব
আল কাফি নয়ন


বিশাল লাইন!

দুইটা সাধারণ বাল্ব নিয়ে একটা সিএফএল এনার্জি সেভিং বাল্ব দেয়া হচ্ছে। ব্যাপারটা সবাই জানে না। তাতেই বেশ লম্বা লাইন পড়ে গেছে। লাইন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে খবরটা আস্তে আস্তে  ছড়িয়ে পড়ছে। খবরটা যে কেমন করে ছড়াচ্ছে? সাধারণত আমাদের দেশের মানুষরা অন্যের ভালো খুব একটা ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। কেউ ফ্রি তে দুইটা বাল্ব পাবে এই খবরটা তারা দায়িত্ব নিয়ে সবার কাছে পৌঁছে দেবে এমনটা হবার কথা নয়, তারা পারলে একাই সব বাল্ব নিয়ে নিত।কিন্তু নিতান্তই উপায় নেই। তারপরও খবরটা ছড়াচ্ছে। হয়তো কেউ বাল্ব নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে এমন সময় কারো সাথে দেখা হল। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, 'ভাই, বাল্ব কই পাইলেন?'
তিনি জবাব দিলেন, 'আর বলবেন না ভাই। অনেক কসরত করে পাইলাম। আমার এক ফুফাতো ভাই আছে ইউনয়ন পরিষদে। সে বহুত ফুসলিয়ে বের করে দিছে। শুনলাম সরকার থেকে লাখকে লাখ বাল্ব আসছে। আসার পথে অর্ধেক গায়েব হয়ে গেছে, বাকি অর্ধেক ইউনিয়ন পরিষদেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে। হা হা হা...'

বাল্ব বিতরনের জন্য একটি স্কুল ঘরকে বেছে নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদেই দেয়া হচ্ছে। অবশ্য ইউনিয়ন পরিষদে দেয়াতে ভিড় একটু বেশি হচ্ছে। যে সব লোক বিভিন্ন ভাতা পায় তারাও তাদের কার্ড নিয়ে চলে এসেছে। লাইনের মাঝখানে  বয়স্কভাতা পায় এমন কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। তাদেরকে পাশের মানুষরা বোঝানোর চেষ্টা করছে যে ,এখানে এই কার্ড দিয়ে কিছু হবে না। কিন্তু তারা কিছুতেই জায়গা ছাড়বে না। একবার যখন এসেছে তখন শেষ দেখেই ছাড়বে। বিধবা ভাতা পায় এমন কয়েকজনও চলে এসেছেন। এরা মনে মনে স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানকে খুঁজছে। কারণ এই ভাতা পাওয়ার পেছনে মেম্বার-চেয়ারম্যানের যথেষ্ঠ হাত রয়েছে। তাদের ধারণা, এই ক্ষেত্রেও মেম্বার-চেয়ারম্যান তাদের সাহায্য করবেন। অন্য এক শ্রেণির লোক দেখা যাচ্ছে, যারা ঠোঁটের কোণে বিড়ি নিয়ে হাঁটাহাঁটি আর মিটিমিট করে হাসছে। মনে হচ্ছে এরা বিশাল আনন্দে আছে। আর ভাবখানা এমন যেন এরা বিশাল নেতা শ্রেণির মানুষ। এরা বাল্ব বিতরন কারিদের বললে হুড়হুড় করে শ’খানেক বাল্ব দিয়ে দিবে। শুধু শুধু লাইনে দাঁড়িয়ে কি লাভ?

সাধারন মানুষ যারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, তারা বিরস মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সবার হাতে বাল্ব। কয়েকজন দশ পনেরোটা বাল্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভিড়ের মধ্যে এমন মানুষও আছে যার বাড়ি তে বিদ্যুত সংযোগ পর্যন্ত নেই। এরা বাল্ব নিয়ে কী করবে বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো কারো বাড়ি থেকে কয়েকদিনের জন্য বিদ্যুত সংযোগ নেবে। কিন্তু বিদ্যুত বিল দেয়ার সময় দেখবে এ এক বড় ঝামেলা। শুধু শুধু কিছু টাকা চলে যাচ্ছে। তখন এরা মহাবিরক্ত হয়ে বিদ্যুত সংযোগ বিছিন্ন করে দেবে। আবার এমনও হতে পারে এরা কারো পক্ষে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত বাল্ব দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন: একজনকে পাঁচটার বেশি দেয়া হবে না  বা এই ধরনের কিছু। তাই হয়ত কেউ বুদ্ধি করে এদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

যারা সাধারন বাল্ব নিয়ে আসতে পারেনি, তাদের বেশি দূরে যেতে হচ্ছে না। পাশেই এক দোকানে বাল্ব পাওয়া যাচ্ছে। সুযোগ বুঝে দোকানদার ত্রিশ টাকার জায়গায় পয়ত্রিশ টাকা দাম হাকাচ্ছে। এদেশে কেউ সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। তাতেও ব্যবসায় ভাটা পড়ে নি । বেচা কেনা বেশ ভালোই হচ্ছে, তবে এত দ্রুত এত বাল্বের জোগান হচ্ছে কোথা থেকে সে রহস্য থেকেই যাচ্ছে। লাইনের আশেপাশে কিছু মানুষ আছে যারা এখনও বুঝতে পারেনি আসলে কি করা উচিত। এরা বেশ সাবধানি ভঙিতে সব দেখে শুনে কাজ করতে চাচ্ছে। অনেকে সিদ্ধানহীন্তায় ভুগছে অন্যকেও ভোগাচ্ছে। এদের মধ্যে থেকে একজন সিদ্ধান্ত নিল যে সে বাল্ব কিনে লাইনে দাঁড়াবে। কারণ তার মনে হচ্ছে যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। সে বাল্ব কেনার জন্য দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। দোকানদার তাকে দেখা মাত্রই বলে উঠল, 'কি হামিদ, বল নিবা নাকি?'
হামিদ বলল, 'দেন দেখি দুইটা বল। লাইনে দাঁড়াই। তারপর আল্লাহ ভরসা।'
দোকানে বেশ ভিড় জমে গেছে। হামিদের দেখাদেখি আরো কয়েকজন সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে চলে এসেছে। এর মধ্যেই একজন মাতাব্বর শ্রেণির মানুষ এসে বলল, 'আমজাদ, আরো দশখান বল দেও তো।'
দোকানদার সবাই কে অগ্রাহ্য  করে তাকে আগে দশটা বাল্ব দিল। এতে বোঝা গেলো দোকানদারের নাম আমজাদ। আর সবাই বল বলতে বাল্ব বোঝাচ্ছে।

হামিদ লাইনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার পিছনে নিমিষেই আরো চার-পাঁচ জন দাঁড়িয়ে গেল। লাইনে ভিড় এখন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। হামিদ পিছনে দাঁড়ানো দু'জনকে গালিগালাজ করছে। কথা শুনে যা বোঝা গেল, পিছনের দু’জন এতক্ষন লাইনে দাঁড়ানোর বিপক্ষে ছিল। তাদের ধারণা ছিল, লাইনে দাঁড়িয়ে এই বাল্ব সংগ্রহ আগাগোড়া একটা অপচয়। কিন্তু এখন তারা দোষ হামিদের উপর চাপাতে চাচ্ছে। হামিদ এই মুহূর্তে লাইনের শেষের দিকে দাঁড়িয়ে আছে। সে বার বার মাথা হেলিয়ে দেখার চেষ্টা করছে আসলে সে কতদূরে দাঁড়িয়ে আছে।

এদিকে আমজাদ বাল্বের দাম বাড়িয়ে চল্লিশ করে ফেলেছে। এতে অবশ্য অনেকেই চটে যাচ্ছে। কারণ তারা অন্যের কাছে দাম শুনে এসেছে। তাদের কথা এই অতিরিক্ত পাঁচ টাকা তাদের কাছে নেই। তারা যত দাম শুনেছে তত টাকাই নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমজাদ সে দিকে কর্ণপাত করছে না। তার এক কথা, 'আমার সাপ্লাই লিমিটেড। দুই টাকা দাম না ধরেলে বউ বাচ্চারে বনবাসে পাঠাতে হবে।'
এর মধ্যে একজন স্থানীয় মেম্বার এসে বললেন, 'কি ব্যাপার আমজাদ? তুমি নাকি বলের দাম বাড়ায় দিছ?'
—ছি! ছি! কি বলেন মেম্বার সাব। দশ বারো বছরের দোকানদারি জীবনে কোন দিন দুই টাকা ধইরা নিছি বলেন?
—কথা ঘুরাও কেন? সোজা কথার সোজা উত্তর দিবা।
—মেম্বার সাব দোষ মাফ দেন। দুই টাকা ধইরা নিছি। নাইলে যে বউ বাচ্চারে নিইয়া বনবাসে যাইতে হয়। ঘাস খাইতে হয়।
—বনবাসে যাইতে হয় যাও। কিন্তু ঘাস খাবা কেন? সেইখানে ফল-ফলাদি আছে, সেই সব খাবা।
—জ্বী মেম্বার সাব, বন-জঙল মানেই ফল-ফ্রুট। আনারস আমি খুব খাই, এই ফল দ্যাশের জাতীয় ফল কেন যে হইল না!'
—আজে বাজে কথা বল কেন?
—আর জীবনে বলব না। দোষ মাফ দেন।
—কথা টা যেন মনে থাকে। এরপর কারো কাছ থেকে দাম বেশি নিলে দোকান করা খরায় দেব। চেয়ারম্যান কে বলে দোকান চাঙে তুলে দেব। খালি বলব, তুই গাঞ্জার দোকান ধরে বসছিস। ব্যাস কেল্লা ফতে।

মেম্বার সাহেব চলে গেলেন। আমজাদ মুখ বাকিয়ে বাল্ব বিক্রি শুরু করলো। আর বলতে লাগলো, 'আমার সাপ্লাই লিমিটেড। মেম্বারের কথা ধরলে আমার চলবে?
আমজাদের মাথায় এখন অন্য চিন্তা। সে মনে মনে নিজের একজন আসিস্ট্যান্ট খুঁজছে। কারণ ভিড় ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। একা হাতে সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমজাদ ভিড়ের মধ্যে কাকে যেন উদ্দেশ্য করে বলল, 'কামাল কই রে?'
ভীড় থেকেই উত্তর এল, 'ইস্কুল গেছে মনে হয়।'
—দেখ তো কই গেছে। আজকের দিন টা যে দোকানে থাকতে হয়।

ভীড়রের সেই লোক কিছুক্ষন পর এক ছেলে কে নিয়ে উপস্থিত হল। সম্ভবত এর নাম কামাল। দশ–বারো বছর বয়স হবে। তাকে যে জোর করে স্কুল থেকে আনা  হয়েছে, এমন না। দোকানে থাকতে হবে শুনে সে নিজেই চলে এসেছে। শ্রেণি শিক্ষককে সে বলেছে, 'প্যাটের বেদনায় জীবন বাঁচে না আপা। আইজ ক্লাস না করি।'
শ্রেণি শিক্ষক বললেন, 'তোমার কি আগে থেকেই সমস্যা নাকি এখন হঠাত?'
—আচমকা হইছে আপা। প্যাটের কোণাত চিকিত কইরা ওঠে। ওমা…
—ঠিক আছে, ঠিক আছে। কিন্তু যাবার সময় হেড স্যার কে  বলে যেতে হবে। চল হেড স্যারের রুমে।
কামাল তার শ্রেণী শিক্ষকের সাথে হেড মাস্টারের রুমে গেল। হেড মাস্টারকে ঘটনা বলা হল। কিন্তু তিনি ছুটি দিতে নারাজ। কারণ আজকে স্কুলে শিক্ষা অফিসার আসবে। হেড মাস্টার বললেন, 'মিস শিউলি আপনি ছেলেটিকে টেক কেয়ার করেন। তাকে কিছু ওষুধ দেয়া যায় কিনা দেখুন।'
মিস শিউলি বললেন, 'আমি দেখছি স্যার।'
—আর শুনুন, দেখুন ছেলেটির অভিভাবককে খবর দেয়া যায় কিনা। (হেড স্যার জানেন না যে ছেলেটির অভিভাবক নিজেই দায়িত্ব নিয়ে ছেলের কানে দোকানে কাজের কথা পৌঁছেও দিয়েছে। যার কারণে এই নাটকের অবতারনা। জানলে হয়ত এমন কথা বলতেন না।)
—জ্বী স্যার আমি চেষ্টা করব।
এই ঘটনার পর কামালকে আশাহত হতে হলো। কারণ তাকে ক্লাসে বসিয়ে মিস শিউলি গেলেন ওষুধ আনতে। কিন্তু সে হাল ছাড়ার ছেলে নয়। মিস শিউলি ওষুধ নিয়ে ঢোকা মাত্র কামাল পেট চেপে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মত অবস্থা। সে কাতরাতে কাতরাতে বলল, 'আপা, প্যাটে বুটবু্ট করে। যখন তখন সব বাইর হয়া যাবে, এই দিল মোচড়। ওমা…'
অবস্থা বেগতিক দেখে অনেকেই কামালের পক্ষে সুপারিশ করল। কিন্তু মিস শিউলি কিছুতেই কামাল কে ছাড়বে না। তিনি নিজের টাকা দিয়ে ওষুধ কিনে এনেছেন। এরপর তো ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে তিনি কামাল কে টয়লেটে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। এতটুকুই অবশ্য কামালের জন্য যথেষ্ট ছিল। এতেই সে পাগার পার হয়ে এখন আমাজাদের দোকানের হেল্পার।

কামাল আসাতে আমজাদের বেশ ভালোই হয়েছে,সে কাজে আগের থেকে বেশি উৎসাহ পাচ্ছে। উৎসাহ বশত তার মাথা থেকে নিত্য নতুন আইডিয়া বের হচ্ছে। এরকম এক আইডিয়া নিয়ে সে কামালের সাথে কথা বলছে।
আমজাদ: কিরে কামাল কেমন দেখতেছিস?
কামাল: ভালোয় তো দেখি।
—খালি দেখলে হবে? ব্যবসা-পাতি আরো ভালো করতে হবে। কি বলিস?
—জে, ব্যবসা-পাতি ছাড়া গতি নাই।
—ভাবতেছি জোড়া বল ছাড়া বেচুম না। এক জোড়া ৯০ টাকা। কবুতরের জোড়া ১০০ টাকা আর বলের জোড়া ৯০ টাকা। হা হা হা…।
—জোড়া ১০০ করি লাগান। ৫০…৫০ রাউন্ড ফিগার!
—কথা মন্দ বলিস নাই। রাউন্ড ফিগার হলে ভালো হয়। খুচরা দিতে দিতে শেষ। আর এক কাজ করা যাইতে পারে। ফেরিওয়ালা সিস্টেমে  বল বেচা যাইতে পারে। বলবি— ১০০ টাকায় হাজার টাকার বল। বল নিবেন, বল? কি রে পারবি না?'
—পারব না কেন? আমি কি ভাত খাই না?

আইডিয়া অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে গেল।কামাল ব্যাগে বাল্ব নিয়ে ফেরি করা শুরু করা করল। সে অদ্ভুত ভাবে ফেরিওয়ালাদের  মত গলার স্বর করে ফেলেছে। আমজাদকে বেশ খুশি মনে হচ্ছে। সে দূর থেকে দেখছে, কামাল বলছে, 'বল নিবেন, বল। একশ টাকায় হাজার টাকার বল। বল নিবেন, বল?'

এই মুহূর্তে কামাল হামিদের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষনে হামিদ খুব বেশি এগোতে পারে নি। এরইমধ্যে তার বিরক্ত ধরে গেছে। তার মনে হচ্ছে ঘটনাটা সত্যি আগাগোড়া অপচয় হচ্ছে। কিন্তু সে লাইন থেকে বের হয়ে যেতে পারছে না পিছনে দাঁড়ানো লোক গুলার জন্য। হামিদের  সব থেকে বিরক্ত হচ্ছে বাল্ব বিতরনকারীদের উপর। এদের দেখে মনে হচ্ছে এরা মানব জাতির উপর মহাবিরক্ত। একটু গাইগুই হলে এরা তলপি-তলপা গুটিয়ে চলে যেতে পারলে বাঁচে। এমন একটা ভাব ধরে আছে যেন  এখানে বাল্ব বিতরনে তাদের কোন আগ্রহ নেই। নেহাত মায়ের দিব্যি দিয়ে তাদের এখানে পাঠানো হয়েছে। নইলে সেই কখন কার্য সাঙ করে চলে যেত!
কামাল হামিদ কে দেখে বলল, 'চাচা বল নিবেন নাকি?'
হামিদের একবার মনে হল আরো দুইটা বাল্ব কিনে নিবেন। বাড়িতে তার একটা মাত্র ঘর। বারান্দার এককোণায়  রান্নার ব্যবস্থা। একটা বাল্ব দরজার মাঝখানে ঝুলিয়ে দুই দিকে কাজ চালাতে হয়। এতে তার মেয়েটার পড়ালেখার বেশ সমস্যা হয়। দুইটা বাল্ব হলে মেয়েটার জন্য খুব ভালো হবে। মেয়ের কথা মনে হতেই হামিদের মনে পড়ল সকালের কথা। মেয়ে সকালে উঠেই  বাবার কাছে আবদার করেছিল। তেমন গুরুতর কিছু না। মেয়ের সাথে বাবাকে স্কুলে যেতে হবে। কিন্তু এদিকে আবার হামিদকে দোকান খুলতে হবে, মেয়ের আবদার রাখা হল না। দোকানও খোলা হল না। মেয়ের জন্য খারাপ লাগলো হামিদের। এমনিতেও হামিদ স্কুল বিষয়ে জড়াতে চায় না। কারণ সে একদমই মূর্খ। হামিদের বউ আবার ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। তাই বিভিন্ন কাজে স্ত্রী কে বেশ করে হামিদ। আজকেও করেছে, মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যেতে বলেছে। স্কুলে নিশ্চয়ই  খুব বড় অনুষ্ঠান, সেখানে হামিদ নিজে গিয়ে কি করবে, এই বলেই সে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। কামাল আবার বলে, 'চাচা, বল নিবেন?'
কল্পনায় ছেদ পড়ল হামিদের। সে বলে, 'না, নিব না। তুই বল বেচিস ক্যান? ইস্কুল নাই?'
কামাল বলে, 'ইস্কুলোত ক্লাস হয় না, খালি খচরামো হয়।'
—তুই কোন ক্লাসে পড়িস?
—ক্লাস সিক্স।
—রূপসাও তো সিক্সে পড়ে।
—হ, রূপসাও আমাগো ক্লাসে পড়ে।
—রূপসা ইস্কুল গেইছে?
—হ, দেখা হইছিলো।
—ইস্কুলে নাকি আইজ কি অনুষ্ঠান?
—হ, মেডেল দিব এক ব্যাটায়। রূপসাও মেডেল পাইব।
—কীসের মেডেল?
—কইতে পারি না চাচা।

কামাল তার ব্যাগ হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল। তার বেচা-বিক্রি খুব একটা ভালো হচ্ছে না। কেউ বাল্ব কিনতে চাচ্ছে না। যেও বা দু'একজন আগ্রহ দেখাচ্ছে তারাও অতিরিক্ত দামের কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে। কামাল সবাইকে বোঝাতে চাচ্ছে যে এই সাধারন বাল্বের দাম একশ টাকা কিন্তু এনার্জি সেভিং বাল্বের দাম হাজার টাকা। তাই এখানে কোন লোকসান নেই। কিন্তু কেউ বুঝতে চাচ্ছে না। এনার্জি সেভিং বাল্বের দাম যে এক হাজার টাকা নয়, একথা সবাই না জানলেও কয়েকজন জানে।

আরো প্রায় আধা ঘন্টা হামিদ লাইনের মাথায় আসলো। এখন তার সামনে শুধু তিন জন দাঁড়িয়ে। এখান থেকে বাল্ব বিতরনকারীদের ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। তাদের কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। তারা বাল্ব দিচ্ছে কম, চা-নাস্তা খাচ্ছে বেশি। এরা বিশাল কয়েকটা ছাতা পেতে বসেছে। ছাতা গুলো সমুদ্র তীরের বিশাল ছাতার মত। পাশাপাশি তিনটা ছাতা। তিন ছাতার নিচে মোটে ছয় জন বসে আছে। এরমধ্যে মাঝের দু'জন বাল্ব বিতরন করছে। বামপাশের একজন মোবাইলে কথা বলছে। অন্য জন উদাস ভঙিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখছেন। ডানপাশের দুইজন খাতায় কি জানি লেখালেখি করছে আর মাঝে মাঝে অট্টহাসি দিচ্ছে। অট্টহাসির কারণ আছে। কারণ হলো, মাঝের দুই জন সাধারন লোকজন কে গালি-গালাজ করছে আর তাই শুনে ডানপাশের দুইজন অট্টহাসি দিচ্ছে। বামপাশের দু'জন এব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। অবস্থা যা দেখা যাচ্ছে, তাতে দুইটা লাইন নির্বিঘ্নে হতে পারতো। জোরজবরদস্তি করলে তিনটাও হতে পারতো। কিন্তু তাহলে তো এই অট্টহাসি হতে বঞ্চিত হতে হতো। তাই একটাইলাইন করা হয়েছে।

লাইনের মাথায় এখন এক মধ্য বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে । সে বাড়ি থেকে ছয় টা বাল্ব নিয়ে এসেছে। বাড়ি থেকে আনাতে বাল্বের কোন বক্স নেই। নতুন বাল্বের মত বক্স না থাকায় বিতরনকারীরা এই বাল্ব নিতে চাচ্ছে না। তাদের চাই নতুন বাল্ব। বিতরনকারীদের মধ্যে একজন বলল, 'এই বাল্ব হবে না, ভালো বাল্ব নিয়া আসেন।'
লোকটা বলল, 'বাবা, বল তো ভালো। বাড়ি থাকি খুলি নিয়া আসলাম।'
—খুলে আনছেন ভালো কথা। এখন আপনার টাও খুলে ফেলবো? (এই শুনে ডান পাশের দুজন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল)
—বাবা কী বলো?
—বললাম বাল্ব ভাল কীভাবে বুঝবো? কোথায় লাগাবো?
—বাবা, কারেনে লাগাইলেই হবে।
—কারেন্ট কোথায় পাবো? আপনার ওখানে লাগাবো?
মধ্য বয়স্ক সেই গ্রামের সাধারণ মানুষ। তার সাধারণ মস্তিস্ক এই নোংরা চিন্তাভাবনা ধরতে পারলো না। কিন্তু ডানপাশের দুইজন ধরতে পারলো। তাদের হাসিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মত অবস্থা। অন্য একজনকে এরা ইংরেজীতে বেশ কিছু গালি দিল। তারপর তার অর্থ বলে দিল। অপমান করার নতুন পদ্ধতি সম্ভবত। ঘটনাটা এরকম: বাল্ব বিতরণকারী বলল, 'নেন নাম সই করেন।'
—নাম সই তো করতে পারি না। টিপসই নেন।
—আপনি দেখতেছি ইললিটারেটের বাচ্চা ইললিটারেট। ইললিটারেট মানে বোঝেন? ইললিটারেট মানে মূর্খ।
লোকটা টিপসই দিল। সম্ভবত একটু এদিক ওদিক হল। আর তাতেই লোকটাকে অপমান করার সুযোগ পাওয়া গেল।
—আপানি তো দেখতেছি ইডিয়েটের বাচচা ইডিয়েট। ইডিয়েট মানে বোঝেন? ইডিয়েট মানে গর্দভ। ১ম শ্রেণীর গর্দভ।
এই শুনে ডানপাশের দু'জন হাসিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। যেন খুব উঁচুমানের কোন কৌতুক বলা হয়েছে। এবার বামপাশের দু'জন ও যোগ দিল। হামিদকেও এধরনের কিছুর সম্মুখীন হতে হত। কিন্তু এক সাংবাদিকের জন্য শেষ রক্ষা হল। সাংবাদিক আসাতে বাল্ব বিতরণকারীরা বাধ্য বালকের মত বাল্ব দিতে শুরু করলো। বাল্ব তুলে দেয়ার সময় একটু বেশিক্ষণ ধরে থাকে যাতে ছবি তুলতেও সুবিধা হয়। হামিদের সাথে পিছনের কয়েকজনও রেহাই পেল। এরপর শুরু হল বাল্ব বিতরণকারীদের সাক্ষাৎকার পর্ব। কিন্তু তারা কিছুতেই ক্যামেরার সামনে কথা বলতে পারছে না। সাংবাদিক একে একে ছয়জনকেই শিখিয়ে দিলেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। যদিও বা একজন একটু  বলতে শুরু করেছিল । বলা শুরু করার সাথে সাথে সাংবাদিক এক বে-ফাঁস প্রশ্ন করে ফেলায় তার ঘাম শুরু হয়। এরপর তিনিও আর কিছুই বলতে পারেন নি। সাংবাদিক বাধ্য হয়ে ক্যামেরা বন্ধ করে চেয়ারম্যানকে খুঁজতে শুরু করলেন। যাতে অন্তুত একটা সাক্ষাৎকার নেয়া যায়। একটা সাক্ষাৎকার না নিয়ে গেলে যে তার চাকরি থাকে না। কিন্তু শুরু থেকে চেয়ারম্যানকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

হামিদের ইচ্ছা ছিল এরপরে সাংবাদিক কি করে সেটা দেখবে। কিন্ত সেই উপায় কোথায়? তাকে এখন দোকান খুলতে হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার উপর  আজকে হাটের দিন। দোকান খোলা উচিত ছিল সকাল নয়টায় । আর এখন বাজে সাড়ে বারোটা। হামিদ দ্রুত হাটে গিয়ে দোকানের উপরের পলিথিন সরিয়ে ফেলে দোকানের সামনটা ঝাড়ু দিল। পাশের দোকানের মজিত মিয়া বলল, 'কি হামিদ মিয়া। বেলা কইরা দোকান খুলো ক্যান? শরীর খারাপ নাকি?'
হামিদ উত্তর দেয়, 'আর বইলেন না। গেছলাম তো পরিষদের দিকে। কিসের নাকি বল দেয়। সেই ছাতার বল আনতে যায়া সব শেষ।'
—ও তুমিও গেছলা তাইলে। তা তুমি বল আনতে যাইবা আমাগো কইবা না। আমরাও যাইতাম। তা কই? কি বল দিল দেখাও তো।
হামিদ এনার্জি সেভিং বাল্বটা মজিত মিয়াকে দেখালো । মজিত মিয়া বাল্বটা নেড়েচেড়ে দেখে বলল, 'দেখছো কত রকমের কারুকাজ বের হইছে। বাপের জন্মে এমন জিনিস দেখি নাই।'
হামিদ বলল, 'হ , তা ঠিক কইছেন। তা আইজ বেচা বিক্রি কেমন?'
—আইজ মিষ্টির টান টা একটু বেশি। ভালোয় যাইতাছে । মানুষ হঠাৎ এত মিষ্টি কিনবো ক্যান? মেট্রিক পরীক্ষার রেজালও তো বের হয় নাই।
—কি হয় হোক। আপানর তো বেচা বিক্রি ভালোয় হচ্ছে।
—হ, সব আল্লার ইচ্ছা। তুমি দোকান খুলো তোমারও হইবো। আইজ বাজার ভালো। মানুষের কাছে ধান বেচা টাকা। বোঝ নাই? আর তোমার তো কাঁচা বাজারের ব্যাবসা। কাঁচা বাজারের ব্যাবসার মত ব্যাবসা আছে ? মাঝে মাঝে মনে হয় মিষ্টির ব্যাবসা বাদ দিয়া কাঁচা বাজারের ব্যাবসা ধরি।
—ভাইজান কি মশকরা করেন নাকি?
—না, না, মশকরা করবো ক্যান? ব্যাবসায় মশকরা করার যায় না।

হামিদ দোকান খুলতে গিয়ে দেখলো তার দোকানের পাশে ফাকা জায়গায় কে একজন লাউ-টাউ হাবিজাবি নিয়ে বসে পড়েছে। ব্যাবসার খাতিরেই হামিদ সেই লোককে সেখান থেকে সরে যেতে বললেন। কিন্তু সেই লোক কিছুতেই সরবে না। সে দেখেছে দোকান বন্ধ তাই বসে পড়েছে। দখলকৃত জায়গা ছেড়ে দেয়ার কোন  মানে হয় না। হাটের দিনে এই এক সমস্যা। গ্রামের সব মানুষ চলে আসে। এরা শুধু শুধু যে আসবে তেমনটা না । যার যা আছে তাই নিয়ে বিক্রি করতে চলে আসবে। যার নিতান্ত কিছুই নেই সেও চালের লাউশাক নিয়ে চলে আসবে এবং কোথাও বসে পাঁচ টাকা দরে এক আটি বিক্রি করবে। হামিদের দোকানের পাশে যে ভদ্রলোক বসেছে তার নাম আজিজ । তিনি নিজের জমির লাউ, শিম আর টমেটো নিয়ে চলে এসেছেন। যদিও তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন কিছু লাউ, টমেটো লাগালে বাড়িতে খাওয়া যাবে। তরকারি কিনতে হবে না। কিন্তু তিনি এখন সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন। প্রতি হাটে টমেটো লাউ তুলে এনে হাটে বিক্রি করছেন। বাড়ির শিমও বাদ যাচ্ছে না। যাই হোক আজিজ সাহেবের এই বেচা বিক্রি হামিদ তো কোন মতেই মানবে না। হামিদ আজিজ সাহেবের সব টমেটো, লাউ, শিম কিনে নিতে চাইলো।  আজিজ সাহেব এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। হামিদ আজিজ কে বোঝাতে চেষ্টা করলো এই সব বিক্রিতে লোকসানের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আজিজ সাহেব তাতেও বুঝলেন না। শেষ পর্যন্ত চুক্তি হল সারাদিন আজিজ সাহেব হামিদের দোকানের পাশে বিক্রি করতে পারবে। বিনিময়ে হামিদ পাবে একশ টাকা। হামিদ অবশ্য আজিজকে একটা সুবিধা দেবে। হাটের ইজারাদার আসলে হামিদ আজিজের ছোট দোকান কে তার দোকানের অংশ বলে চালিয়ে দেবে। এতে আজিজের দুইশত টাকা বেচে যাবে। যার একশ টাকা পাবে হামিদ।

যথা সময়ে ইজারাদার আসলো ইজারা তোলার জন্যে। ইজারা হল এক ধরনের চাঁদা । যা হাটে দোকান বসালে দিতে হয়। ইজারাদার প্রথমে এসেই আজিজ সাহেব কে ধরলেন।
—নাম?
—আজিজ মণ্ডল।
—গ্রাম?
—উত্তরপাড়া।
—দেন টাকা দেন।
—কত?
—দুইশত টাকা।
আজিজ হামিদকে দেখিয়ে দিল। হামিদ বলল, 'ভাই, হাটের দিন । একা হাতে সামলাইতে পারি না তাই হেল্পার রাখছি।'
ইজারাদার বলল, 'হেল্পার রাখছো ভালো কথা। হেল্পারের টাকাও দেও। দুই দু গুনে চারশ।'
—কি বলেন ভাই। আইজ কি হাটে নয়া দোকান দিছি নাকি?
—নয়া দোকান দেও নাই ভাল কথা হেল্পার বাইরে রাখছো কেন? দোকানে তোল। নাইলে চারশ টাকা দেও।
ইজারাদারকে বোঝানো বড় দায়। শেষ পর্যন্ত আজিজকে হামিদের দোকানের সামনের অংশে বসিয়ে দিয়ে ইজারাদার বিদায় হল। যদিও ইজারাদার চলে যাওয়ার সাথে সাথে সবাই স্ব-স্থানে চলে গেল। ইজারাদার চলে যাওয়াতে হামিদ আজিজকে বলল, 'চান্দার ঝামেলা মিটছে এবার দেও দেখি একশ টাকা।'
আজিজ বলল, 'বেচা-বিক্রি কেবল শুরু করলাম । একটু সবুর করেন। টাকা পাইবেন। একশ টাকা খায়া বড়লোক হব নাকি?'
এই একশ টাকা খেয়ে আজিজ সাহেব বড়লোক হবেন কিনা সেটা পরীক্ষা করতেই হোক বা অন্য কারণেই হোক আজিজ সাহেব হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন।  তখনও তার বস্তায় দুই এক কেজি টমেটো ডালিতে সামান্য শিম। দেখে বোঝাই যাচ্ছে বেচা বিক্রি বেশ ভালই হয়েছে। সন্ধ্যার মধ্যেই সব শেষ। আজিজ সাহেব হঠাৎ প্রসাব করার কথা বলে উঠে গেলেন আর ফেরার নামও নিলেন না। হামিদ নিজের বোকামির জন্যে নিজের গালে কয়েকটা চড় দিল মনে মনে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর হামিদ দোকান থেকে উঠল আজিজকে খোঁজার জন্য । হামিদ মজিতকে বলল, 'ভাই, দোকান টা একটু দেখেন। দেখি হারামজাদা আশেপাশে আছে কিনা?'

হামিদ অনেক খুঁজলো । পুরো হাট সে আট-দশ পাক দিলো। মাছ-মাংসের হাটের দিকে পাক আরো বেশি হবে। কারণ হামিদের ধারণা মাছ-মাংস কিনতে যাবে। কিন্তু সে ধারণা সত্যি হল না।

কথায় আছে সমস্যা যখন আসে সব দিক ভেঙে আসে। হামিদের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে কেন? হামিদ ফিরে এসে নতুন সমস্যা আবিষ্কার করলো। কে যেন তার দোকানের উপর একটা মিষ্টির প্যাকেট রেখে গেছে। এই মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হামিদ পড়লো অকুল পাথারে। হঠাৎ কে মিষ্টির প্যাকেট দোকানে রেখে যাবে? নিশ্চয়ই কোন মানুষ মিষ্টির প্যাকেট  এখানে রেখেছে। তারপর আশেপাশেই কোথাও প্রয়োজনীয় কাজ সারতে গেছে। মানুষটা নিশ্চয়ই পরিচিত। পরিচিত কেউ না হলে হুট করে মিষ্টির প্যাকেট রেখে ঘুরতে যাবে না। হামিদ প্রথমে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে গেল মজিত মিয়ার কাছে। কারণ  হামিদের ধারণা এই মিষ্টির প্যাকেট মজিত মিয়ার দোকানের।
হামিদ বলল, 'মজিত ভাই, দ্যাখেন তো মিষ্টির কাটুন ক্যামনে আমার দোকানে আসলো।'
মজিত মিয়া মুখে আয়েশী হাসি নিয়া বলল, 'কি কও মিয়া। মিষ্টির কাটুন এমনে এমনে আসলো ক্যামনে। কাটুনের কি হাত পাও গজাইলো নাকি?'
—হাত পাও গজাইবো ক্যান। দ্যাখেন তো কাটুন টা আপনের দোকানের কাটুন না?
—কাটুন দেইখা ক্যামনে কি বলি। হাটের সব দোকানের মিষ্টির কাটুন এক। টাউনের দোকান হইলে নাম লেখা থাকতো। তখন বুঝা যাইতো কোন দোকানের কাটুন।
—আপনের দোকানের কাটুন না হইলে আমার দোকানে ক্যামনে আসলো? মিষ্টির দোকান সব হাটের উত্তরখানে। এইখানে কি উইড়া আসলো?
—দেখো কেউ  হয়তো ভুলে রাইখা গেছে।
—আপনারে না কইলাম দোকানটা একটু দেখতে । এই রকম কাউরে দেখছেন নাকি?
—আমি আবার একটু ইজতেঞ্জা করতে গেছলাম।
মজিত তার কর্মচারীকে জিজ্ঞাস করলো, 'ইদ্রিস, হামিদের দোকানে কেউ মিষ্টির কাটুন নিয়ে আইছিলো নাকি?'
ইদ্রিস জবাব দিল, 'না, ওস্তাদ।'
ইদ্রিস সব সময় দোকানের ভিতরে থাকে। তার পক্ষে এসব কিছু দেখা সম্ভব না। হামিদ চিন্তায় পড়ে গেল। সে মজিত কে জিজ্ঞেস করল, 'এই মিষ্টি নিয়া কী করি কন তো?'
মজিতের সোজাসাপ্টা উত্তর, 'কী আর করবা? বাড়ি নিয়া যাও। বউ-বাচ্চা খুশি হইবো। সামনের জুম্মা বারে আল্লার ওয়াস্তে একটা মিলাদ দিয়া দিও।'

হামিদের চিন্তা তাতেও কমলো না। চিন্তায় সে আজিজের ব্যাপারটা ভুলেই গেল। তার চিন্তা  এখন মিষ্টির প্যাকেট কে ঘিরে। সে এই প্যাকেট নিয়ে আশেপাশের দোকান গুলোতে গেল। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত সে দোকানে ফিরে এসে অপেক্ষা করতে শুরু করলো। হামিদ সাধারণত রাত আটটার দিকে দোকান বন্ধ করে । কিন্তু আজকে নয়টার পরও সে অপেক্ষা করলো। তার ধারণা ছিল মিষ্টির মালিক ফেরত আসবে। হয়তো বাড়ি গিয়ে মনে হবে তিনি মিষ্টির প্যাকেট টা ফেলে এসেছেন কোন এক কাঁচা বাজারের দোকানে। তারপর তড়িঘড়ি করে আবার ছুটবে বাজারে । কিন্তু সেরকম কিছু হল না। কেউ এল না মিষ্টির প্যাকেট নিতে।

এজন্যে হামিদের মনে অন্য আরেক ভাবনার উদয় হয়েছে। তার মনে হচ্ছে মিষ্টির প্যাকেটটা কোন পরিচিত মানুষ রেখে গেছেন। কাল সকালেই হয়ত তিনি বাড়িতে এসে উপস্থিত হবেন।  বলবেন, 'হামিদ, বাড়িতে আছো? কালকে তোমার দোকানে মিষ্টির প্যাকেট টা রেখে এসেছিলাম। পাইছো না?'
এই ধারণা সত্য হলে দোকানে বসে থাকা নিরর্থক। তার থেকে বরং বাড়ি যাওয়া ভাল। যা হবে দেখা যাবে। তবে কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। কোন পথ না দেখে হামিদ মিষ্টির প্যাকেট নিয়েই বাড়ি রওয়ানা  দিল। পথে যেতে যেতে হামিদ ভাবতে শুরু করলো নতুন ভাবনা। সে ভাবতে শুরু করলো যদি সে কাল মিষ্টির প্যাকেট খেয়ে ফেলে । তার কিছুদিন পর হয়ত কোন পরিচিত জন বলে বসলো, 'কি রে হামিদ, তোর দোকানে মিষ্টির কাটুন রাখি আসলাম। তোর ভাবির কাছে দিয়া আসার জন্যে। আর তুই কিনা একাই খেয়ে ফেললি। এটা কি ঠিক করলি?'
এই ভাবনার পর হামিদ বুঝলো সে বিরাট এক ভুল করেছে। তার আরো ভালো ভাবে খোঁজ করা উচিত ছিল। কারণ প্রায়শই  তার দ্বারায় অনেকেই অনেক কিছু বাড়িতে পাঠায়।

অবধারিত ভাবে বিষণ্ণ মুখ নিয়ে হামিদ বাড়িতে ঢুকলো । সে লক্ষ্য করলো বাড়িতে কেউ ঘুমায় নি। রূপসা আর রুপসার মা রুবি দুইজনই বেশ খোশ মেজাজেই আছে। এত দেরি করে আসলে রুবি সাধারণত রেগে থাকে। আজকে সেরকম মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এখনো রান্না চলছে। দুইজনই বারান্দার কোণায় চুলার পাড়ে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বসে আছে। রুবি কি পোলাও রন্না করছে? তার পোলাও সাধারনত কোন সুগন্ধ ছড়ায় না। কিন্তু আজকে সুগন্ধে চারিদিক মৌ মৌ করছে কেন কে জানে। রূপসা প্রথমে হামিদকে লক্ষ্য করলো না । সে খুব আগ্রহ নিয়ে মাকে কোন গল্প শোনাচ্ছে  বলে মনে হচ্ছে। তার সব মনোযোগ  এখন একবিন্দুতে। তাকে খুব রোমাঞ্চিত মনে হচ্ছে। বারান্দার চৌকিতে বসে হামিদ স্ত্রীকে ডাকলো, 'রুবি, এই দিকে আসো।'
রূপসা এই প্রথম তার বাবার উপস্থিতি টের পেল। সে ছুটে গেল হামিদের দিকে। হামিদের পাশে  থাকা মিষ্টির প্যাকেট টা সে লুফে নিল। রুবিকে সেই প্যাকেট দেখিয়ে বলল, 'দেখছো মা কইছিলাম না, বাজান জানে আমি বৃত্তি পাইছি। দেখো বাজান মিষ্টি নিয়ে আসছে।'

মিষ্টির প্যাকেট কে নিয়েই সব আনন্দ রূপসার । এ যেন কোন অপার্থিব আনন্দ। হামিদ বাধা দিতে গিয়েও পারলো না। কিছু কিছু আনন্দে বাধা দিতে নেই।

আল কাফি নয়ন
রংপুর। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন