নাদিয়া জান্নাত'র গল্প...


পত্রিকা অফিসের শাহেদ ভাই এবং আমাদের পথে হাঁটার গল্প



আমার পথের বন্ধু শাহেদ। শাহেদের কথা মনে হলেই দেয়ালে একটা আঁচড় কাটি। সেই শিখিয়েছিলো, কি করে রক্ত বের করে কষ্টটাকে সামনে আনতে হয়। কি করে পা ফেলতে হয়। কি করে হিংস্র মানুষ গুলোর মাঝ থেকে বীরদর্পে পা ফেলে এগুতে হয়।

শাহেদ পথের মানুষ। বাবু ভাইয়ের দোকানে চা খেতে খেতে প্রথম পরিচয় শাহেদের সাথে।

...দেশটা নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে ম্যাডাম। সময়টা ভালো না।রংপুরের মতো শহরে রাত নয়টার পর একা একটা মেয়ে কি নিরাপদ? অবশ্য নিজের ঘরেও কেউ নিরাপদ না।

আমি কোন কথা বলি না। চুপ করে থাকি। ছেলেটার দিকে দু-একবার আড়চোখে তাকাই—'মাথায় উসকো খুসকো চুল। একটা পুরাতন ভাঁজ পড়া পাঞ্জাবি। এক হাতে চায়ের কাপ অন্য হাতে ম্যাগাজিন। একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চোখ অল্প আলোতে একটার পর একটা পাতা উল্টাচ্ছে।' বাবু ভাইয়ের চায়ের বিল ষোল টাকা মিটিয়ে আমি উঠে আসি।

মন ভারী হলে বাবু ভাইয়ের চা ভালো কাজে দেয়। এক কাপ আদা চা চার টাকা। ঘোর ধরিয়ে দেয়। বাবু ভাইয়ের দোকান থেকে হেঁটে হেঁটে মেডিকেল মোড়ে আসতে ত্রিশ মিনিট লাগে।

এবার খুব শীত পড়েছে। রাত দশটাতেই চেক পোস্টের দিকটা কেমন সুনসান হয়ে আছে। দু-একটা কুকুর চোখে পড়ে কেবল।

—পাঁচশো টাকা দেব। চলবে?
সামনে একটা বখাটে গোছের ছেলে। গায়ের চাদরটা ভালো করে টেনে আমি দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকি। একটা রিক্সাও নেই। ছেলেটা পেছন পেছন আসতে থাকে।
—কি হলো চলবে না? আরো বাড়ায় দেব?
আমি আরো দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকি। সামনে ওভারব্রীজটা দেখা যাচ্ছে। ওখানটাতে গেলে ঔষধের সব গুলো দোকান খোলা পাওয়া যাবে। এই শীতেও ঘামছি আমি। হঠাৎ সেই দরাজ গলা শুনে আবার থমকে যাই।
—ম্যাডাম ভয় পাবেন না। পেছনে তাকান। আমি শাহেদ। একটু আগেই চায়ের দোকানে আমাদের দেখা হয়েছিলো।
আমি পেছনে তাকাই।
—আপনাকে খুব সাহসী ভেবেছিলাম। কিন্তু না...। আপনি এখনো সাহসী হতে পারেন নি। ছেলেটাকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন খুব? পাওয়ারি কথা। এতো রাতে একা একা বাইরে কি করেন আপনি?
—রাত দেখতে ভালো লাগে। মাথা জ্যাম হলে একা একা বেরিয়ে পড়ি। পুরুষ গুলো কেমন মুখোশ খুলে কুকুর হয়ে বেরিয়ে পড়ে। অবাক হয়ে যাই।

...এভাবেই আমার সাথে শাহেদ ভাইয়ের প্রায়ই দেখা হয়। রাস্তায়। শাহেদ ভাই পথের মানুষ। তার পাঞ্জাবিতে ধূলো লেগে থাকে। বাউল গান গায়। একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। শাহেদ ভাইয়ের কথা মনে পড়লে আমি প্রথমে দেয়ালে আঁচল কাঁটি। তারপর রক্ত হাতে বেরিয়ে পড়ি। সেই শিখিয়েছিলো। পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিলো শাহেদ ভাই।

শাহেদ ভাই শীতকাল চলে এসেছে। আচ্ছা শাহেদ ভাই তারার দেশে কি চা পাওয়া যায়? জানেন শাহেদ ভাই আমি একটা পত্রিকা অফিস চালাই। আপনার মতো আমাকেও ওরা যদি তারার দেশে পাঠিয়ে দেয় তাহলে আমরা এক সাথে ছায়াপথে হাঁটবো। গুণে গুণে চার কাপ চা খাবো। বিলটা সেদিন আপনিই দিয়েন শাহেদ ভাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন