আংটি
বিকেলের রোদের তেজ কমে এসেছে দেখে বাশার সাহেব চার তলার ফ্ল্যাট থেকে নিচে নেমে এলেন। ঢাকাতে এলে তিনি সব সময় যে মেজো ছেলের পিসিকালচার হাউজিংয়ের এই ফ্ল্যাটে ওঠেন এমন নয়। তবে এখানে এলে বিকেল বেলা তিনি খিলজি রোড়ের পার্কে এসে বসেন। ঢাকাতে আসতে একেবারেই মন চায়না বাশার সাহেবের। দিনাজপুর শহরে মুন্সিপাড়ায় তাঁর একবিঘার ওপর বিরাট বাড়ি। মানুষজন আসে, কথাবার্তা বলেন। বিরল, কাহারোল থেকে আত্মীয়স্বজন আসে। তারা এলে সপ্তাহখানেক থাকে। তিনি কথা বলে আনন্দ পান। কখনো সন্ধ্যার পর প্রেসক্লাবে গিয়ে বসেন। জয়েনউদ্দিন প্রবীন সাংবাদিক। বাশার সাহেবের থেকে বয়সে বছর পাঁচেকের ছোটই হবেন। একটি জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি। সাংবাদিক জয়েনউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে মজা পান বাশার সাহেব। আজকের খবরের কাগজটা মুখের সামনে নিয়ে সাংবাদিক জয়েনউদ্দিন বলেন, ‘বুঝলেন বাশার ভাই! পেপার হচ্ছে আন-রিফাইন্ড সল্ট। কেঁচোর মুখে পড়েছে কি কেঁচোর মুচড়ামুচড়ি শুরু হয়ে গেল। গত পরশু মফস্বল পাতায় লিড নিউজ করল, গতকালই বেটাকে ধরে সোজা শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। রুলিং পার্টির কেউ প্রটেকশন দিতে পারেনি।’
ঢাকা শহরে এলে দম বন্ধ হয়ে আসে বাশার সাহেবের। ভারী বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। গাড়ির হর্ণ মাথা ঝালাপালা করে দেয়। বাশার সাহেব পার্কে ঢুকে বসার জায়গা খুঁজলেন। ফাঁকা কোনো জায়গা খুঁজে না পেয়ে এমাথা ওমাথা হাঁটলেন কিছুক্ষণ চিকন ইটপাতা পথ ধরে। একজন মানুষ অনেকক্ষণ ধরে একটা বেঞ্চে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। মানুষটা উঠে বসতেই বাশার সাহেব তার পাশে গিয়ে বসে পড়লেন।
২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে বয়স হবে ছেলেটার। গায়ে কমদামী সাদা শার্ট। পরনে ধূসর রঙের সাদামাটা প্যান্ট। বেল্টওয়ালা চামড়ার স্যান্ডেল বেশ পুরাতন। দুই পাটিরই গোড়ালির দিকে ক্ষয়ে গেছে। ছেলেটা মুখে বিকট হা করে হাই তুলল। দুই হাত ঘাড়ের পেছনে নিয়ে আড়মোড়া ভাঙল। পাশে তাকিয়ে বলল, ‘আসসালামুআলাইকুম চাচা।’
বাশার সাহেব সালামের উত্তর দিলেন।
‘বড্ড গরম চাচা! ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ ছেলেটা কৈফিয়তের সুরে এমনভাবে বলে যেন ঘুমিয়ে পড়ার লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করছে।
‘গাছপালা না থাকলে বাতাস আসবে কোত্থেকে!’ বাশার সাহেব ছেলেটার সঙ্গে কথা শুরু করেন। ‘চারদিকে লম্বা লম্বা দালান। বাতাস চলাচল করে কেমন করে!’
ছেলেটা বলে, ‘চাচা কি এই মহল্লায় থাকেন?’
বাশার সাহেব বলেন, ‘ছেলে থাকে এখানে।’
‘আপনার বাড়ি?’
‘দিনাজপুর।’
‘আমার বাড়ি চাচা কাছেই। সোজা পশ্চিমে হাঁটা দেবেন। পাবেন আদাবর বাজার। নাক বরাবর সোজা যাবেন। মনসুরাবাদের পাশ ঘেঁষে চলে গেলে বালুর মাঠ। আমার বাড়ি। ফাঁকা জায়গা। বাতাসের গড়াগড়ি।’
দুই হাতে মুখ ঢেকে আবার হাই তোলে ছেলেটা। দুই কাঁধ উপর-নিচ করে আড়মোড়া ভেঙ্গে বলে, ‘বাস থেকে নামার পর আর বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি পাই নাই। পার্কের বেঞ্চে শুয়ে দিছি ঘুম।’
ছেলেটার কথায় নির্দিষ্ট কোনো জেলার আঞ্চলিক টান নেই। সুন্দর করে হেসে গুছিয়ে কথা বলে। ছেলেটাকে পছন্দ হয় বাশার সাহেবের। একটু লজ্জিতভাবে বলেন, ‘তুমি করেই বলি তোমাকে।’
ছেলেটি প্রায় লাফিয়ে ওঠে। বলে, ‘হ্যা হ্যা! ছি ছি চাচা! আপনি তো আমাকে তুমি করেই বলবেন। আমার নাম মতিন। আপনি বলবেন, মতিন চা খাব। আমি আপনার জন্য চা নিয়ে আসব। ওই যে প্রাচীরের সঙ্গে যে-চায়ের দোকানটা দেখছেন। সুন্দর চা তৈরি করে। কেরাণীগঞ্জ থেকে গরুর খাঁটি দুধ নিয়ে আসে। আজব ব্যাপার, ঢাকা শহরে খাঁটি গরুর দুধের চা। আপনি বসেন, আমি আপনার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসি।’
বাশার সাহেব আপত্তি করেন। মতিন শোনে না। বলে, ‘ঘুম থেকে উঠলাম, আমি তো এককাপ খাবই। আপনি আমার সঙ্গে খেলেন এক কাপ।’
মতিন চা আনতে চলে যায়।
মতিন ভাবছিল যদি সে খুব ভুল করে না থাকে তাহলে ভদ্রলোক আঙুলে যে আংটি পরে আছেন সেটা নিশ্চিত হিরার এবং দাম নেহাত লাখ টাকার কম হবে না।
মতিন চায়ের সঙ্গে ছোট সাইজের দুটো কলা আর টোস্ট বিস্কুট নিয়ে ফিরে আসে। বলে, ‘খান চাচা! কলা আর বিস্কুট খান।’
বাশার সাহেব বলেন, ‘না না এখন আর ওসব বিস্কুট কলা খাব না। ওই তো বাসায় গিয়ে সন্ধ্যার সময় চানাচুর-মুড়ি চা তো খাবই।’
‘আপনার বউমা মুড়ি চানাচুর মাখিয়ে ট্রেতে করে আপনার সামনে নিয়ে আসবেন। সঙ্গে গরম চা। আপনার নাতি লাফ দিয়ে আপনার কোলে উঠে বলবে, দাদা দাদা আমিও তা থাবো। আপনার বড় আনন্দ হবে।’
বাশার সাহেবেরও ওমনটি ভাবতে খুব ভালো লাগে। ছুটির দিন হলে হয়তো বউমা তাই করত। অফিস শেষ করে ঘরে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। তখন রাতের খাবার গরম করার তাড়া থাকে। অল্প বয়সী একজন কাজের মেয়ে আছে বাসাতে। সন্ধ্যা বেলা সে-ই চা দেয়। ছেলে ফেরে অনেক রাতে।
মতিন বলে, ‘কি চাচা! নাতি আছে তো আপনার?’
বাশার সাহেব বলেন, ‘মেজো ছেলের ঘরে এক নাতনি। সাত বছর বয়স। এখানেই মর্নিং সানে ক্লাস ওয়ানে পড়ে।’
‘ছেলেমেয়েরা কি সব ঢাকাতেই থাকে? কয় ছেলেমেয়ে আপনার?’
‘ঢাকাতেই থাকে ওরা। এক ছেলে থাকে উত্তরা দক্ষিণখান। একজন থাকে চানমিয়া হাউজিং। মেয়ে থাকে খিলগাঁ।’
‘চাচার দেখি ভরা সংসার। নাতি-নাতনি মোট কতজন?’ মতিন কথা বলে, চায়ে চুমুক দেয় আর বাশার সাহেবের আংটির দিকে তাকায়, শেষ বিকেলের ফিকে রোদেও যদি একবার ঝিলিক দেয় তবে এ হিরা না হয়ে যায় না।
বাশার সাহেব বলেন, ‘দুই নাতি, তিন নাতনি।’
কথা বলতে বলতে বাশার সাহেব কলা বিস্কুট খান। চায়ে চুমুক দিয়ে চা শেষ করেন। মতিন গল্পে আসর জমিয়ে ফেলে। কখন সন্ধ্যা নামে বাশার সাহেব টের পান না। মতিন বলে ওর জন্ম ঢাকাতে। ঢাকাতেই বড় হয়েছে। ঢাকার বাইরে বিশেষ কোথাও যাওয়া হয়নি। বন্ধুদের সঙ্গে একবার বগুড়া গিয়েছিল। এবার সে নিশ্চয় দিনাজপুর যাবে। গেলে কয়েকদিন থাকবে সেখানে। বাশার সাহেব বলেন মতিন দিনাজপুর গেলে ওকে তিনি রামসাগর, মাতাসাগর দেখিয়ে আনবেন। চাইলে কান্তজীর মন্দিরও দেখিয়ে আনতে পারেন।
দিনের আলো মিলিয়ে যাওয়ার পর বাশার সাহেব ফেরার জন্য উঠলেন। তিনি খুব লজ্জিত হলেন। তাঁর কাছে কোনো টাকা নেই। চায়ের দাম দিতে পারছেন না। বাশার সাহেবকে আশ্বস্ত করে মতিন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার বলে আজ তিনি মতিনের গেস্ট। আপত্তি না থাকলে আগামিকাল বিকালে তিনি মতিনকে এখানে চা খাওয়াবেন। তবে ওই চা-বিস্কুট-কলা, আর কিছু নয়। বাশার সাহেব রাজি হয়ে বাসায় ফেরেন।
মতিন বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে বাশার সাহেবকে। চায়ের দোকানে এসে মতিন আজ একটা বেনসন সিগারেট চায়। দোকানদার একটু ঝাঁজ মেশানো গলায় বলে, ‘বাকির হিসাব আছে? পাঁচচল্লিশ টাকা। বেনসন চাও কুন হিসাবে।’
মতিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলে, ‘গফুর ভাই! তুমি যদি চাও তোমাকে আমি সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালের সঙ্গে একটা চায়ের দোকানের পজিশন নিয়ে দেব। তুমি বিসনেস করবা। টাকা আমি দেব। কসম।’
দোকানদার মতিনের কথার উত্তর না দিয়ে এক শলাকা বেনসন এগিয়ে দিয়ে বাকির খাতায় সিগারেট-চা-কলা-বিস্কুটের দাম লিখে রাখে।
পরদিন বিকেলে বাশার সাহেবের সঙ্গে মতিনের আবার দেখা হয় পার্কে। মতিন চা-কলা-বিস্কুট নিয়ে আসে বাশার সাহেবের কাছ থেকে টাকা নিয়ে।
‘ঢাকা শহর ভালো লাগে না তো ঢাকাতে আসছেন কেন?’ মতিন গল্প শুরু করে।
বাশার সাহেব বলেন, ‘আমার তো আসার ইচ্ছা ছিল না। ছেলেমেয়েরা ছাড়ল না। গত একমাস পেশাবে গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। বয়স হলে ও সবারই হয়। পেশাব ধরে রাখতে পারি না। আপনা-আপনি হয়ে যায়। পেশাব শেষ করে বাথরুম থেকে ঘরে ফিরতে তিন চার ড্রপ আবার হয়। দিনাজপুরে ডাক্তার সোলায়মান দেখছিল। ওরা আমাকে জোর করে ঢাকাতে নিয়ে এল বড় ডাক্তার দেখাবে বলে। শুনেছি ডাক্তার সালাম খুব বড় ইউরোলজিস্ট। ছেলেমেয়েরা খাটাখাটুনি করে টেলিফোনে তাঁর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে কিন্তু যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।’
‘কেন! যেতে পারবেন না কেন?’
‘কে আমাকে নিয়ে যাবে বলো। ওদের অফিস আছে না। আবার ওই যে ওরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে যায়, নিয়ে আসে। আমাকে নিয়ে কখন যাবে?’
মতিনকে খুব উৎসাহিত মনে হয়। বলে, ‘চাচা। এইটা কোনো কথা হলো। আপনি দিনাজপুর থেকে ঢাকা এসে ডাক্তার না দেখিয়ে চলে যাবেন! আমি নিয়ে যাব আপনাকে। আপনি শুধু ডাক্তারের চেম্বারের অ্যাড্রেস, আপনার সিরিয়াল নাম্বার আর ডেট নিয়ে আসবেন।’
বাশার সাহেবকে চিন্তিত দেখায়। বলেন, ‘ওরা কি রাজি হবে।’
মতিন বলে, ‘আমার কথা বলবেন না। বলবেন একা যাবেন। ঢাকা শহরে কাউকে বিশ্বাস নেই। সেইজন্য কেউ কারও সঙ্গে যেতে দিতে রাজি হয় না। একা গেলে অসুবিধা নাই। আমি নিয়ে যাব আপনাকে। নাহলে তো আপনার ডাক্তার দেখানো হবে না।’
বাশার সাহেব রাতে মেজো ছেলে তৌহিদের সঙ্গে আলাপ করেন। মতিনের কথা কিছু বলেন না। তৌহিদ আমতা আমতা করে বলে, ‘আমিই আপনাকে নিয়ে যাব ঠিক করেছিলাম। অফিসের এমন এক ঝামেলায় পড়েছি। একটু যে আগে বেরুব তারও উপায় নেই।’ তৌহিদ ফোন করে ছোটভাই রুলিনকে। রুলিন জানায় অফিসের কাজে হঠাৎ আজই তাকে চিটাগাং চলে যেতে হয়েছে। রুলিনের বউ শম্পা ফোন ধরে বলে, ‘ইয়া আল্লাহ! ভাইয়া কী করি বলেন তো! পিকুর স্কুল। ওকে আবার কোচিংয়ে নিতে হয়। শিখুর সকাল থেকে গা গরম।’ তৌহিদ ফোন করে ওদের সবচেয়ে ছোটভাই কচিকে। কচি বলে, ‘সামনের সপ্তাহে হলে হয় না মেজভাই? এই সপ্তাহ জুড়ে আমার টাইট সিউিউল।’ নিরূপায় হয়ে তৌহিদ বলে, তামান্নাকে বলে দেখব নাকি, ও যদি আপনার সঙ্গে যেতে পারে।’
জামাই আবার কি মনে করে ভেবে মেয়েকে সঙ্গে নিতে রাজি হন না বাশার সাহেব। বলেন, ‘না না ও আমি একাই পারব। তুই আমাকে ডাক্তারের চেম্বারের ঠিকানাটা ভালো করে লিখে দে।’
পরদিন ঠিকানা নিয়ে বাশার সাহেব মতিনের সঙ্গে ডাক্তার সালামের চেম্বারে উপস্থিত হন। ডাক্তার কিছু টেস্ট দেন। মতিন বাশার সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে ডায়াগোনেস্টিক সেন্টারে যায়। ফিরতি পথে বাশার সাহেব মতিনকে বলেন চল হাঁটি। ওরা ধানমণ্ডি লেকের পাড় ধরে হাঁটে। বাশার সাহেব অনর্গল কথা বলে চলেন। যেন তার অনেক দিনের জমানো কত কথা তিনি বলতে চান।
বিকেলে খিলজি রোড়ের পার্কে বসে একদিন মতিন বাশার সাহেবকে চা খাওয়ায়, একদিন বাশার সাহেব মতিনকে চা খাওয়ান। বেশ কাটে দু’জনার দিন।
দুইদিন পরে ডায়াগোনেস্টিক সেন্টার থেকে রিপোর্টগুলো নিয়ে মতিন আবার ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যায় বাশার সাহেবকে।
বাশার সাহেব বিব্রত হয়ে মতিনকে বলেন, ‘তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি। তোমার কত কাজের ক্ষতি করলাম আমি।’
মতিন বলে, ‘না! ক্ষতি কিসের। আমি অফিসে মাল সাপ্লাই দিই। দুই তিনদিন কাজ না করলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। আপনার সঙ্গে আছি, বড় আরাম পাচ্ছি।’
বাশার সাহেবের খুব ইচ্ছা করে ছেলেবেলার বন্ধু আব্দুল গফুরের সঙ্গে একবার দেখা করেন। ঠিকানা লেখা আছে নোটবুকে। কচুক্ষেতে বাসা। মতিনকে ইচ্ছার কথা জানাতেই মতিন রাজি হয়ে যায়। বাশার সাহেবকে নিয়ে শ্যামলী থেকে বাসে ওঠে মতিন। মিরপুরে গিয়ে বাস থেকে নেমে রিকশা নেয়। গল্প করতে করতে ওরা কচুক্ষতের দিকে যায়। গলা নামিয়ে যেন রিকশাওয়ালা শুনতে না পায় এমনভাবে ফিসফিস করে মতিন বলে, ‘এই যে আংটিটা হাতে দিয়ে ঘোরেন, কত রকমের খারাপ মানুষ আছে ঢাকায়। কোপ দিয়ে দেখা গেল হাতের কব্জি থেকেই নিয়ে গেল। হাত সব সময় সাবধানে রাখবেন।’
বাশার সাহেব বলেন, ‘বড় ছেলে অফিসের কাজে জোহানেসবার্গ গিয়েছিল। হিরার দেশ। একটা আংটি নিয়ে এসেছিল আমার জন্য। এখন আর হাত থেকে খুলতে পারি না।’
বুকের রক্ত ছলাৎ করে ওঠে মতিনের। ওর অনুমান সত্য। হিরার আংটি। খাঁটি হিরা। লাখটাকার ওপরে দাম।
ফেরার পথে মতিন জটিল চিন্তায় আটকা পড়ে। এই কয়দিন কাজ বন্ধ। টাকাপয়সা শেষ। আংটি হাতানোর কোনো মতলব সে এখনো এঁটে উঠতে পারেনি। একবার মনে হলো, আংটিটা কেড়ে নিয়ে রিকশা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে নাকি বুড়োকে। বাশার সাহেব বললেন, ‘বুঝলে মতিন! জগন্ময় আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমি আর ও স্কুল-কলেজ একসঙ্গে পড়েছি। কতদিন পর দেখা হলো আমাদের! কত কথা হলো। ভালো লাগছে ভীষণ।’ বাশার সাহেবকে খুব সুখী একজন মানুষ মনে হয়।
সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে মতিন ওদের বস্তির শেষ মাথায় খালের ওপরের টং ঘরটাতে ঢোকে। বেশ বাদশাহী হাক দিয়ে বলে, ‘বিল্লাল বোতল দে।’
টং ঘরের বিল্লাল এসে মতিনের সামনে দাঁড়ায়। মতিন বলে, ‘দেখ তো ঝিন্টুর মা চিংড়ির মাথা ভাজে কিনা। ভাজলে দুটো চিংড়ির মাথা আর একটা টিকিয়া নিয়ে আয়। বোতল দে। গ্লাস দে।’
বিল্লাল বলে, ‘আগের টাকাগুলোও আজ দিবি তো।’
মতিন বলে, ‘দেব দেব, এই সপ্তার মধ্যে তোর সব টাকা পয়সা বাকি-বুকি শোধ করে দেব। কসম।’
পরদিন বাশার সাহেব বায়না ধরেন রমনা পার্কে যাবেন। বাশার সাহেবকে নিয়ে মতিন রমনা পার্কে যায়। বাশার সাহেব ফুচকা খান। তৃপ্তি করে খান। মতিন খাওয়ায়। ফেরার পথে তিনি মতিনকে সঙ্গে নিয়ে শপিং মলে ঢোকেন। নাতনির জন্য বেশ বড়সড় দেখে একটা পুতুল কেনেন।
বাশার সাহেব বলেন, ‘ঢাকা শহরে এসে আমার কখনোই দুই তিনদিনের বেশি থাকতে ইচ্ছে করেনি। বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য হাঁপিয়ে উঠতাম। বাড়ি গেলে ছেলেমেয়েদের জন্য কষ্ট হয়। নাতি-নাতনিদের কাছে পেতে ইচ্ছা করে। বছরে সেই কখন একবার ওরা যাওয়ার সময় পায় কি পায় না। আবার ঢাকাতে যখন আসি তখন সবার সঙ্গে যে সব বার দেখা হয় তাও না। একেকজন থাকে শহরের একেক মাথায়। আমি এই বয়সে একা একা চলাফেরা করতে পারি না। এবার তোমাকে পেয়েছিলাম তাই ছেলেমেয়ে সবার সঙ্গে দেখা হলো। নাতি নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারলাম। এর ভেতর আবার মেয়ের শ্বশুর বাড়ি নারায়ণগঞ্জেও নিয়ে গেলে। তোমাকে কত কষ্ট দিলাম বলো তো। কিন্তু বেয়াই-বেয়ান কত খুশি হলো, দেখলেই তো। সময় পেলেই দিনাজপুর চলে আসবে তুমি। নিজের বাড়ির মতো যতদিন ইচ্ছা থাকবে।’
মতিন বাশার সাহেবের কথায় চমকায় একটু। এখনো আংটি বাশার সাহেবের আঙুলে। মতিন জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি ফিরছেন কবে?’
‘পরশু সকালের বাসে রওনা হব। রুলিন টিকিট কেটে দিয়ে গেছে। দেখ কী কাণ্ড, চিটাগাং থেকে শুটকি মাছ নিয়ে এসেছে আমার জন্য। সেই শুটকি দিনাজপুরে কে রান্না করবে? আমি ওকে বললাম, যা তোর বউকে বলিস তোকে রান্না করে খাওয়াতে।’
হা হা করে হাসলেন বাশার সাহেব। নিজের হাসির শব্দে নিজেই অবাক হলেন। এমন শব্দ করে জোরে অনেকদিন তিনি হাসেননি।
পরদিন সকালে বাশার সাহেবকে নিয়ে মতিন বাসে ওঠে শাহবাগে যাবে বলে। বাশার সাহেব মিউজিয়াম দেখবেন। ওখান থেকে যাবেন বাংলা একাডেমি। কয়েকটা বইয়ের তালিকা করেছেন। বই কিনবেন। কিছু বই কিনতে শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে আসতে হবে বলেছে মতিন।
বাস কারওয়ান বাজার ছাড়ার পর মতিন বাশার সাহেবকে বলে, ‘চাচা উঠে গেটের কাছে দাঁড়ান। আমাদের সামনে নামতে হবে।’
বাশার সাহেব নিজের সিট ছেড়ে বাসের গেইটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে মতিন তাঁর গাঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। বাস বাংলা মোটরে এলে মতিন বলে, ‘ড্রাইভার সাহেব একটু স্লো যান, নামব।’
কন্ডাক্টর বলে, ‘ডাইরেক্ট বাস। এইখানে থামত না।’
মতিনের কণ্ঠে অস্থিরতা। বলে, ‘দ্যাখো না বুড়া মানুষ নামবে।’
ড্রাইভার গাড়ি স্লো করতেই বাশার সাহেব পেছন থেকে জোর একটা ধাক্কা অনুভব করেন। আচমকা এমন ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে তিনি ছিটকে রাস্তার ওপর পড়ে যান। বাস পাশ কেটে সাঁ করে বেরিয়ে যায়। রাস্তার ওপর পড়ে তিনি হাঁটুতে আর কাঁধে বেশ চোট পেয়েছেন। আশেপাশের লোকজন ছুটে এসে ঘিরে ধরে। সবাই চিৎকার করে একজন আরেকজনের কাছে জানতে চায়, কী করে ঘটল? তখন বাশার সাহেব খেয়াল করেন ভীড়ের ভেতর কেউ একজন তার হাতের আঙুল থেকে আংটি খোলার চেষ্টা করছে। তিনি শরীরে যতটুকু শক্তি আছে সেটুকু কাজে লাগিয়ে মোচড় দিয়ে সেই হাতটা চেপে ধরেন। ধরা পড়ে যায় মতিন। বাশার সাহেবের শক্ত করে এটে ধরা হাতের ভেতর থেকে নিজের হাতটা ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে। মানুষের চাপাচাপিতে মতিন ঝুঁকে পড়ে বাশার সাহেবের মুখের কাছে। বাশার সাহেব কাতর কণ্ঠে বলেন, ‘ওটা আমার বড় ছেলের শেষ স্মৃতিচিহ্ন। ছেলেটা গতবছর রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।’ বলেই জ্ঞান হারান।
জ্ঞান ফিরে তিনি দেখেন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। মতিন বসে আছে পাশে। ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে ঝাঁপসা ভাবটা সরে গিয়ে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে আসে। তিনি মতিনের মুখটা পরিষ্কার দেখতে পান। স্থির দৃষ্টিতে তিনি মতিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্যান্টের পকেট থেকে মতিন আস্তে আস্তে আংটিটা বের করে। বাশার সাহেবের হাতে আংটিটা দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে। হাত বাড়িয়ে আংটিটা নিয়ে বাশার সাহেব বলেন, ‘আমার বড় ছেলেটা ছিল খুব সরল। দেশে আনার পর জানতে পারে আংটির হিরা নকল। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল সে মনে। নিজেকে কেমন অপরাধী ভাবত। সব সময় মনে করত, সে বাবাকে একটা নকল হিরার আংটি দিয়েছে। ছেলের স্মৃতি ধরে রাখতে সেই নকল হিরার আংটিই আঙুলে পরে থাকি।’
মতিন মুখ তুলে তাকায়। বাশার সাহেব বলেন, ‘তুমি আমার নকল হিরার আংটি নিয়েছিলে, তা-ও ফেরত দিয়ে দিলে। কিন্তু গত দশদিন আমি তোমার কাছ থেকে সত্যিকারের যা নিয়েছি, তা তোমাকে ফেরত দেব কেমন করে!’
বাশার সাহেবের ছেলেমেয়েরা খবর পেয়ে ছুটে আসে হাসপাতালে। বাবার বিছানার পাশে ভিড় করে দাঁড়ায়। সেই ভীড় পাশ কাটিয়ে মতিন নিঃশব্দে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন