আবু আল সাঈদ -এর গল্প

একজন শ্রমিকের ঈদ
আবু আল সাঈদ


   হয়তো বিশেষ কোন কারন ছাড়াই আব্বা আমার নাম রেখেছিলেন  দুলাল। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা দু'টোই ধরলার কিনার ঘেসে দাড়িয়ে থাকা কুড়িগ্রামের এক চরাঞ্চলের আলো বাতাসে। আমার প্রিয়তম  পিতাই প্রথম আমাকে  দারিদ্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তখন থেকেই দারিদ্রের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক।
   ফলাফলের অপেক্ষায় না থেকে, মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই চলে আসি ঢাকায়-টাকার সন্ধানে। নিজেকে নিয়োজিত রাখি একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কাজে। আমার সহোদর সেখানে কর্মরত থাকায় কাজটা পেতে সহজ হয়। বেঁচে থাকবার মত কিছু খেয়ে, মাথা গুঁজাবার মত জায়গায় থেকে-স্বল্প বেতনের বাঁচিয়ে রাখা অল্প কিছু টাকা বাসায় পাঠাই। বাবার মুখে তাতেই ফুটে ওঠে একটা তৃপ্তির হাসি। নিজেকে তখন সরকারি চাকুরীজীবীদের মত গর্বিত লাগে। বাবাও হয়তো তার দিনমজুর বন্ধুর সঙ্গে আলাপকালে আমায় নিয়ে গর্ব করে বুকের মাংস ফুলাতেন।
   গত ঈদ-উল-আযহায় বাড়িতে আসা হয় নি। বিড়ম্বনাকে হাতে রেখে শুধুমাত্র যাওয়া আসা করতেই লাগে  অনেক টাকা। এ কারনে আর আসার সাহস সঞ্চারণ করা হয় নি। টাকার অভাবের ছায়ায় নিজেকে আড়াল করে রেখেছিল ঈদের আনন্দ। প্রিয় মানুষদের সঙ্গে ঈদ করতে না পারার কষ্টটা সেবারই প্রথম বুঝলাম। বাবা-মাও যে অনেক কষ্ট পেয়েছেন সেটা ফোনেই বুঝেছি। অন্য রকমের একটা অসহ্য যন্ত্রনা বুকে এসে বিঁধছিল।
   এবার বাড়িতে আসছি। আমার বাড়ি। আমার চিরচেনা এলাকা। বাড়ি আসছি জন্য হাসি লেগে থাকা মুখে বেশ প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভালো লাগার এক অন্য রকম মহূর্ত। ব্যাপক উত্তেজনাকে চাপিয়ে রাখতে পারছি না কিছুতেই। সবমসয়ই বাড়ির কথা, বাড়ির মানুষের কথা মনে পড়ছে। সময় এগুচ্ছে না। মনে হচ্ছে সময় থমকে দাড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। উৎফুল্ল মনে নিচ্ছি সাধ্যের সুতায় পেঁচানো বড় রকমের প্রস্তুতি। বেতন-বোনাসের টাকা হাতে পেয়েছি। ভাল লাগার উষ্ণতা আরো বেড়ে গেল। যেটা করছি সেটাতেই আনন্দ পাচ্ছি।
   বারবার ফোনে কথা বলছি বাসায়। কারণে, কখনো অকারণে। ধনাঢ্যদের মত কার কী লাগবে জানতে চাচ্ছি বারবার। বাবার জন্য একটা ধবধবে সাদা পান্জাবি আর একটা লুঙ্গি, মায়ের জন্য একটা ১৫০০ টাকা দামের শাড়ি কিনেছি। মা এত টাকা দামের শাড়ি কখনোই পড়ে নি। মাকে অনেক সুন্দর মানাবে শাড়ির সবুজ পাড়ে। মা শাড়ি দেখে হয়তো অনেক খুশি হবেন। কত্ত সুন্দর করে একটা মুচকি হাসি  আঁকবেন মলিন হয়ে যাওয়া ঠোঁটে, সেটাই ভাবছি। বোনের জন্য একটা টকটকে লাল জামা আর বোনটার প্রিয় এলিট রাঙা মেহেদী কিনেছি। পাগলিটা ফোন করেই আগে মেহেদীর কথা বলে, এলিট রাঙা মেহেদী। দেখে কিনতে সে কি উপদেশের বাণী। অন্য মেহেদীগুলোতে নাকি তেমন রং ধরে না। মেহেদী পাওয়ার পর ও হয়তো অল্পক্ষণের জন্য ভুলে যাবে ৪০০ কি.মি. জার্নি করে আসা ভাইটা এখন খুব ক্লান্ত। এসব ভাবনা দূরে সরে দিয়ে আপাতত গুছিয়ে নিচ্ছি কাপড়, ঢুকিয়ে রাখছি ব্যাগে।
   দুই দিন আগে ছুটি পাওয়ায় আমি এবং আমার ভাই সেদিনই রাত্রে গাড়িতে উঠলাম। ভাল কোচগুলোতে এমনিই টিকেটের দাম বেশি। ঈদে তার উপর অনেক বাড়তি ভাড়া। ৫০০ টাকার টিকেট ৯০০ টাকা। ওসবে বড়লোকেরা উঠে, আমাদের মত খেটে খাওয়া শ্রমিকরা না। ভাই আমাকে টিউটরের মত বুঝিয়ে দিলেন। পরম ভদ্রতার স্বভাব সুলভ  আচরনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি মাথা নাড়লাম আমরা লোকাল কোচে উঠলাম। ভাড়া কম ৫০০ টাকা। কিছু টাকা সেভ করে বাড়ি যাওয়ার সুযোগে আমরা আনন্দিত। অনেক কষ্টে ভিতরে ঢুকে আমরা আমাদের সিটে বসে পড়লাম।
   ভিতরে সংকীর্ণতা। অসহ্য গরম। পুরো বাস লোকে গাদাগাদি। গার্মেন্টস এ ঢোকার সময় যে উপচে পড়া ভিড় রোজই লক্ষ্য করি তার চেয়েও বেশি ভিড়। মানুষের উপর সাজিয়ে রাখছে মানুষ। চিৎকার চেঁচামেচি চলছেই। অনেক মানুষ ভিতরে দাঁড়িয়ে। বাসের গর্ভে অসংখ্য মানুষের চাপাচাপিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। বাবা কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিচ্ছেন। বাবার এমন আচরনে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। পাশের ছিটে বসা ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছি মাঝেমধ্যে। সৌজন্যতাবোধ রক্ষার্থে যেমন গল্প করতে হয় ঠিক সেরকমই। ভাই আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় হওয়ায় ভাইয়ের সঙ্গে আমি তেমন একটা ফ্রি না। দূরত্ব রেখে এড়িয়ে চলি বেশিরভাগ সময়।
   রংপুরের মিঠাপুকুরের দিকে এসে হঠাৎ পৃথিবী দুমড়ে মুচড়ে উঠল বলে মনে হল। সবার সজোড় চিৎকারে মনে হল পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে। আমিও চিৎকার করছি। প্রচণ্ড-প্রচণ্ড রকমের কষ্ট এসে আমার সমগ্র শরীর দখল করে নিল। তারপর কী হয়েছে আমি তেমন কিছু বলতে পারিনি। পরে যখন হুশ হল আমি নিজেকে  দেখলাম রংপুর মেডিকেলের একটা ছোট্ট বেডে। চারদিক জুড়ে শুধু কান্না আর কান্নার চিৎকার। কান্নাই যেন সেখানকার মাতৃভাষা। আমার থেকে  কিছুদূরে একটা সাদা কাপড়ে মোড়া লাশের সামনে চিৎকার করে করে কাঁদছে আমার বাবা-মা-বোন। উঠতে শক্তি না পাওয়ার কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম আমি বেঁচে থাকলেও আমার পা দুটো আর বেঁচে নেই।

আবু আল সাঈদ
সাতক্ষিরা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন