দীপু মাহমুদ -এর গল্প

ফেসবুক ভালোবাসা
দীপু মাহমুদ


অহনা
জলের ভেতর ভেসে উঠলাম আমি। ঢেউয়ের উপর তিরতির করে ভেসে রইলাম। জল উথলে উঠেছে চাঁদের আলোয়। ঝকঝকে জলের তিরতিরে ঢেউয়ে বিশাল চাঁদ ভেসে যাচ্ছে। চাঁদের আলো ঢেউয়ে মিশে ফিরে আসছে জোছনা হয়ে। আমি জলের দিকে তাকিয়ে আছি চুপচাপ। আমি চাঁদের আলোয় জলের ভেতর আমাকে দেখি। আমি নার্সিসাস হই।
   আমার ভয় করে। যা আড়ালে ছিল একান্ত মনের গভীরে। তা এমনভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ল! 
আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে আসে। রুদ্রকে আমি দেখিনি। ফেসবুকে পরিচয়। প্রোফাইল দেখে ভালো লেগেছে। ভদ্র, মার্জিত। ফেসবুক ইনবক্সে কথা হয় টুকটাক।
   রুদ্রকে মেসেজ পাঠালাম, এখন আমি কোথায় বলো তো। রুদ্র লিখল, জলের উপর। জলপরি হয়ে তুমি জলে ভাসছ। আমি অবাক হলাম। রুদ্রর তো জানার কথা না। আমি রাতের দ্বিতীয় প্রহরে জলের ধারে বসে আছি। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। আমি জলে ভেসে যাচ্ছি।
   জানো রুদ্র! আমি আজ অনেক সেজেছি। কপালে বড় একটা টিপ দিয়েছি। মনে হলো তোমার পছন্দ। সাদা শিফনের শাড়ি পরেছি। জোছনায় মিশে যাবো বলে। বনের ভেতর পাহাড়ে জোছনা হয় অন্যরকম। চাঁদের কোমল আলো ছড়িয়ে পড়েছে গাছে। পাতার ফাঁক গলে জোছনার মায়াময় আলো বিছিয়ে আছে মাটির উপর। ইচ্ছে করছে তোমার হাত ধরে হাঁটি। এই বনভূমির মধ্যে আমরা দু'জন মাত্র মানব-মানবী।
   পাহাড়ের উপরে আমার থাকার ঘর। পাহাড় বেয়ে লম্বা গাছের সারির ভেতর দিয়ে আমি নেমে এলাম নিচে। ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। এখানকার মানুষ বলে ছড়া। ঝরনার ঝকঝকে পানির দিকে তাকিয়ে আমি মুগ্ধ হলাম। জলের ধারে গিয়ে বসলাম।
   রুদ্র আমার ঘন দীঘল চুলের ভেতর নাক ডুবিয়ে বলল, অহনা! আমি বুকের অতল গভীরে বাতাস টেনে নিলাম। আলতো করে চোখ বুজে বললাম, উ! আমার কাঁধে থুতনি রাখল রুদ্র। গলা বাড়িয়ে গালে গাল ছোঁয়াল। ফিসফিস করে বলল, তোমাকে অসাধারণ লাগছে। যেন ছুঁয়ে দেখতে গেলেই মিলিয়ে যাবে তুমি। আমি বললাম, এইতো তুমি আমাকে ছুঁয়ে আছো। রুদ্র আমাকে ছুঁয়ে নেই। আমি কল্পনায় রুদ্রকে আমার পাশে নিয়ে এসেছি।
   আসার পথে যখন শহর বিদায় নিয়েছে। শান্ত হয়ে এসেছে খানিকটা চারপাশ। রুদ্রর ইনবক্সে লিখলাম, বান্দরবান যাচ্ছি। কেন লিখলাম। তার কোনো ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। আর কারও কথা মনে না হয়ে সহসা রুদ্রর কথা কেন মনে হলো সেটা আমার কাছে বিস্ময়। সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি মেসেজ এলো, বান্দরবানে কেন? জানালাম, অফিসের রিট্রীট। পৌঁছানোর পর রুদ্রর আরেকটা মেসেজ পেলাম, ভালোভাবে পৌঁছেছেন আশা করি। ভালো থাকবেন। অদ্ভুত এক ভালোলাগা উষ্ণ চাদরের মতো আমাকে জড়িয়ে নিল।
   এক দঙ্গল বন্ধু আমার। সন্ধ্যা হলেই আড্ডায় মাতি। ওরা কি আমার প্রতি এমন কেয়ারিং! আসার সময় কেউতো বলল না, ভালো থাকিস। ভালো থেকো। টেক কেয়ার। গতদিনের আধ-খাওয়া হুইস্কির বোতল খুলতে খুলতে আফনান বলল, জংলিরা কিন্ত হেব্বি ডেঞ্জারাস। তোকে যদি ধরে নিয়ে যায়? শেখর তখন গ্লাসে সবার জন্য সমান ভাগ করে হুইস্কি ঢালছে। বলল, জানিস, বান্দরবানে এখনো এমন আদিবাসী দেখা যায় যারা জামা-কাপড় পড়ে না। মামুন গম্ভীর গলায় উপদেশ দিল, তুমি যেন ওদের মতো হয়ে, ওদের সঙ্গে থেকে যেয়ো না। এই লেকের ধারে আমাদের নিয়মিত আড্ডা। আমরা অফিস শেষে এখানে এসে বসি। চুটিয়ে আড্ডা মারি। ড্রিঙ্ক করি। তবে মাতাল হই না।
   বান্দরবান থেকে ফেরার দিন রুদ্রকে লিখলাম, আজ ফিরছি অন্যরকম এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে। বলে বোঝাতে পারব না। আমার ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে আছে। কীসের জন্য যেন তোলপাড় করে যাচ্ছে।
   রুদ্র লিখেছে, আমি তোমার প্রতিক্ষায় এ শহর আগলে বসে আছি।

রুদ্র
আমি তাকালাম অহনার মুখের দিকে। অহনা কাঁদছে। টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। অহনা ঝরনার জলের পানে চেয়ে আছে অপলক। আমার কল্পনায় অহনা। না আমি, না অহনা কেউ কোন কথা বলছি না। চুপচাপ ছোট্ট ট্যাবের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি। অহনা লিখেছে, লিখতে ইচ্ছা করছে আমার ভালোলাগা আর ভালোবাসার কথা। আমি আজ যাকে লিখছি, তাকে আমি ভালোবাসি কিনা জানি না। ভালোবাসা কাকে বলে তাই জানা হলো না কোনোদিন। তবুও সেই শব্দটাই ব্যবহার করছি আমার অনুভূতির গভীরতার জন্য।
   কোথাও দাঁড়াতে চেয়েছিলাম আমি। পারিনি। হেরে গেছি। নিঃসঙ্গতা আর ভেতরের অসহায়ত্ব আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। হেরে গেলাম বলছি মানে আমি জিততে চাই। প্রবলভাবে চাই। হেরে গেছি এটা নিশ্চিত হওয়া গেলেই কেবল জিতে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়। বড় নাজুক আমি। বেশ পলকা। শুধু ভেঙে ভেঙে যাই। কেউ যদি আমাকে শক্ত করে বাঁধে তবে কাজটা আমার সহজ হয়ে যায়। আমি জানি অহনা আমার ভেতর প্রেরণা হয়ে এসেছে। আমি জিতব ওকে নিয়ে।
   বনভূমি ছেড়ে শহরের পানে ছুটছে অহনার গাড়ি।
   অহনা লিখল, আমার ভয় করছে।
   কিসের ভয়।
   জানি না। কী করছি। কোথায় যাচ্ছি আমরা।
   ভয় কিসের। আমরা তো টিনএইজ না, দু'জনই ম্যাচিউর। যা করছি, জেনে-বুঝেই করছি।
   আমি জানি। তোমার সঙ্গে আমার আর কোনোদিন দেখা হবে না।
   কেন?
   তোমার কথা ফিরিয়ে দিই তোমাকে। আমরা দুজনই ম্যাচিউর। আমাদের দেখা-সাক্ষাতের দরকার নেই। আমরা সব বুঝি।
   তুমি চালাকি করছ। তোমাকে না দেখলে আমার ভালো লাগবে না।
   দেখাদেখির কিছু নেই।
   অহনাকে নিয়ে এই শহরে ঢুকছে গাড়ি। আমি শহর আগলে বসে আছি। শান্ত বিশাল ওই প্রকৃতি থেকে কতদূরের এই শহর গিলে খাচ্ছে সবকিছু। অহনা ঢুকে পড়ছে শহরের গহবরে।
   কতদূর এলে।
   কাছাকাছি। যা ট্রাফিক জ্যাম। ফাড়ির হর্ণ। মাথা ঝালাপালা।
   তোমার সঙ্গে আজ দেখা করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
   কোথায় আসবে বলো।
   শিল্পকলা ছাড়া তো আর কোনো জায়গা জানা নেই আমার।
   তবে শিল্পকলাতে এসো।
   বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। আমি প্রতীক্ষায় থাকি। এই বুঝি অহনা এলো। অহনা বুঝি মেসেজ পাঠাল, রিচড সেফলি। অহনা কোনো মেসেজ পাঠাল না। ফোন করলাম। ধরল না। জার্নিতে নিশ্চয় অনেক টায়ার্ড। অহনাকে লিখলাম, তোমার ঘুম দরকার। হ্যাভ অ্যা নাইস স্লিপ।

নান্দীকর
শিল্পকলার সিঁড়িতে ঠাঁয় বসে আছে রুদ্র। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে। ম্যাটম্যাটে আলোতে অযাচিত পোকায় ভরে যাচ্ছে চারপাশ। রুদ্র তাকায় আকাশের পানে। তারাগুলো খুব ছোট হয়ে গেছে। অনেকদূরে তারাগুলো স্থির। ঝিকিমিকি করে না। রুদ্র বারবার ফেসবুকে ইনবক্সের দিকে তাকাচ্ছে। অহনার কোনো মেসেজ এসেছে কিনা খোঁজে। রুদ্র সাতটা মেসেজ পাঠিয়েছে অহনাকে বিকাল থেকে। একটাও রেসপন্স করেনি।
   বান্দরবান থেকে ফিরে অহনা ছুটেছে বন্ধুদের আড্ডায়। ফোনের পরে ফোনে বন্ধুরা অস্থির করে তুলেছিল। চলে আয়। জমাটি আড্ডা হবে আজ। সন্ধ্যার পর ওরা গিয়ে বসে লেকের পাড়ে। শেখর ব্যাকপ্যাক থেকে ভদকার বোতল বের করে। ছোট গ্লাস। কোল্ড ড্রিঙ্কস। চানাচুর। বাদাম। অহনা বলল, এ কি করেছিস রে!
   অহনা ঘরে ফিরেছে অনেক রাতে। ফেসবুকের ইনবক্সে গিয়ে রুদ্রকে লিখল, স্যরি। যেতে পারিনি। মাত্র বাসায় ফিরলাম। আজ একটু হার্ড ড্রিঙ্কস নিলাম। তাই ঝিমঝিম অবস্থা। তবে মাতাল নই। কী ভেবে মেসেজটা সেন্ড করল না। অ্যাকশন বাটনে ক্লিক করে ডিলিট কনভার্সনে চাপ দিল। মুছে গেল রুদ্র-অহনা সমস্ত কথোপকথন।
   পরদিন অফিসে ফিরে প্রতিদিনকার ব্যস্ততার মধ্যে ডুবে যেতে হয় অহনাকে। রুদ্র মেসেজ পাঠায়, কী করো? ফিরতি মেসেজ আসে। অহনা লিখেছে, কাজের ভেতর ডুবে আছি। ভীষণ ব্যস্ত। রুদ্র লেখে, ফ্রি হবে কখন? সেই মেসেজ কেউ দেখে না। স্ক্রিনের দিকে স্তব্ধ তাকিয়ে থাকে রুদ্র। নির্বাক। উত্তরহীন হয়ে থাকে ফেসবুকের মেসেজ ইনবক্স। অহনাকে গিলে খায় শহুরে কিংক্রিটের বেমানান জীবন।

দীপু মাহমুদ
ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন