নির্ঝর নৈঃশব্দ্য-এর মুক্তগদ্য


অন্ধকারের পিঠে 


সূর্য ও সূর্যমুখীর মাঝখানে বাতাসের আসা-যাওয়া হয়ে গেছি কোনোদিন। আর মাথার ভিতর খেলা করেছে অপরকান্ত রোদের নিষিক্তি। তারপর আমি প্রতিদিন দিনশেষে খুব চুপিচাপ নৈশভোজের দিকে এগিয়ে গেছি, মোমের মন্দ্র আলোর ভিতর দিয়ে। কেউ আমার নিজের ছায়ার ভিতর থেকে আমাকে বলেছে, তুমি খেয়ো না আর ডাল আর শিম। মাছের মাথা ও কাঁটা বেড়ালকে দিয়ে দাও। বেড়াল তোমার নখে নখে ঘুরবে, নখরা করবে, খেলবে, দুলবে; কোলে বসে মাতৃদুগ্ধের সন্ধান করবে। তুমি বেড়ালের মা হলেও ক্ষতি নেই। তখন আমি তোমার অধরে ওষ্ঠাধর রেখে পান করবো তিনমাইল রক্তজবার বন। দোহাই তোমার, বাঁচার জন্য খাও। খাওয়ার জন্য যদি বাঁচো, আমার ছায়াটিও তোমাকে ছোঁবে না। হারাধনের ডিসপেনসারিতে কালিজিরার তেল প্রতীক্ষা করবে তোমার পথ চেয়ে। তুমি সর্বরোগের মহৌষুধ খেয়ে সাড়ে তিনহাত ঘরে শুয়ে শুয়ে দেখবে তোমার বুকের ওপর উদ্গত হচ্ছে লাল লাল মসুরের ডাল। আহা, খেজুরের কাঁটায় বিদ্ধ তোমার যকৃতে আর ফুটে ওঠবে না রতিপুষ্প। তোমার রক্তে পিউরিন বেড়ে গেছে উষ্ণ চুম্বনেই ঘন্টা বেজে যায়। 

নৈশভোজ কথাটা মনে হলেই আমার যিশুর শেষ খাওয়ার কথা মনে পড়ে। উম্মত বেষ্টনির ভিতর যিশু শেষবারের মতো খায় পরিব্যাপ্ত রুটি, সহসা আলো নিভে যায় মেরি ম্যাগদালিনের কৌমার্যের বামপাশে কৌণিকভাবে। আলো নেভার আগে জানতে পারি না আলোর গন্তব্য, বুঝি না আলো নিভে কোনখানে যায়। এইভাবে আলো আলো করে ঘুমের মধ্যে ঘরের দেয়ালে একটা বোকা টিকটিকির লেজ খসে যায়। আর একটা জুনিপোকা তা দেখে। তারপর আলোর মধ্যে জ্বলে নিভে যায় তার বুকের লুসিফেরিন। তিনশোমাইল বেগে টিকটিকির লেজ ছুটে যায় ছায়ালীন আফিমের বনে। আফিমবনের ছায়ায় বুড়ো গোরখোদক কারো প্রেতাত্মা তাড়ায়। প্রেতিনী তার ডানকাঁধে বসে ডাকে তিনটিপাখির নাম। ওইধারে আমার পিতার তরুণ কবরের জৈব খেয়ে বেড়ে ওঠে অড়হড়রে ডাল। অড়হড়রে পুষ্ট লতা কবরে উলম্ব পুঁতে দেয়া খেজুরের ডালে জড়িয়ে আকাশগামী হয়। আকাশে দীঘল প্রলাপ বাজে। কে করে প্রলাপ? ঈশ্বর নাকি! তার প্রলাপ ঘিরে দুইটা পাগল করে আরো দীর্ঘ বিলাপ। 

চোখের ভিতর দুপুর। দুপুরে টলটলে রোদ নামে। আমার নিঃসঙ্গ ছায়াটাকে আঁকে, সবিনয়ে আমাকে উপহাস করে। অমৃত যৌবনের লোভ দেখায় আমাকে। নির্বাসন থেকে ফিরে আমি কতোকাল বুকে বাঁধি হংসধ্বনি! নারী আর রতি এসে তাকায় স্বেদাতুর দেহে। কোথাও খাজুরাহের মন্দিরের গায়ে একটা টেরাকোটা ভাস্কর্যের নাম হয়তো আলাদা নয়। একটা পেয়ারার ত্বকের সবুজে বন্দী ভূমির ললিত সমুদ্রযাত্রা। সমুদ্র তার অশ্রুর বেড়িতে বেঁধে রাখে যে ভূমিতল, তার নাভীমূলে আমি মৃত্যুকে উপহাস করে জন্মাই বারংবার। একটা গভীর আলো ভাঙে অন্ধকারের পিঠে, দুইটা বাদুড় ডানার কানে পৃথিবী হয়ে ওঠে শব্দময়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন