শিস খন্দকার-এর গল্প


বিসর্গবিদ্যা


এক.

৮ই মে, অপরাহ্ণ। রিফাতের সামনে এসে আরেকবার ওড়নাটি ঠিক করে নিলো জয়ীতা। রিফাত বিব্রত চোখে ফিরিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। অকারণ। জয়ীতা হাসিমুখে সামনে দাঁড়ালো, 'তোমাকে কষ্ট করে আসতে হলো, তাই না?' রিফাতও হাসিমুখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, 'আরে না! কীসের কষ্ট?' অনতিদূরে ঝালমুড়ির দোকান থেকে চিল্লাচ্ছে, 'ঝালমুড়ি...এই ঝালমুড়ি।' জয়ীতা ওদিকটা তাকিয়ে, 'চলো ঝালমুড়ি খেতে কথা বলা যাক।'
—জানো, এটাই আমাদের ক্যাম্পাসের সেই ঝালমুড়ি, যেটার কথা তোমাকে ফোনে অনেকবার বলেছিলাম। কী...দারুণ না?
'হ্যাঁ, দারুণ।' ঝালমুড়ি মুখে দিতে দিতে রিফাত বললো।
—পৃথিবীর প্রতিটি নতুনই দারুণ। কখনো ভেবেছো, একটি নবজাতক শিশুকে? একজন নববিবাহিতা নারীকে? এরূপ প্রতিটি ক্ষেত্রই দেখো কীসব দারুণ একটা ব্যাপার থাকে, তাই না?
রিফাত ঝালমুড়ি খেতে খেতে হাসলো।
'এই যে উত্তরের এ শহরটা আজ তোমার কাছে নতুন। আমিও কিন্তু আজ তোমার কাছে খুব নতুন একজন মানুষ। তাই নয় কি?' হাসতে হাসতে বললো জয়ীতা।
রিফাত বললো, 'কবিরা খুব কথা বলতে জানে, তাই না?'
—সরি।
—আরে সরি কেনো? আমি এমনিতেই বললাম। তোমার কথা শুনতে ভালোই লাগছে আমার।
—থাক আর বিনয় দেখাতে হবে না। আজ অনেক কথা বলতেই তোমাকে ডেকেছি। বিরক্তিতে মরে গেলেও তোমাকে শুনতে হবে। এখন চলো।

ক্যাম্পাস থেকে বেড়িয়ে একটি পায়ে চালিত রিকশায় উঠলো দু'জনে। ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন জ্বলে উঠেছে মাত্র। অন্ধকার নামছে, বদলে যাচ্ছে শহরের রঙ। যন্ত্রচালিত ব্যস্ত রাস্তায় এগিয়ে যাচ্ছে একটি পায়ে চালিত রিকশা। ব্যস্ত শহরে রাত নামছে। 'টাউনহলের গেটে দাঁড়ান।' রিকশা টাউনহল চত্বরের গেটে দাঁড়ালো। 'কত দিবো মামা?'
রিকশাচালক দোর্দণ্ডপ্রতাপে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, 'আমাকে কি আপনার বাপের শাল লাগে?'
জয়ীতা বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে হেসে বললো, 'না। তবে, আমার বরের শালাও লাগে না আপনাকে। এই নিন ভাড়া।'

রিফাতকে নিয়ে জয়ীতা টাউনহল চত্বরে ঢুকলো। রবীন্দ্রজয়ন্তীর নানা আয়োজনে ভরে গেছে চারদিকটা। 'রিফাত, শিল্পকলার হলরুমে আমার স্বরচিত কবিতা পাঠ আছে। তোমার হয়তো ক্ষুধা পেয়েছে। একটু সময় দাও, এটা শেষ করেই আমরা রাতের খাবার করবো। কেমন?'
রিফাত সায় দিলো, 'সমস্যা নেই। তোমার কবিতা শোনার সুযোগ হলো।'

সাড়ে ন'টার দিকে টাউনহল চত্বর থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ হলো তাদের। 'অনেক দেরি করে ফেললাম। আমারও ক্ষুধা পেয়েছে, চলো আগে খাই।' জয়ীতা রিফাতকে নিয়ে ছোট একটা ভাতের হোটেলে ঢুকলো। 


দুই.

—রিফাত, তোমাকে কি আজ রাতে ঘুমোতে হবে?
—কেন?
—রাত আটটার পরে আমাদের হলে ঢোকার নিয়ম নেই, তাই আজ আর হলে যাচ্ছি না। চাইলেই তোমাকে নিয়ে কোনও হোটেলে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারি, কিন্তু তা উচিৎ হবে না। 
—তাহলে?
—তোমাকে নিয়ে উন্মুক্ত শহরের বুকেই রাতটা কাটাবো ভেবেছি। পারবে?
—সমস্যা হবে না তো?
—হলে হবে। আমি না শুনতে চাই না। এখন আমরা মেডিকেলে যাবো।
—মেডিকেলে কেন?
—আরে চলো তো।
ঘড়িতে রাত প্রায় এগারোটা। দশটায় বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় সকল দোকানপাট। মাঝেমাঝে দু-একটি খাবার হোটেল আর চা'র দোকান খোলা এখনো। নিস্তেজ শহর। জয়ীতা ও রিফাত হাঁটছে টাউনহল থেকে মেডিকেলের পথ ধরে। 

মেডিকেলে ঢুকলো দু'জনে। জয়ীতা রিফাতকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সোজা চার তলায় উঠলো। নিউরোসার্জারি বিভাগ। প্রতিটি বেডে রোগী শুয়ে আছে, ফ্লোরেও কিছু বেড পাতানো হয়েছে। নারী-পুরুষ, বাচ্চা-বুড়ো। কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ জেগে আছে। কর্নারে একটি বেডে এক মধ্যববয়সী মহিলা ঘুমোচ্ছে। মাথায় ব্যান্ডেজ। জয়ীতা পাশে বসলো। মহিলার হাতে স্পর্শ করতেই চোখ বন্ধ অবস্থায় বললেন, 'কে? জয়ী?'
—হ্যাঁ, মা।
—খেয়েছিস?
—হ্যাঁ, মা। 
মহিলা আরও কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ। বোঝা গেলো ঘুমিয়েছে আবার। জয়ীতা ধিরে ধিরে তার হাতটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পাশে দাঁড়ানো নার্সের সঙ্গে কয়েকটি প্রয়োজনীয় কীসব কথা সেরে নিলো সে। এতক্ষণ রিফাত এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। জয়ীতা 'চলো' বলতেই সংবিৎ ফিরে পেলো। 

জয়ীতা রিফাতকে নিয়ে চেকপোস্টের সামনের রাস্তাটা ধরে হাঁটছে। তখন রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহর। আকাশে মেঘ জমেছে, যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টির শীতল আবেশে ছেয়ে যেতে পারে চারদিক। চেকপোস্ট একটু পেরিয়ে কিছু তরুণীকে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তার পাশে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দেখা গেলো। কিছু কামাতুর পুরুষের কাছে তারা নিজেকে দরদাম করাচ্ছে। জয়ীতা রিফাতের একটি হাত চেপে হাঁটছে। কারা যেন পাশে বলাবলি করছে, 'বুকিং মাল।' রিফাত জয়ীতাকে বললো, 'দ্রুত চলো।'
জয়ীতা একটু হেসে বললো, 'কেন? ভয় হচ্ছে?'
রিফাত ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। কিছু না বলে নিঃশব্দে হাঁটছে। নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ পরপর দু-একটি বাস-ট্রাক রাতের বুক চিড়ে হর্ন বাজিয়ে ছুটছে।

জয়ীতা রিফাতের নীরবতা ভাঙলো, 'এদিকটা বেশ নির্জন, চলো বসি কিছুক্ষণ।'
—চলো।

বসার আগে রিফাত জয়ীতাকে আলিঙ্গন করলো, একটি দীর্ঘ চুম্বনের আশায় ফ্রেঞ্চ ঢঙে ঠোঁটে ঠোঁট মেলালো। জয়ীতা বাঁধা দিলো না।


তিন.

বাস টার্মিনাল। সকাল সাড়ে ছয়টা পেরিয়েছে। রিফাতকে গাড়ির টিকেট কনফার্ম করে দিলো জয়ীতা। সাতটায় গাড়ি ছাড়বে। কাউন্টারের বাইরে একটু পাশে একটি বেঞ্চে দু'জনে বসে। সূর্যটা মাথা চাড়া দিয়ে পূব আকাশে ভেসে উঠেছে কেবল।

—রিফাত, এক রাতের অতিথি হয়ে এসেছিলে, চলে যাচ্ছো। হয়তো যথেষ্ট সমাদর করতে পারিনি। তোমাকে আমি এ মুহূর্তে কিছু কথা বলবো। এরপর তোমার প্রতিক্রিয়া আমাকে জানিয়ে দিবে, তোমাকে আর কখনো সমাদরের সুযোগ পাবো কি না।'
—তুমি তো দেখছি অনেক কঠিন করেও বকতে পারো। বলো কী বলবে।
—চুপচাপ শুনবে কিন্তু?
—আচ্ছা, বলো।
—আমি জয়ীতা। উত্তরের নারী। তুমি রিফাত। দক্ষিণের পুরুষ। তবে উত্তর-দক্ষিণ মেরু তোমার আমার সম্পর্কের নেপথ্য কারণ নয়। কারণ একটি, নারী-পুরুষ। তুমি একটি বিষয় হয়তো জানো না, নারীরা প্রেমে পড়ে না, প্রেম করে। তোমরা পুরুষরা এর উল্টো। তুমি পুরুষ আমাকে ছেড়ে যেতে পারলে, আমি নারী তোমাকে ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা রাখি। রিফাত, আমি জানি, আমি কতটা রূপবতী। যার প্রমাণ, তোমার ছুটে আসা, এটা হয়তো ভালোবাসার ছুটে আসা নয়। আমি সুশ্রী চেহারর না হলে তুমি আসতে কি না, এর উত্তরে তুমিও দ্বিধাবিভক্ত।  
—কথা সংক্ষেপ করো। গাড়ি ছাড়বে তো।
—সমস্যা নেই, শেষ করছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে। আমি একজন তরুণ কবি। আমার এ ছোট পরিচয়গুলোও তোমার ছুটে আসার অনুঘটক। তবে এরপর যে পরিচয়টি দিবো, সেটি তোমাকে আমার কাছে থেকে অনেকদূরে নিয়ে যেতে পারে। তবে এও বলে রাখছি, তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা আমার কাছে সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই যে, আমার বুকের দিকে তাকাও। নারীর উন্নত স্তন যতদিন অবনত হবে না, ততদিন যেকোনো প্রেমহীন পুরুষ তার কাছে অবনত হতে বাধ্য। কিন্তু তুমি সেরূপ পুরুষ হলে, তোমাকে ফেরানোর কোনও ইচ্ছে আমার নেই। এবার শোনো, গতরাতে চেকপোস্ট পেরিয়ে এসে কিছু তরুণীকে একদল পুরুষের সঙ্গে দরদাম করতে দেখেছিলে। কী ঘৃণায় তাকালে তুমি। এবার আমার দিকেও সেই ঘৃণাদৃষ্টি ফেলার সময় এসেছে।

জয়ীতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, 'রিফাত, আমিও প্রতিরাতে সেখানে নিজেকে দরদাম করাই।'

রিফাত চোখে বিস্ময় নিয়ে জয়ীতার দিকে তাকালো। যেন কী আশ্চর্য প্রাণী। কিছুক্ষণ পর রিফাত সংবিৎ ফিরে পেলো। 'সময় হয়ে গেছে। আসি।' বলেই সে বাসে উঠলো। বাসের যাত্রাকালীন হর্ন বেজে উঠলো। জয়ীতা তার চোখেমুখে বিদ্রূপাত্মক অনুচ্চারিত কথামালা নিয়ে সহাস্যে সেদিকে চেয়ে রইলো। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন