আল কাফি নয়ন-এর গল্প


সবুজ পাগলা



মতিন সাহেব ভার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে আশপাশটা দেখে নিচ্ছেন। সবাইকে বেশ উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। গত পরশু যে ঈদের দিন ছিল তা এখনো সবার চোখ-মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। ঘণ্টা খানেক আগে মতিন সাহেবও বেশ খোশ মেজাজেই ছিলেন। এক জামাতার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যাওয়া হল না। উল্টা ছুটে আসতে হলো এই বাড়ি পোড়া দৃশ্য দেখার জন্য।

বাড়িতে আগুন লেগেছিল ভোরের দিকে। বাড়িতে কেউ ছিল না, সেই সুবাদে বুঝতে বুঝতে অর্ধেক বেশ ভালোভাবেই পুড়েছে। এরপর যখন মতিন সাহেবকে খবর দেয়া হলো, তখনও দমকলকে খবর দেয়া হয় নি।সবার ধারণা বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যের পুলিশের মত আগুন নিভে যাওয়ার পরই দমকল আসবে। দমকলের প্রতি এই গভীর আস্থা প্রদর্শনের কারণেই হোক আর প্রতিবেশীর অবহেলার কারণেই হোক মতিন সাহেবের বাড়ি বেশ ভালোভাবেই পুড়েছে। শুধু দেয়াল গুলো দাঁড়িয়ে আছে। আসবাবপত্র, কাগজ পত্র, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী সব কয়লা হবার জোগাড়। 'বাড়িতে কোন মানুষ ছিল না।' এই কথা ভেবে মতিন সাহেব খুশি হবেন নাকি দুঃখ পাবেন, তা তিনি নিজেই বুঝে উঠতে পারছেন না।

এমন বিড়ম্বনা মতিন সাহেবের আরো আছে। ঈদের সময় হওয়ায় যাবতীয় আত্মীয় স্বজন সবাইকে পাশে পাওয়া গেছে। 'বাড়ি পোড়া' এই মুহূর্তে পাশে আত্মীয় স্বজন  থাকাটা ভালো নাকি খারাপ। এটাও মতিন সাহেব বুঝে উঠতে পারছেন না।

মতিন সাহেবের বোঝা না বোঝার সাথে তাল মিলিয়ে কোন কিছুই হচ্ছে না। ঈদের তৃতীয় দিনে এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। তাই সবাই একরকম দল বেঁধেই চলে এসেছে। কারো উপস্থিতি মতির সাহেবকে শক্তি জোগাচ্ছে, আবার কারো উপস্থিতি তাকে বিব্রত করছে। এমন অবস্থায় কেউ কেউ অনুশোচনার সাথে সান্ত্বনা মিশিয়ে যে মন্তব্য করছেন, তা মতিন সাহেবের অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সবাই সমস্ত বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। মনে হচ্ছে, দর্শনীয় কোন স্থানে প্রথমবার আসা হয়েছে। তবে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন দিকে আগ্রহ। কেউ শুধু আসবাবপত্র গুলো আধপোড়া অবস্থায় দেখছে আর হাহাকার করছে। এইদলে আছেন মতিন সাহেবের বড় শালিকা রাহেলা। এই মাত্র তিনি একটা কয়লার স্তুপ দেখে মন্তব্য করেছেন-"আহারে!!! সেগুন কাঠের খাট টা! দেখেছেন কাঠ কয়লার রঙটা কেমন গাঢ়।" এই বলে তিনি কাকে যেন কয়লার স্তুপটা দেখিয়ে দিলেন।

আবার অনেকেই ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রীর ক্ষয়ক্ষতি দেখে বেশ আশাহত। তাদের ধারণা জিনিস গুলো অল্পের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। এই দলটায় পুরুষদের সংখ্যা বেশ ভারী। তবে এক শিশু কে দেখা যাচ্ছে,  যে শুধু ফ্রিজের দরজা খুলছে আর লাগাচ্ছে।

সকাল বেলা মতিন সাহেবের যে ভগ্নীপতির বাসায় যাবার কথা ছিল তিনিও এসে উপস্থিত। ভদ্রলোকের নাম আফজাল হোসেন। তিনি মতিন সাহেবের কানের কাছে গিয়ে বেশ গোপনীয়তা রক্ষা করে বললেন-"জমি জমার কাগজ কিছু ছিল নাকি মতিন?"
মতিন সাহেব নির্লিপ্ত ভাব ধরে রেখে বললেন-"ছিল কিছু।"
- তাহলে তো সব কয়লা। হে হে হে...আগুনে যাই দিবা তাই কয়লা। তোমারে আমারে দিলেও কয়লা। হে হে হে...
আফজাল হোসেন কেন পুলকিত বোঝা যাচ্ছে না। অন্যের বাড়ি পুড়লে পুলকিত হওয়াই নিয়ম বোধ হয়। তিনি তার আনন্দ চাপা দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু ঢেকুরের মত তা বারবার বেরিয়ে আসছে,  চাপা দেয়া যাচ্ছে না। মতিন সাহেবের ধারণা ছিল সময় গড়ালে সবাই ধীরে ধীরে চলে যাবে। তারপর তিনি ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে বসবেন কী করা যায়। কিন্তু মতিন সাহেবের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে অধিকাংশই থেকে গেল। সবার মধ্যে উৎসাহ কাজ করছে। এদের মধ্যে সর্বাধিক উৎসাহ দেখা যাচ্ছে মতিন সাহেবের স্ত্রী সালেহা বেগমের মাঝে। বাড়ি ভর্তি মানুষ দেখে তার  দিন বেশ ভালোই কাটছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে বাড়ি পুড়ে যাওয়া কোন ঘটনাই না।

মরা বাড়িতে খাবার আসে পোড়া বাড়িতে আসে না।সালেহা হাড়ি পাতিল পরিষ্কার করে রান্না বসিয়েছে।রান্নায় নির্দেশনা দিচ্ছে সবুজ। সে সালেহার ভাগিনা।
সে বলেছে-"ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না হবে। ঢিলা খিচুড়ি। সাথে ডিমভাজি।"

নির্দেশনা অনুযায়ী রান্না চলছে। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে সবুজ তার রান্নার পারদর্শিতা সমন্ধে নানা ঘটনার অবতারণা করছে। তার ভাষ্য মতে, রান্না উন্নতি করতে হলে জীবনের বেশ কিছু সময় মেস বাড়িতে অতিবাহিত করা উচিত। মেস বাড়ির বেটিদের রান্না খেতে অতিষ্ঠ হলে নিজ থেকে রান্না করার স্পৃহা চলে আসে বলে তার ধারণা। সে এরকম এক উদাহরণও পেশ করলো-
"আব্বাস নামের এক ব্যক্তি মেসে থাকাকালীন পরপর সাত দিন বুয়া আসলো না। কতদিন আর বাইরে খাওয়া যায়? শেষে সিদ্ধান্ত হলো নিজেরাই রান্না করে খাওয়া হবে। রান্নার দায়িত্ব পড়লো আব্বাসের ওপর। বুয়া সাত দিন না আসা আব্বাসের জন্য শাপেবর হয়ে দাঁড়ালো। সবাই তার রান্না খেয়ে তার গুণগ্রাহী হয়ে গেল। বর্তমানে তিনি নাকি সিঙ্গাপুরে এক রেস্টুরেন্ট এ চিফ সেফ হিসেবে কর্মরত আছেন।"

সবুজের ঢিলা খিচুড়ি মাঝপথে, এমন সময় মতিন সাহেবের নাতনি আনিকা একটা অর্ধ খাওয়া কমলা নিয়ে হাজির। এই সময়ে সে কমলা কোথায় পেল?

মতিন সাহেবের মেয়ে মমতাজ জিজ্ঞেস করলো-"আন্নি মা, কমলা কোথায় পাইছো?"
আন্নি সবাইকে ফ্রিজের কাছে গিয়ে দেখিয়ে দিল। অর্ধপোড়া কৃষ্ণ বর্ণের ফ্রিজ খুলে দেখা গেল বেশ কিছু খাবার অক্ষত আছে। সবুজ ফ্রিজ খুলে সব দেখে রীতিমত উচ্ছ্বসিত। ডিপ ফ্রিজে মাছ-মাংস সব ঠিকঠাক। সে উচ্ছ্বসিত  হয়ে আনিকাকে দেখিয়ে ঘোষণা করলো-"এই বাচ্চার বুদ্ধিমত্তা উচ্চপর্যায়ের। আমি আগেও তাকে ফ্রিজের দরজা খুলতে দেখেছি।"

হঠাৎ করে সবুজের মাথায় নতুন বুদ্ধি চাপলো। ডিম ভাজির পরিবর্তে মাংসের ঝাল ভুনা আর মাছ ভাজা প্রস্তাব করলো সে। সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব গৃহীত হলো। সালেহা ব্যস্ত হয়ে পড়লো  মসলার জোগাড় দিতে। বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। অন্ধকারে হারিকেন জ্বালিয়ে সবাই খেতে বসেছে। বেশ একটা বনভোজনের মত পরিবেশ  চলে এসেছে। খাবার বেশ সুস্বাদু হয়েছে। তবুও সালেহা খেতে পারছে না। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। কতদিন পর সবাই এমন এক সাথে খেতে বসেছে। কত দিন এই দিনটা ব্যস্ততা কেড়ে নিয়ে রেখেছিলো। সবার মুখের দিকে তৃপ্তি নিয়ে তাকাচ্ছে সালেহা। আনমনে সালেহার একটা কৃতজ্ঞতা চলে যায় আগুনের কাছে। সালেহার সাজানো সংসারটা পুড়িয়ে দিয়েছে আগুন। কিন্তু এই দৃশ্যটাও তার জন্যই পাওয়া। এটাই বা কম কিসে?

রাতে দুই রুমে সবার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। এক ঘরে পুরুষ সদস্যরা, অন্য ঘরে নারী সদস্য। পাটি বিছিয়ে সাধারণ শয্যা। সে শয্যার পাশেই কাঠ কয়লা কালি। তাই সকালে উঠে অনেকরই অবস্থা দেখার মত। কারো চোখে মুখে কালি লেপ্টে হুলুস্থুল কাণ্ড। কারো আবার পরিধেয় কাপড়ের উপর দিয়েই গেছে।

সকাল সকাল নারী সদস্যরা পরিচ্ছনতার কাজে হাত দিয়েছে। মতিন সাহেব মিস্ত্রি ডেকে এনে কাজে লাগতে দিয়েছেন। একসাথে দুই-তিন ধরণের মিস্ত্রি এসে হাজির। ঘরের চালের মিস্ত্রি, ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি, আর পানির লাইনের মিস্ত্রি। এরা সবাই নিজের কাজ ব্যতীত অন্যান্য কাজে বেশ পারদর্শী বলে মনে হচ্ছে। কারণ থেকে থেকে এরা একে অপরকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

মিস্ত্রিদের কাজে লাগিয়ে দিয়ে মতিন সাহেব বের হলেন।শহরে যাওয়া প্রয়োজন। ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে কাপড়-চোপড় সবই কিছু কিছু কেনা দরকার।মতিন সাহেব সঙ্গী হিসেবে পেলেন সবুজ, আফজাল হোসেনকে। মমতাজকে আগে পাঠিয়ে দেয়া হলো সবুজের সাথে। মতিন সাহেব ও আফজাল হোসেন একটা পিক আপ ঠিক করে তাতেই রওনা দিলেন। পিক আপে আফজাল হোসেন বিরতিহীন ভাবে ফোনে কথা বলে গেলেন। ওপাশের কথা কিছু সোনা যায় না। কিন্তু আফজাল হোসেনের কথার সুর প্রায় একই-
"হ্যাঁ, হ্যাঁ, শহরের দিকে যাচ্ছি। পোড়াবাড়ি টু বন্দর যাত্রা। হে হে হে..."

"মতিন কে চেনেন না? আমার শ্যালক। তার তো বাড়ি পুড়ে তামা তামা। একবার এসে দেখে যান। "

আফজাল হোসেনের কথায় মতিন সাহেব অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন। আফজাল হোসেনকে দেখে মনে হচ্ছে বাড়ি ঘর পুড়ে যাওয়া বেশ খুশির খবর।

দুইটা খাট কেনা হলো। সবুজ বললো-"খাট কেনার জন্য রাহেলা খালাকে নিয়া আসা লাগত। ভদ্রমহিলা কয়লা দেখে বলে দিতে পারেন কোন কাঠ।"
এই কথা শুনে দোকানের মালিক বললেন-"ভদ্রমহিলার ছবি নাই? ভদ্রমহিলাকে দেখার বড় ইচ্ছা।"
দোকানদারের এই কৌতুক সবাই ধরতে পারলো না। শুধু সবুজ আর মমতাজ হেসে উঠলো।

ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী কিনতে গিয়ে দেখা দিল বিড়ম্বনা। সব ঠিকঠাক, কিন্তু মমতাজের রঙ পছন্দ হয় না, কখনো সাইজ পছন্দ হয় না। তাকে বারবার বোঝানো হলো এইসবে রঙ বা সাইজ কোন ব্যাপার না। কিন্তু তাকে বোঝানো সবার সাধ্যের অতীত। শেষমেশ বেশ রংচঙা টিভি, ফ্রিজ,  রাইস কুকার, ফ্যান নিয়ে পিক আপে তোলা হলো। রাত তখন  প্রায় ১১টা। বাড়ি ফেরার যানবাহন পাওয়া মুশকিল। তাই পিক-আপেই সবাইকে যেতে হবে। সবুজ উঠলো পিক-আপের পিছন দিকে। ভিতরে জোর ৩ জনের জায়গা হয়। কিন্তু ড্রাইভারসহ মানুষ মোট চারজন। সবাই আঁটসাঁট হয়ে বসতে হবে। উপায় নেই। সবাই বেশ শক্ত হয়ে, কার্টুনের মত বসে রইলো। যাত্রা আরম্ভ হলো।

যাত্রা মাঝপথে ছেদ পড়লো। চাপাচাপিতে মমতাজের দম নাকি বন্ধ হয়ে আসছে। তাকেও পিক-আপের পিছনে স্থান দেয়া হলো। যাত্রা আবার শুরু হলো। রাস্তা ফাঁকা। মোট চার ঘণ্টার পথ, ঘণ্টা দেড়েকের মাথায় প্রায় অর্ধেকে চলে এসেছে।

বাইরে বেরিয়ে মমতাজ হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে চুল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বাতাসে তার চুল এলোমেলো করে উড়িয়ে নিল। সে চুলে মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ছে চাঁদ।  হঠাৎ চাঁদ বেরিয়ে আসলে মনে হচ্ছে অমাবস্যা পেরিয়ে পূর্ণিমা এলো। এই দৃশ্য অগ্রাহ্য করে সবুজ মুখ ফিরিয়ে সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করলো। তুমুল বাতাসে সেটা সম্ভব হলো না।

যাত্রায় দ্বিতীয়বার ছেদ পড়লো। এবার বাঁধ সাধলেন ড্রাইভার। তিনি আর সামনে যেতে নারাজ। তাকে নাকি সঠিক ঠিকানা বলা হয়নি। তাকে যে ঠিকানা বলা হয়েছে, তার থেকে ঢের বেশি দূরে নিয়ে এসেছে সে।এমনি অভিযোগ ড্রাইভারের। তাকে বোঝানো হলো- "ভাই, বাড়ি তো আর বেশি দূরে না। মাত্র মাইল দুয়েক হবে। এইসব জিনিস নিয়ে কীভাবে যাব বলেন?"
কিন্তু ড্রাইভার নিজ সিদ্ধান্তে অটল। সে কিছুতেই এক পা এগুবে না। তার এই একগুয়েমির কারণ হিসেবে প্রথমে যে বিষয়টা মাথায় আসে, তা হলো টাকা। সবুজ সে প্রস্তাব দিলো। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না।চাপাচাপিতে আসল কারণ বেরিয়ে এলো। সামনেই "আন্ধারি বাঁশের থোপ।" বেশ বড় বাঁশ ঝাড়। প্রায় ২০০ মিটারের মত বিস্তৃত বাঁশ ঝাড়। বাঁশ এত ঘন হয়ে এসেছে যে  দিনের বেলাতেও বেশ অন্ধকার থাকে জায়গাটা। তাই এমন নামকরণ। এই বাঁশঝাড় অতিক্রম করে কিছুতেই এগুবে না ড্রাইভার সাহেব। তার কথাতেও যুক্তি আছে-"যাওয়ার সময় আপনারা আছেন। ফেরার সময় তো কেউ থাকবেন না। দিনকাল যা পড়ছে। কখন কী হয় কে জানে।"
ড্রাইভারের চোখে মুখে ভয় দেখে মতিন সাহেব প্রস্তাব করলেন-"ভাই, আপনি আজকে আমাদের সাথে থেকে যান। সকাল সকাল ডাল ভাত খেয়ে রওনা দিয়েন।"
আফজাল সাহেবও যোগ দিলেন-"পোড়াবাড়িতে আপনাকে স্বাগত, ওয়েলকাম টু 'পোড়াবাড়ি'।"
মানবিক আবেদনের মুখে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলেন।মাঝখান থেকে ভাড়া হাজার টাকা বাড়ায় নিতে ভুল করলেন না।

মিনিট পাঁচেক পরেই পিক-আপ 'আন্ধারি বাঁশের থোপ' এর মুখে চলে আসলো। দুই দিকে বাঁশ ঝাড় মাঝ দিয়ে রাস্তা। সামনেই বাঁক নিয়ে বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে প্রবেশ করলো পিক-আপটা। ড্রাইভার নিয়ন্ত্রণ রাখতে রাখতে সামনের বাঁশ ঝাড়ে পিক-আপটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। বাঁশে লেগে সাইড ভিউ মিররটা ভাঙার শব্দে সবাই সচকিত হলো। আফজাল সাহেবের তন্দ্রার মত এসেছিলো। তিনি চোখ খুলেও ভাবলেন তিনি এখন তন্দ্রার মধ্যেই আছেন। সেই ঘোরের মাঝেই তিনি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন।

মতিন সাহেব কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। নিঃশব্দে ড্রাইভারের দিকে তাকালেন। ড্রাইভারের দৃষ্টি পিক আপের হেড লাইটের আলোর দিকে। তার দৃষ্টি অনুসরন করে মতিন সাহেবও দৃশ্যটা দেখতে পেলেন।প্রথমে মনে হচ্ছিলো দুইজন খুব শান্ত ভঙিতে এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর বোঝাগেল সংখ্যাটা দুই নয়, মোট চার জন আছে ওরা। ওরা কারা? এত রাতে এখনে কী করছে? হিমশীতল হয়ে একেক জনের পা গেছে যাচ্ছে। এই শীতল ছোঁয়াতেও দরদর করে ঘাম ভিজিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর। মতিন সাহেব, আফজাল হোসেন, ড্রাইভার কারো মুখে কথা সরছে না। সবাই রুদ্ধশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছে। সেই অপেক্ষা দীর্ঘায়িত করার জন্যই হয়ত ওরা ধীরলয়ে এগিয়ে আসছে। ওরা সবাই তাকিয়ে আছে মাটি দিকে। কাঁধে মৃতদেহ বহনকারী খাটিয়া। দেখে মনে হয় না এদের সাথে এ জগতের কোন সম্পর্ক আছে।

সবুজ ও মমতাজ পিছনে থাকায় তারা বুঝতে পারলো সবার শেষে। তারা যখন ওদের দেখলো তখন ওরা প্রায় পাশে চলে এসেছে। পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে চারজন মানুষ...। কাঁধে নাম না জানা কোন লাশ, সাদা কাপড়ে মোড়া। কেউ কারো সাথে কোন কথা বলছে না। তাদের চলাচলে নেই কোন তাড়া, নেই কোন শব্দ! এই দৃশ্য মমতাজ ও সবুজকেও যেন অজানা অনুভুতির সন্ধান দিল। তারাও যেন আটকে গেল মহাকালের কোন এক চক্রে।

মানুষগুলো পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তাদের পরিচয় পাওয়া গেল না। ওরা কারা? এত রাতে মাত্র চারজন একটা লাশ নিয়ে কোথায় যাচ্ছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন  থেকেই যাচ্ছে।

ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই যেন মূর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে গেছে। পেছন ফিরে দেখবে যে সে সাহসটুকু কেউ সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। কিন্তু সবুজ হঠাৎ বলে উঠল-"ওরা কে? কই যায় ওরা? দেখা দরকার তো।"

সবুজের কথায় যেন সবাই সংবিত ফিরে পেল। কিন্তু পাগলের মত প্রস্তাব শুনে সবাই আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। সবুজ ইতোমধ্যে নিচে নেমে পড়েছে। তাকে বাঁধা দেয়ার জন্য কেউ বাইরে আসবে এত টুকু সাহস কেউ করতে পারলো না। শুধু মমতাজ বললো-"যেও না সবুজ ভাই।" কথাটা বলেই  সে নিজের মুখ চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। সবুজ সে দিকে কান দিল না। সে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে কিছুই দেখতে না পেয়ে ফিরে এলো। এতক্ষণে সবার শরীরে বল ফিরেছে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রাজ্যের গতি নিয়ে বাঁশ ঝাড় পার করে হাফ ছাড়লেন।

বাড়ি এসে মমতাজ অবাক করা তথ্য জানালো। সে জানালো সবুজ যখন পিক-আপ থেকে নিচে নেমেছে তখন তাকেও ওই মানুষ গুলোর মত  দেখাচ্ছিলো।প্রথমে এই তথ্য কেউই আমলে নেয় নি। কিন্তু ঠিক এক সপ্তাহ পর যখন সবুজ অনেক রাত করে বাড়ি ফিরলো, তখন তাকে মতিন সাহেব জিজ্ঞেস করল-"কী রে সবুজ, কই ছিলি? এত রাত করে ফিরলি যে?"
সবুজ নির্বিকার ভঙিতে জবাব দিল-"ওদের দেখতে গেছলাম খালু, কই যায় ওরা? দেখা দরকার তো।"

মতিন সাহেব বুঝলেন, কিছু অস্বাভাবিক ঘটে যাচ্ছে।তিনি সবুজকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু সে কিছুতেই নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে রাজি নয়। সে কেন বাড়ি যেতে চায় না? এমন প্রশ্ন কেউ করলে সবুজ সোজা উত্তর দিয়ে দেয়-"কই যায় ওরা? দেখা দরকার তো। এখন বাড়ি গেলে দেখব কীভাবে?"

পরিশিষ্ট : ওইদিনের পর সবুজ মতিন সাহেবের বাড়ি থেকে যায়নি। তাকে মাঝে মাঝেই 'আন্ধারি বাঁশের থোপ' এর আশেপাশে দেখা যায়। "ওরা কারা? কই যায় ওরা?" এমন এক অজানা রহস্যের সমাধান করতে করতে সবুজ এখন পাগল প্রায়। সবাই তাকে 'সবুজ পাগলা' বলে ডাকে।

●লেখক : আল কাফি নয়ন, রংপুর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন