মানুষ যদি মাছ হতো
||এক||
ঘুমটা ভাঙতেই খুব মন খারাপ হল শ্যামলীর। মন খারাপ করার অসংখ্য বাস্তব কারণ তার আছে। হঠাৎ যদি কেউ জিজ্ঞেস করে- তোর বয়স কত? উত্তর দেয়ার জন্য কিছুটা সময় তার লাগে। অথচ ছ'মাস আগেও সে অকপটে বলে দিতো - বারো বছর। এখন সে জানে- কারো কারো চোখে তার তনুটা শরীর হয়ে উঠছে। কেউ কেউ বাঁকা চোখে তাকায়। তাদের ফিসফিসানির অর্থ সে বোঝে। তাই হুটহাট আর উত্তর দেয়না।
সেদিন এক ভদ্রগোছের মাঝবয়সী লোক যেঁচে তার সাথে কথা বলতে এল। শ্যামলী ভেবেছিল- কোনো এনজিওর লোক হবে হয়তো। এখানে এনজিওর অভাব নেই। আজ এরা তো কাল ওরা। কিন্তু স্থায়ী কেউ হয় না। কয়েকদিন শিক্ষার সাথে দু'মুঠো ভাত জুটে যায়। শিক্ষা বলতে ওই বর্ণ পরিচয়ের গণ্ডি। স্বরবর্ণ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই তারা লাপাত্তা। দু'মুঠো ভাত পাওয়া যাবে এই আশায় লোকটার সাথে কথা বলতে শুরু করেছিল সে। ঠিকঠাক বয়স বলার পর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিল- মানুষ। ভাইয়ারা শিখিয়েছে- আমাদের সবার পরিচয় এক; আমরা মানুষ। ভাইয়ারা ওদের পড়ায়। নতুন এনজিও। শ্যামলী তাদের নাম মনে করতে পারে না।
লোকটা চমকে উঠেছিল। তারপর একটু সামলে নিয়ে বলেছিল- কত টাকা নিবি? শ্যামলী সেদিন দৌঁড়েই বেঁচেছে। সেদিন থেকেই তার বয়স তিন বছর কমে গেল।
ছোট একটা ভাই আছে শ্যামলীর। টিএসসিতে ভিক্ষে করে। সাত-আট বছর বয়স। ভাইটার জন্য তার মন খারাপ হয়। কিন্তু নিষেধ করার উপায় তার নেই।
বাবাকে সে মনে করতে পারেনা। ভাইটা জন্মের আগেই বাবা উধাও। কোথায় গেছে, কেন গেছে - কিছুই জানা যায়নি। মায়ের মুখে শুনেছে— ফ্লাক্সে করে চা-সিগারেট বিক্রি করতো বাবা। একদিন আর ফেরেনি। হারিয়ে যাওয়া বাবাকে গালমন্দ করতো মা। কিন্তু বাবার জন্যও তার মন খারাপ হয়। বাবা একদিন ঠিক ফিরে আসবে। মনে মনে গল্প সাজাই শ্যামলী।
মা-ও কি ফিরবে একদিন? শ্যামলীর আকাশচুম্বী বিশ্বাস। নিজের গল্পের উপর তার অগাধ-ঈমান। অবশ্য মা-ও যে ছেড়ে যাবে সে কখনো ভাবতেই পারেনি। রিক্সাওয়ালাটার আরও একটা সংসার আছে শুনেছিল। সেই সংসারেও কি তার মতো একটা মেয়ে আছে? ছোট একটা ভাই আছে? ভাইটাকে নিশ্চয় ভিক্ষে করতে হয় না? ভাবতে ভাবতে তাদের মায়ের জন্যও মন খারাপ হয় শ্যামলীর।
ভোরবেলা যে একটু শান্তি করে ঘুমাবে তা'র উপায় নেই। এখানে রাত নামে দেরিতে, কিন্তু সকালের আগেই সকাল হয়ে যায়।
||দুই||
মেয়েটা বেশি কথা বলে। এই বয়সেই এতো কথা, আর পুরোটা কথা ফুটলে কী যে অস্থির করে মারবে! নিজের মনে কথা বলতো, তাও এক হয়। কিন্তু শুধুই প্রশ্ন। এতো প্রশ্নের কে উত্তর দেবে শুনি?
ছোট্ট তাথৈ। সবে চার বছর বয়স। রোড এক্সিডেন্টে বাবা-মা যখন মারা যায়, ওর বেঁচে থাকাটা প্রথম প্রথম বিস্ময় আর দিনে দিনে বিরক্তিই উৎপাদন করে চলেছে। বাবা-মা দুজনেই ডাক্তার ছিলেন। ছিমছাম ফ্লাট। ঢাকাশহরে কেবল গুছিয়ে উঠতে শুরু করেছিল একটা সংসার। ছোটচাচা আর ছোটচাচী কবে যে সেই সেই সংসারের সদস্যপদ পেয়ে যান, তাথৈর মনে পড়ার কথা না।
দাদা-দাদি বেঁচে নেই আর মামার বিয়ের পর নানাবাড়ি ক্রমেই মামাবাড়ি হয়ে উঠেছে। এমন সময় এক্সিডেন্ট হওয়াটা অমানবিকতার চেয়ে বেশি কিছু। কিন্তু হল এবং পরিবারের দুজন সাধারণ সদস্য সহসাই সভাপতি এবং সেক্রেটারির আসনে আসীন হয়ে রীতিকে উল্টে দিতে থাকলেন।
আজ তাথৈ যাচ্ছে ছোটমনি নিবাসে। তার প্রশ্ন সহ্য করার মতো ধৈর্য কিংবা সময় কারো নেই। তাও যদি প্রশ্নেগুলোর কোনো কার্যকারণ থাকতো! গতকালই তো ছোটচাচিকে জিজ্ঞেস করল— 'আচ্ছা ছোটমা, মানুষ কেন এ্যাকুরিয়ামে থাকে না?' ছোটচাচি তখন বাবুকে টিকটিকি দেখাচ্ছিল। অভ্রের ডাকনাম বাবু। দুই বছর বয়স। তাথৈকেও একসময় বাবু ডাকা হতো। তাথৈ নিশ্চয় ভুলে গেছে।
ছোটচাচি বিরক্তির সাথে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। তারপর মুখে একটু হাসি টেনে বললেন, 'এখনো ঘুমোওনি মামনি?'
—বলো না, মানুষ কেন এ্যাকুরিয়ামে থাকে না?
'মানুষ তো মাছ নয়। আর এ্যাকুরিয়ামে থাকলে কথা বলতে পারবে কি করে? এখন ঘুমাও।'
—মাছেরা বুঝি কথা বলতে পারে না? কেন পারেনা, ছোটমা?
'কারণ এ্যাকুরিয়ামে থাকে, তাই। একটু ঘুমাও সোনামেয়ে।'
—তাহলে কেন তাদের এ্যাকুরিয়ামের বাইরে রাখো না? আমি মাছেদের সাথে কথা বলবো।
ছোটচাচি আর কথা বাড়ায় না। বাবুকে নিয়ে পাশের রুমে চলে যায়।
এই মেয়েটার পেটভর্তি প্রশ্ন। কত সহ্য করা যায়! আমাদের বাবুটা কেমন শান্ত-শিষ্ট। একফোঁটা শব্দ করে না। বাচ্চারা এতো উৎসাহী হবে কেন! মনে মনে ভাবতে থাকে ছোটচাচি। আর তখনি কান্না জুড়ে দেয় অভ্র। এই রুমে কোথাও টিকটিকি নেই।
আজ থেকে প্রশ্ন-যন্ত্রের বিরাম। ছোটচাচা তাথৈকে রেখে আসবে। তাথৈ যেনো সব বুঝতে পারছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু দেখে নিচ্ছে সে। দেয়ালজুড়ে তার ছোট্ট হাতের অসংখ্য আঁকিবুঁকি। আঙুলে মমতা মাখিয়ে স্পর্শ করে সব শিল্পকর্ম। যে মানুষটার পিঠে ময়ূরের মতো ডানা এঁকেছিল, তার সাথে কথা বলে অনেকক্ষণ। লালপাতার একটা বৃক্ষ আছে তার; পাতার ডগায় সবুজ রঙের ফুল। একটা পতাকাও সে এঁকেছিল। মা সেই পতাকার নিচে লিখেছিল- তাথৈবিবির স্বাধীনতা। তাথৈ পতাকার সাথে কথা বলে।
—এই ছবিগুলো মুছবে না কিন্তু। বাবাকে দেখাতে হবে।
'একটা ছবিও মুছবে না, মামনি। ছোটচাচা উত্তর দেয়।'
—বাবা-মা এলেই আমাকে নিয়ে আসবে কিন্তু।
'আনবো, সোনামেয়ে।' ছোটচাচি এগিয়ে আসে।
'বাবা-মা যে তোমার উপর রাগ করেছে। তুমি আড়াল হলেই তারা চলে আসবে। আর আমরা তোমাকে চুপিচুপি ডেকে আনবো।'
তাথৈ যেনো সব বুঝতে পারছে। তার বাবা-মা বেঁচে নেই। এই বাড়িতেও আর ফেরা হবেনা তার। বাবা-মায়ের বড় একটা ফটোগ্রাফের সামনে গিয়ে সে দাঁড়ায়।
—ছোটমা, আমাকে ঐ এ্যাকুরিয়ামের ভিতরে রাখবে?
'এ্যাকুরিয়ামে তো মাছ থাকে, সোনামেয়ে।'
—আমাকে তোমরা মাছ বানিয়ে দিতে পারো না?
'মাছ কেন হবে? তুমি অনেক বড় মানুষ হবে, মামনি।'
—না, আমি মাছ হতে চাই। এ্যাকুরিয়াম থেকে সারাক্ষণ বাবা-মা'কে দেখবো। আর কথাও বলবো না। দেবে ছোটমা আমাকে মাছ বানিয়ে?
||তিন||
ভোরবেলা যে একটু শান্তি করে ঘুমাবে তা'র উপায় নেই। এখানে রাত নামে দেরীতে, কিন্তু সকালের আগেই সকাল হয়ে যায়। স্বপ্নটা সে পুরোপুরি শেষ করতে পারল না। শ্যামলীর মন খুব খারাপ।
তাথৈর জন্য তার মন খারাপ হয়। তারপর আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করে নিজের জন্যই তার মন খারাপ। সে-ই যেনো তাথৈ। তাথৈর বাবা-মা নেই। কিন্তু বাস্তবে শ্যামলীর মা আছে, বাবাও হয়তো আছে। আবার বাবা-মায়ের একটা ফটোগ্রাফ ছিল তাথৈর। কিন্তু শ্যামলীর তা নেই। তবে স্বপ্নটা তাকে ভাবাচ্ছে কেন? একটা অস্পষ্ট ছবি ক্রমেই স্পষ্টতর হতে থাকে। তাথৈর মায়ের ছবিতে সে আসলে নিজের মায়ের মুখই দেখেছে। যদিও বাবাটা এখনো ঝাপসা হয়ে আছে।
স্বপ্ন কি এতো বড় হতে পারে? ভাইয়ারা বলেছিল- স্বপ্ন বড়জোর দশ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। দশ সেকেন্ডে কি এতো কিছু দেখা সম্ভব? তবে কি সে গল্প সাজাচ্ছিল? প্রশ্নের পর প্রশ্ন ঘুরতে থাকে। হঠাৎ মনে পড়ে- তাথৈও খুব প্রশ্ন করতো। সে-ই কি তাথৈ!
ভাইটা যে কোথায় ঘুমিয়েছে! দুইদিন দেখা নেই। উদ্যানের এইদিকটা অনেকটা ফাঁকা। শ্যামলী ফাঁকা জায়গায় ঘুমাতেই পছন্দ করে। কিছুক্ষণ ও বেশ আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। স্বপ্নে তাথৈর বাবা-মা মৃত হলেও তাদের যেনো সামনেই দেখতে পাচ্ছিল। সে ছিল তাথৈ। চার বছর বয়স। স্বপ্নে মৃত মানুষকেও স্পর্শ করা যায়।ভাবতে ভাবতে কেমন সুখও ঘিরে ধরছিল যেন। কিন্তু ভাইটার কথা মনে পড়তেই সে উঠে বসে। তারপর ডানদিকে তাকাতেই চোখ আঁটকে যায়।
'কী-রে উঠে পড়লি যে? ঘুম হয়ে গেল?'
কথা বলতে বলতে মহিলাটা তার কামিজ খুলে ফেলল। তারপর সন্তর্পণে ঝোপের আড়ালের একটা বাক্সের ভিতর কামিজটা ঢুকিয়ে দিল। পরনে এখন শুধু একটা সবুজ রঙের সালোয়ার। ঝোপের ভিতর আরেকবার হাত ঢুকিয়ে এবার একটা বড়সড় ছেঁড়া কাগজ বের করে আনল। তারপর বুকের উপর কাগজটা চেপে ধরতে ধরতে আবার জিজ্ঞেস করে— 'ঘুম হয়ে গেল?'
শ্যামলী উত্তর দেয় না। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার শুয়ে পড়ে। এখানে নতুন এসেছে মহিলাটা। শ্যামলী নিশ্চিত, ক'দিন বাদেই সে আবার অন্যকোথাও চলে যাবে। ভাইয়ারা বলেছিল- ছয়টা মৌলিক চাহিদা আছে মানুষের। সবার আগে ভাত। তারপর কাপড়। কিন্তু তারা আমাদের শিক্ষা দিতে আসে। আর আশ্চর্য - এই মহিলা ভাত চেয়ে ভাত পায়নি, কাপড় চেয়ে ভাতের যোগান পায়।
মাছ হতে পারলে কেমন হতো? এ্যাকুরিয়ামের মাছ! মাছেদের কাপড় লাগে না, শিক্ষা লাগে না, ভিক্ষে করতে হয় না; আবার সময়মতো খাবার জুটে যায়। তাথৈর মতো শ্যামলীর বলতে ইচ্ছে করে— 'তোমরা আমাকে মাছ বানিয়ে দিতে পারো না?' কিন্তু কাকে সে বলবে!
আলো ফুটতে আরও কিছুক্ষণ সময় লাগবে। এই ভোরবেলাও দু'চারজনকে পায়চারী করতে দেখা যায়। একটা ভদ্রগোছের লোক এগিয়ে আসে।
'নাম কী তোর?'
—তাথৈ
'বয়স?'
—চার বছর, না না নয় বছর।
||চার||
সারাদিনে একফোঁটা ভাত পেটে পড়েনি। ভাইটা কি হারিয়েই গেল? শ্যামলীর ঈমান দুর্বল হতে থাকে। কত গল্প আর তাকে বানাতে হবে। ইশ, যদি গল্পগুলো লিখে রাখা যেতো! একদিন ভাইয়ারা জিজ্ঞেস করেছিল - বড় হয়ে কী হতে চাও তোমরা? শ্যামলী বলেছিল- গল্প লিখতে চাই।
পাশের মহিলাটা ফিরে এসেছে। সন্ধ্যের পর তার নগ্নতা কেউ দেখবে না। সে এখন কামিজ পরে নিচ্ছে।
'কী-রে সারাদিন এখানেই থাকিস? খাওয়াদাওয়া হল? তোর ভাইটাকে দেখছিনা দুদিন? কোথায় গেল সে?'
শ্যামলী উত্তর করে না। খুব খিদে পেয়ে গেছে। পেটের ভেতর হাঙর ঢুকে পড়েছে তার। পিটপিট করে চারিদিকে তাকায় একবার। মানুষের মেলা। নিয়ন আলো অন্ধকারকে ছমছমে করে রেখেছে। এখান থেকেই নাকি মুক্তির ডাক এসেছিল।
'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম'
ধীর পায়ে এক মধ্যবয়সী এগিয়ে আসছে। শ্যামলী ঠাণ্ডা হয়ে বসে থাকে।
'তোর নাম কী-রে?'
—তাথৈ, না না শ্যামলী।
'বয়স কত?'
—সতেরো।
'কত টাকা নিবি?'
শ্যামলী ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে। তার পেটের ভেতর একটা হাঙর লেজ ঝাপটা দিয়ে লাফিয়ে উঠছে। হাঙরটা থেকে সে মুক্তি পেতে চায়।
♦
কবির কল্লোল
ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন