জয়ন্ত জিল্লু -এর গল্প

জুলেখা ধর্ষণের দুই যুগ পরের কথা
জয়ন্ত জিল্লু


   বৃষ্টি শুরু হলেই কাসেম একটা লম্বা বিড়ি ধরান। লম্বা বিড়ি মানে এই বিড়ি সে শেষ করতে চায় না। দরোজায় হেলান দিয়ে উঠানের দিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যে নিজে হাসে। এই মানুষটা কখনো জানতে চায় না, নিজে হাসলে কেমন দেখায়। সে যেমন দেখাক, বৃষ্টিতে হাসির একটা রূঢ় মানে আছে। রাঢ় অঞ্চলে উপোস করে থাকার ভেতর যে কষ্ট, বৃষ্টির হাসিতেও সে কষ্ট! কাসেম বৃষ্টি দেখে, আর হাসে। 
   এই ফাঁকে আমরা কাসেমের দু-যুগ পূর্বে ফিরে যাই। কাসেম ব্যক্তিগত জীবনে দুই যুগ বুঝে না; হুজুরের ওয়াজ মাহফিলে দু-জাহান শব্দটা শুনেছে সে। মানে বুঝুক আর না-বুঝুক শব্দটা জানে। আমি বললাম, 'চাচা, দুই জাহান কী?' চাচা নিজেকে প্রস্তুত করে না। কেননা আজ থেকে দুই যুগ পূর্বে আমি তাকে চাচা সম্ভোধন করলেও কাসেম জানে, এখনো তার চাচা-জ্যাঠার যুগ শুরু হয়নি। তার শরীরে এখনো জোয়ানকি আছে। পুরুষ মানুষের বলের পরীক্ষা কিংবা শক্তির পরীক্ষা দুইটাই নারী বরাবরে। মানে, হাতের কাছে মহিলা না-পাইলে শরীর এগোয় না। অপ্রস্তুত কাসেম বলল, 'নেকী।' 
   দুই জাহান মানে নেকী না। এইটা জীবনের দুইটা ভাগ। একটা দুনিয়াতে কাটালেন, আরেকটা মরার পরে। চাচার দেখলাম এসব শুনবার আগ্রহ নাই। দুই যুগ পূর্বে কাসেমের বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ। পঞ্চাশকে বুড়ো ধরলে হবে না। কাসেমের ঘরে দুইটা বিবি আছে। গেল বছর একঘরে ফুটফুটে বাচ্চা এসেছে। সন্তান জন্ম দেবার মুরোদ থাকলে কেউ নিজেকে বুড়া ভাবে না, আর কাসেমতো...!
—চাচা, এই যে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ; এইটাকে আপনি কী বলেন। সত্যি কি আপনি কাজটা করেছেন?
—কোন কাজটা?
—এই যে ধর্ষণ, রেইপ।
   কাসেমের চোখ থেকে আগুন বের হয়ে আমাকে উষ্ণ করে। আমার বুকের লোম পুড়ে যেতে থাকে। 'চাচা, দেখেন জিনিসটা আমার জানা চাই। আপনি সত্যি সত্যি করে বলেন, কাজটা আপনি করেছেন কিনা?'
   কাসেম উত্তর দেয় না। ধর্ষণ কী সে জানে না, কিংবা জানে। ধর্ষণ না চিনুক, জোর করা তো চেনে। আমি আবার বললাম, 'আপনি কি কোনো জোর করেছিলেন?'
   কাসেম উত্তর দেয় না। সে উত্তর জানে কিন্তু বলছে না— হতে পারে সে কিচ্ছুই জানে না। আরেকটা কথা, এই বয়সে এমন কিছু করবে? কাসেমের শরীরে বাবার বয়স, কিন্তু চোখে তারুণ্য আছে। যুবকের মতো তার চোখ তীরের ফলার মতো। যুবক যুবক চোখ দেখে কি তবে আমি ধরে নিব, আসলে কাসেমই কাজটা করেছে। কিন্তু ধরে নেওয়াটা অন্যায় হবে। তাছাড়া, এভাবে দুই যুগ পূর্বে পা রেখে কাউকে ধর্ষণের অভিযুক্ত করা ঠিক হবে না। এবার আসুন তবে বৃষ্টিত ফিরে যায়।
   বাইরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। কাসেম আগের মতো বসে আছে। মাঝমধ্যে হাসছে। হাসির ভেতর কেমন যেন একটা বিষয় লুকিয়ে আছে। বিষয়টা ধরা দিচ্ছে না। বৃষ্টিতে কাসেমের বয়স হয়েছে— বুঝা যাচ্ছে। আমি একটা বিড়ি এগিয়ে দিলাম। কাসেম হাসছে। আমি তার সামনে একটা বিড়ি এগিয়ে দিয়ে বসে আছি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। দুই যুগ পরে। কাসেম চাচা ও আমি। বাইরে বৃষ্টি!

জয়ন্ত জিল্লু
চট্টগ্রাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন