মীর রবি-এর কবিতা আলোচনা


শিস খন্দকারের কবিতা ও রাষ্ট্র ভাবনা



রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র ভাবনা কী? রাষ্ট্র হলো একটি নিদির্ষ্ট ভূখন্ড ও একই জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নাগরিক নিয়ে গড়ে ওঠা শাসনব্যবস্থা। আর রাষ্ট্রভাবনা হলো একটি যুগের বাস্তব ঘটনাবলির স্থায়ী দর্শন। এই দুই ক্ষেত্রেই মূল উপাদান- নাগরিক। একজন কবিও নাগরিক। তারো রাষ্ট্র রয়েছে। সমালোচকদের মতে কবি ও কবিতা ভৌগলিক সীমানা মানেনা। কবি ও কবিতা রাষ্ট্র সীমার উর্ধ্বে। তার মানে এই নয় কবির রাষ্ট্র নেই। কবিও একজন মানুষ। তিনিও নিদির্ষ্ট একটি ভূখন্ডে বাস করে, তারো নিদির্ষ্ট একটি জাতীয়তাবাদ আছে। একজন কবি যখন তার কবিতায় মানবিক আবদারগুলোকে প্রবলভাবে মিটাতে পারেন, তখনই সে কবিতা বিশ্বের হয়ে ওঠে। কিন্তু এর মাঝে নিজ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দর্শন বাদ পরেনা, পরতেও পারেনা। কবির চারপাশ, তার সমকালইতো তাকে ভাবায়। কবি শিস খন্দকারও এর থেকে ব্যতিক্রম নন। তর কবিতায় আমরা আমাদের রাষ্ট্রের মানুষের খন্ড খন্ড ভাবনাগুলোই গুচ্ছগুচ্ছভাবে উঠে এসেছে। নিজস্ব ভূখন্ডের সীমা পেরুবার ক্ষমতা না থাকলেও আমরা তার কবিতায় রাষ্ট্রভাবনাগুলোকে উড়িয়ে দিতে পারিনা। কিংবা জনগণের আবদার বা ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারিনা। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট, চলমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত অস্থিরতা, জনমানসে চাপাক্ষোপ- এসবেরই প্রতিফলন আমরা শিসের কবিতায় লক্ষ্য করি। রাষ্ট্রের কাছে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব, ব্যক্তিস্বার্থে রাষ্ট্রপ্রধানদের তেলমর্দন এসব থেকেই কবি বোধ করেন- 

‘রাষ্ট্র একটি প্রয়োজনীয় এবং অশ্লীল শব্দ। 
তোমরা যারা রাষ্ট্রকে উপসানালয় ভেবে রাষ্ট্রপ্রধানদের পূজো দাও 
তার তুমুল ধরনের বোকা- এ বোকার সংখ্যা নেহাত কম নয় 
এরা মানুষ নয়- নাগরিক।’ 
(আয়নায় অলীক সঙ্গম) 

কবি এখানে রাষ্ট্র ও নাগরিককে নিয়ে তীর্যাত্বক কথা ছুঁড়েছেন। তার এই কবিতাতেই তীব্র শ্লেষ পাই- 

‘তোমরা যেদিন রাষ্ট্রের পিঠের চামড়া তুলে নুন ছিটিয়ে কদমবুসি করতে পারবে 
তোমাদের সত্য উচ্চারণে রাষ্ট্রকে উঠবস করাতে পারবে 
তোমরা মানুষ হবে।’ 
(আয়নায় অলীক সঙ্গম) 

রাষ্ট্র প্রধানদের উদ্যতা, জনবিচ্ছন্নতা, নাগরিকদের ¯্রােতে গা ভাসানোর চলমান রীতি কবিকে দ্রোহের উচ্চারণ শিখিয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে অসাঞ্জস্যতা, ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা দেখেও যখন জনমানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তখনই আমরা কবির কবিতায় ক্ষুব্ধতা উঠে আসতে দেখি। পাই- তীব্র শ্লেষবাক্য ছুঁড়ে নাগরিকগণকে মানুষ হওয়ার আহŸান। নজরুল সাহিত্যের প্রভাব এক্ষেত্রে আমরা শিসের কবিতায় টের পাই। নজরুল বা সুকান্তই বলি না কেন- ঘুমন্ত, অসচেতন মানুষগুলোকে জাগাতে তাঁদের সাহিত্য পর প্রজন্মের কবিদের মাঝে প্রভাব ফেলবে না, তা আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। 

সমকালীন রাজনীতি, রাষ্ট্রচিন্তায় আমরা গা সোয়া বা গুরুত্বহীন ভাব দেখতে পাচ্ছি। দেশের যখন যেখানে যা ঘঠছে বা ঘঠতে যাচ্ছে, তখনই তাকে বিচ্ছিন্ন বা স্বাভাবিক বলে উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। যখন কিছু এলিট শ্রেণির মানুষ, কিছু তরুণ গণমাধ্যমে এনিয়ে জনগণকে জাগাতে চাচ্ছে- তখনই আবার বিরোধীদলীয় তকমায় ঘটনাকে অন্য পাশে মোড় দেয়ার প্রয়াস দেখাচ্ছে। সমাধানের কোনো চেষ্টা বা আগ্রহ আমরা দেখতে পাচ্ছিনা। এসবের মাঝে আবার কোনো নতুন ঘটনার উদ্ভাবন, আগের ঘটনাকে মাটিচাপা দিচ্ছে। আমরাও নতুনকে নিয়ে আবার তোরজোর শুরু করি। ভুলে যাই পূর্বের কথা। এতে করে সুযোগ করে নিচ্ছে সুযোগ সন্ধানি রাজনীতিকরা কাদাছুঁড়াছুঁড়ি করে জনগণকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এই যে বিচারহীন অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তা কবিকে কবি সত্বাকে বিবেকের কাঠগোড়ায় উস্কে দেয়। কবি কতিায় লেখেন- 

‘রাষ্ট্রের বগলদাবায় প্রশাসনিক থার্মোমিটার 
আটত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস- স্বাভাবিক; 
মন্ত্রী মহোদয়গণ ছুটলেন সমুদ্রে, ডুবালেন থার্মোমিটার 
আটত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস- স্বাভাবিক; 
মাননীয় রাষ্ট্রপতি আগ্নেয়গিরিতে ধরলেন থার্মোমিটার 
আটত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস- স্বাভাবিক!’ 
(থার্মোমিটার)
কবি এখানে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র প্রধানদের বিচ্ছিন্নতাবাদীভাব বা স্বাভাবিকতার মিছিলে যে সত্য আড়ালের কৌশল- তা শব্দে শব্দে প্রস্ফুটিত করেছেন। শুধু রাষ্ট্র প্রধানদের কথাই যে বলেছেন, শুধু তা নয়- রাষ্ট্র প্রশাসনের কথাও বাদ যায়নি। প্রশাসন যে রাজনীতির চারদেয়ালেই আবদ্ধ তা তিনি পরিষ্কারভাবেই বলেছেন। রাজনীতিকদের যে বক্তব্য, তা থেকে প্রশাসনের বক্তব্যও ভিন্ন কিছুনা।  প্রশাসন ও রাজনীতিকের আতাত- কবি গভিরবোধ থেকেই তুলে ধরেছেন। 

প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের নানান উত্থান-পতন, বেকার ও বিপদগামী প্রজন্ম, সংকটে মুহ্যমান সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্মমোড়লদের পাছ থাপরানো বুলি- তারপরও মানুষ নিশ্চুপ। নীরবতাও আগুন তো আগুনকে উস্কে দেয়, কিন্তু সেটা কবে হবে? জনমনের অস্থিরতা, অবিশ্বাস বা পুলিশি রাষ্ট্রের নষ্ট থাবার আশঙ্কা- চারপাশকে ঘুনপোকার মতো কুড়ে খাচ্ছে। কিংবা মানুষের গা সোয়া ব্যধি রাষ্ট্রকে পোড়াচ্ছে নষ্ট রাজনীতিকের হাতে। কবি তাই উচ্চারণ করেন-

‘শরীরে তীব্র তাপমাত্রা নিয়ে প্রলাপ করছে রাষ্ট্র 
চারদিকে শংকিত জনবের পোড় া ছাই 
চলুন বরং রাষ্ট্ররে পায়ুপথে ঢুকাই। 

নয়তো আমরা শুয়ে থাকি ঘরে- মারুন পুড়ে 
রাষ্ট্রের থার্মোমিটার ধরে দেখবেন ঠিক 
আটত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস; স্বাভাবিক। ’ 
(থার্মোমিটার) 

রাষ্ট্র যখন আগ্রাসনবাদী হয়, যখন জনমানুষ নিশ্চুপ থাকে, প্রতিবাদী না হয়- রাষ্ট্র ও রাজনীতিক তখন পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গিলে খায়। আমাদের চারপাশের নীরবতা, প্রতীবাদহীনতা- রাষ্ট্র প্রধানদের সেই আগ্রাসনবাদী রূপটাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে। রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়েই আমরা এর একটা ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখতে পাচ্ছি। কজন পরিবেশবাদী, কজন এলিট শ্রেণি, কিছু তরুণের প্রতীবাদ গণমানুষের অসম্পৃক্ত আন্দোলন কিন্তু রাষ্ট্রকে সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। এখানে যদি আমরা প্রতিবাদের গণজোয়ার দেখতাম- তাহলে রাষ্ট্র ভয় পেত, জনমতকে উপেক্ষা করতে পেতনা। আগ্রাসনী এই রূপ শিসের কবিতায় এভাবেই ধরা দিয়েছে- 

‘বিদ্যুৎ বেগে ছুটছে সব দিকভ্রষ্ট- 
একটি সবুজ বন, একটি বহমান নদী 
এবং একটি নাছোড়বান্দা রাষ্ট্র!’ 
(রামপাল) 

আমরা ফেব্রæয়ারি ২০১৩ তে গণজারণ মঞ্চের উত্থানে গণজোয়ার দেখেছিলাম। রাষ্ট্র সেই জনতোপের মুখে রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসি দিতে বাধ্য হয়েছিল, আপোষের গোপন আতাত থেকে সরে এসেছিল। কিন্তু সেই গণজাগরণ মঞ্চই বা এখন কোথায়? সেই তরুণগুলো? আমরা যাদের মাঝে আলো খুঁজে পেয়েছিলাম? রাষ্ট্র সেই জনজোয়ারে ছুড়ি চালিয়েছে। কিছু সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী মানুষের বাগরম্বরে ভেস্তে গেছে। ফলে আমরা আবার শিক্ষানীতিতে সেই সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প দেখতে পাই। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মবাদের আপোষ দেখতে পাই। অথচ কথা ছিলো- ধর্ম থাকবে ধর্মের জায়গায়- ব্যক্তির অভ্যন্তরে, রাষ্ট্র হবে সবার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ব্যবসাও আমাদেরকে আশাহত করে। মানুষও এসবের দোদ্যলতায় বিভ্রান্ত হয়। বিভ্রান্তের মাঝে ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু এভাবে কদিন? এর জন্য জনসাধারনকেই যে বেশি মূল্য দিতে হবে- তা তারা টের পাচ্ছে না। 

শিক্ষানীতিতে আমাদের প্রজন্মকে অন্ধ রাখার প্রয়াস, রাজনীতিকগণের শিক্ষা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। একজন নেতার শিক্ষা কতটুকু? এই রাষ্ট্র নিয়ে তার দর্শনইবা কি! পকেট পুরলেই সব হাসিল! পেশি শক্তিতে পুষ্টি বাড়ানোই যেনো রাষ্ট্র ও রাজনীতিকগণের কাজ। শিক্ষায় তাদের বাজেটও তাই কম। কবি শিস খন্দকার তাই কবিতায় বলেন- 

‘যখন রাষ্ট্রের অশিক্ষিত জ্ঞানহীন মূর্খের দল
সংসদের সবুজ কেদারায় করে কোলাহল; 
শিক্ষা যারা কখনও স্বপ্নেও নাহি ভাবেন! 
সেই রাষ্ট্রের কাছে এর চে’ আর মহৎ কী পাবেন?’ 
(দুঃখিত জনাব)
কবি প্রশ্ন রেখে গেছেন- এর উত্তর পাঠকরাই খুঁজে নিবেন। সমালোচকরা বলতে পারেন- শিক্ষায় বাজেট আছে। কিন্তু মূর্খ সাংসদরা কতটুকু দিয়েছে সেই বাজেট? পাশনীতিতে যে শিক্ষা, মেধার যে মূল্যায়ন পদ্ধতি, প্রশ্ন ফাঁস- আমাদের কি দিতে পারে? এ প্লাস কিংবা ফেল মানেই কি সর্ব শ্রেষ্ট বা সব শেষ? তাই যদি হয়, তাহলে আমরা শিক্ষিত মূর্খ পাব, না একটা মূর্খ প্রজন্ম পেয়ে যাব? রাষ্ট্র আমাদের এখানে গলাটিপে রাখার সুকৌশলই করে রেখেছে। কবিও তাই উচ্চারণ করেন- 

‘আমরা রপ্ত করেছি দারুন উপায় 
কী করে কণ্ঠনালী চেপে ধরা যায়!’ 
(প্রজ্ঞা) 

শিক্ষাহীন জাতির বাক-স্বাধীনতাই বা কি! রাষ্ট্র আমাদের পোক্তভাবেই বাক-স্বাধীনতাকে হরণ করে রেখেছে। যে সব মানুষ নীরবতার বলয় ভেঙে বেরুতে চাচ্ছে- রাষ্ট্রও তাদের শেকল পড়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে ৫৭ ধারায়! কবির এ উচ্চারণ মিথ্যা নয়। 

মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের চেতন অবচেতনে রাজনৈতিক আদর্শ আছে, আছে রাজনৈতিক দর্শন। একজন সচেতন কবিও এ থেকে মুক্ত, তা আমরা বলতে পারিনা। কবি শিস খন্দকারও কোনো না কোনো রাজনৈতিক আদর্শ বা দর্শনে আবদ্ধ। প্রশ্ন করতে পারি- তিনি কি পুঁজিবাদী বা কমিনিস্ট? নাকি ধর্মবাদী? ধর্মবাদ রাজনীতি আর পুঁজিবাদী রাজনীতি একই মেরুকরণের প্রয়াস। বৈসাদৃশ্য শুধু বলার ভঙিতে। কবি কমিউনিস্ট না পুঁজিবাদী, এই ভেদ তার কবিতাই করবে। একজন কবি তো তার সমাজ রাষ্ট্রের কাছে পাওয়া না পাওয়ার কথাগুলোই কবিতায় বলেন। রাষ্ট্রের কাছে চাওয়া পাওয়ার হিসাব কোন রাজনৈতিক দর্শনে পরে, তার কবিতাই সমকালকে বলে দিবে। বোদ্ধা পাঠকই চিহ্নিত করবেন এই আদর্শবোধ।  

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাঝ দিয়ে জন্ম নেওয়া একটি দেশ পুঁজিবাদ আর কমিউনিস্ট এই দ্বন্দে আজও এক হতে পারেনি। স্বাধীনতায় আমরা কি চেয়েছিলাম আর কি পেয়েছি, এর হিসাব মেলা ভার। যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাঝ দিয়ে আমরা যাচ্ছি- এর মাঝে কতটুকুইবা স্বাধীনতার বাস্তবায়ন? কবি শত-শহিদের আত্মার আর্তনাদ থেকেই সেই প্রশ্ন তুলেছেন- 

‘সেই একাত্তরের স্বাধীনতার গল্পটা শুনছি। 

ভূমিষ্ঠতার পর থেকেই 
স্বাধীনতার মধুর পরশটুকু চাচ্ছি। 
কোথায় সেই স্বাধীনতা?’ 
(মুক্তির প্রলাপ) 

কবির এই প্রশ্নের উত্তর কে দিবে? রাষ্ট্র? রাষ্ট্র প্রধান? না রাষ্ট্রের ঝিমমারা নাগরিক? এর উত্তর আমরা খুঁকে পাইনা। মিথ্যে মিথ্যে মনে হয় সব। যে রাষ্ট্রের জবাবদিহিতার বালাই নাই, সেই রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন থাকে। যে রাষ্ট্র জনমানুষকে তাচ্ছিল্যবোধ করে সেই রাষ্ট্রে প্রশ্নগুলো কে তুলবে? যখন কাউকে পাওয়া যায় না, তখন কবি শিস খন্দকারই প্রশ্ন তোলেন- 

‘কে বড়? মহামান্য রাষ্ট্রপতি? ব্যধিগ্রস্থ রাষ্ট্র? বেহায়া নাগরিক? 
(আপেক্ষিকতা) 

কবি রাষ্ট্রকে ব্যধিগ্রস্থ ও নাগরিককে বেহায়া বলেছেন। এটা তার আক্ষেপ বা ঘৃণার চূড়ান্ত পর্যায়। যে রাষ্ট্রের কাছে জনগণ কোনো ফ্যাক্ট নয় কিংবা নাগরিক তার রাষ্ট্রের মাধ্যমে নিজেদের ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারেন না, তখন এ ছাড়া আর বলার কি থাকে? 

রাষ্ট্র কখনো এক মতে চলতে পারেনা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকে, থাকে ভিন্ন ভিন্ন মত। এই মত যদি রাষ্ট্রের মূলনীতি থেকে পৃথক হয় তবে তা অগ্রহণযোগ্য ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। কিন্তু মতকে যদি রাষ্ট্র স্বীকৃত দিয়ে থাকে, তবে সেই মতের মানুষদের উপর দমন-পীড়ন চালাতে পারেনা। সমকাল এক নায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মতো রাষ্ট্রকে দমন-পীড়নের নীতিতে মাততে দেখছি। যা পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর থেকেই প্রথাগত ভাবেই যেন চলে আসছে। সাপ-লুডু খেলায় দুদলীয় বৃত্ত, চেতনার শেকড়ে কুঠারাঘাত, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কর্মকান্ড জঙ্গিবাদে আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। শিক্ষানীতিতে হেফাজতী ফর্মুলা দেখে আমরা অনুমান করতে পারি- রাষ্ট্র কোনো না কোনোভাবে মৌলবাদের সঙ্গে আপোষ করছে। যখন এ নিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক তরুণরা কথা বলছিল তখনতো আমরা এ প্রজন্মকে নাস্তিক বলে নিবৃত করতে রাষ্ট্রকেই অতি উৎসাহী হতে দেখেছি। আবার জঙ্গি দমনের নামে যা হচ্ছে তা নিয়েও সন্দেহও তৈরি হয়েছে। আমরা জানি রাষ্ট্র কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারের আওয়াতায় না নিয়ে রায় দিতে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রশাসন এ নীতির বিরুদ্ধেই হাঁটছে। সু-নিদির্ষ্ট অভিযোদ ছাড়াই শুধুমাত্র সন্দেহের তীর ছুড়েই জঙ্গি ট্যাগে মানুষ হত্যা করছে। জঙ্গিবাদের শিকার প্রত্যেককেই আমরা কিশোর ও তরুণ বয়সের দেখছি, এদের বিরুদ্ধে শুধু সন্দেহের তীর ছুঁড়েই তো হত্যা করা যায় না। তদন্ত সাপেক্ষে নিদির্ষ্ট অভিযোগ দায়ের করে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র তা করছে না। রাষ্ট্রের কাছে মানুষের জীবন এখন খুবই নগ্ন বিষয় বলে ধরা হচ্ছে। কবি শিস খন্দকার তাই উচ্চারণ করেন- 
‘হন্তারকের চোখ বিনিদ্র প্রতিটি বিভেদ রেখায়; 
সে চোখে ‘জীবন’ নিছক একটি শব্দমাত্র- 
চাইলেই যার দিকে নির্ভাবনায় গুলি ছোড়া যায়!’ 
(মানচিত্র)

কবি তার গভীর চিন্তাবোধ, ঘটনার বিশ্লেষণ থেকেই রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্র নামক একটি মানচিত্রকে হন্তাকারকের রূপে দেখেছে। আমরা কেউই চাইনা আমদের প্রজন্ম জঙ্গিবাদী হোক, অকাতরে জীবন হারাক। আমরা এও চাইনা অন্তর্বাসে লুকিয়ে থাকা নষ্ট খেলায় মত্ত মানুষমুখোশে থাকা অমানুষগুলোকে প্রকাশ না করে রাষ্ট্র তার বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা চালিয়ে যাক। যদি ধরা জ্ঞান সাড়া করতে থাকে তবে রাষ্ট্র কি মানবতাবিরোধী অপরাধ এড়া পারবে? পারবে না। রাষ্ট্রের জবাব যাই হোক, তা তো মার্কিনীদের মতোই ঘোরপ্যাচানো। সুচারুভাবে জঙ্গি প্রজনন আবার নিধনের নামে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। আগেই উল্ল্যেখ করেছি- শিক্ষানীতির কথা। পাঠ্য পুস্তকেইতো রাষ্ট্র মৌলবাদী বিষবাস্প জড়িয়ে রেখেছে, রাষ্ট্র ধর্ম নামক অনুভূতি নিয়ে এই নিধন কর্মযজ্ঞই বা কিসের? আমরা বিজ্ঞানবাদী লেখক ও কজন তরুণদের হত্যার সময় রাষ্ট্রকে নীরব দেখেছি। বিচারের জোড় দেখিনি। একের পর এক মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যা, তার বিচার কই? একজন তনুর মতো কত তনু ধর্ষিত হলো, খুন হলো তার বিচার কই? ধর্মমোড়লরা যখন নারীদের চরিত্রে কালিলেপন করলম, ওদ্যতা দেখালো তখনও আমরা রাষ্ট্রকে নীরব দেখেছি। রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। আমরা একাত্তরের রাজাকারদের বিচারের জন্য দীর্ঘ একটা সময় অপেক্ষা করেছি, জানিনা আবারও আমাদেরকে এসবের বিচার পেতে আরো ৪৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে কি না। নাকি তখনকার এখনকার মোল্লাবাদেই চেপে যাবে সব? আমরা তো তেঁতুলহুজুরদের সঙ্গে আপোষ চাইনা। চাইনা কোনো মৌলবাদী থিউরি। আমরা চাই মুক্তচিন্তার প্রজন্ম। বিচার চাই আমার মা বোন কিংবা প্রেমিকার প্রতিটি খুনের। চরিত্র হননের ফতোয়া আমরা চাই না। কবি শিস এখানে তার সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরেছেন এভাবে- 

‘যেদিন পার্থিব শীতলতায় সব থেমে গেলো, 
আমার পুরুষ রাষ্ট্র বিজ্ঞের মতো বলে দিলো- 
‘মেয়েটির চলন বাঁকা, পুরুষের দোষ কি বলো? 

এবার নাবালিকা শিশুটির জরায়ু ছিড়ে গেলো, 
রাষ্ট্র জুড়ে অব্যাহত সেই নিয়মের জনরোষ 
হে পুরুষ, হে রাষ্ট্র এবার কার দোষ?’ 
(হে পুরুষ, হে রাষ্ট্র) 

পুরুষশাসিত এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে চমৎকার প্রশ্ন তুলেছেন কবি। একজন নারী ধর্ষিত হলে তার চরিত্র, পোষাক নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু একজন মেয়ে শিশু ধর্ষিত হলে- সেই কথাগুলোর যৌক্তিকতা কোথায়? এটা স্পষ্ট একতরফাভাবে নারীর সংস্কৃতিকে ধর্ষণের জন্য দায়ি করা যায় না। এর দায় পুঁজিবাদী পুরুষেল লোলুপতা, ভোগবাদ ও আধিপত্য বিস্তারের মানবিক মূল্যবোধের স্খলন। 

জঙ্গিবাদ নিয়ে আমরা আগেও কিছুু কথা পাঠ করেছি। বøগার হত্যার মাঝ দিয়েই এরা নিজেদের জানান দিচ্ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টায় রত থেকেছে। যার ফলে আমাদেরকে এর ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে হয়েছে হলি আর্টিজেন হামলার মধ্য দিয়ে। কবি উল্ল্যেখ করেছেন- 

‘এবারের বর্ষা আড়াল হয়েছে আর্টিজেনের রক্তধারায়, 
যখন ধর্ম-ই পড়েছে লজ্জায়- 
এতো আনন্দের উল্লাস কেন মশাই? 
প্রথমত সঙ্গমমত্ত যুবতীর ন্যায় 
সতীচ্ছদের ব্যথা ভোলা উচ্ছ¡াস কি কভু মানুষের মানায়?’ 
(রক্তের দাগ শুকোয়নি) 

এই যে একের পর এক ঘটনা, তারপরও মানুষের নিশ্চুপতা ব্যক্তি স্বার্থে নির্বোধের উল্লাস, কবিকে ভাবিয়ে তুলেছে। মানুষের নীরবতাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র কি করছে এখন? হলি আর্টিজেনের হামলার ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে আড়াল করছে। যে পরিবারগুলোর কথা উঠে এসেছিলো- তাদের নিয়ে রাষ্ট্রের ভাবনা কি? করণিয় কি? তারা উঁচু শ্রেণির বলে পার পেয়ে যাবে? রাষ্ট্রতো তাই-ই করছে। একে একে আড়াল করছে তাদের। এখন যা হচ্ছে- তা শুধু কিছু দারিদ্র পরিবারের মাদ্রাসা পগড়–য়া ছাত্রদের ফোকাসিংই আমাদেরকে দেখানো হচ্ছে। এ নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার প্রশ্ন তুলেছিলেন- কেন একটি শ্রেণিকে রাষ্ট্র তুলে ধরছে? বাকিরা কি দুধে ধোয়া তুলসি পাতা? রাষ্ট্রচিন্তক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছে- যখন মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে এত প্রশ্ন, তখন রাষ্ট্র এর প্রসারইবা করছে কেন? এর পিছে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কি? এদের কর্ম সংস্থান ধর্ম কেন্দ্রিক প্রতিষ্টানগুলোতেই হওয়ার কথা, কিন্তু তা না করে এদের বিচরন তো সর্বত্রই করছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রও এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্র তার দোষগুলো এড়িয়ে যেতে পারেনা, একতরফা দোষও আমরা কাউকে দিতে পারিনা। 

সর্বপরি শিস খন্দকারের কবিতা পড়ে আমরা বলতে পারি- রাষ্ট্রচিন্তার তার বহুগামী চিন্তা আছে। তার কবিতায় যে রাষ্ট্র দর্শন, তা শিসকে রাজনীতি সচেতন কবি বলেই চিহ্নিত করে। সমকালীন ভাবনার পরম্পরায় তীক্ষè রাজনৈতিক ভাবনা নিয়ে এগুবার শক্তি কবির কবিতাতে রয়েছে। কবি শিস খন্দকারের কবিতা ও রাষ্ট্র ভাবনা এখানেই সার্থক বোধ করি- তার কবিতা মানুষকে ভাবিয়ে তোলার যোগ্যতা রেখেছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন