মেনু

রবিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৭

দীপু মাহমুদ -এর গল্প...

দুটি গোল্ডফিস ও অন্যান্য কষ্ট



আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। বরং বলা যায় এতে আমার অনাগ্রহটাই বেশি। প্রকৃতির যা কিছু সৌন্দর্য তা প্রকৃতিতেই মানায়। তাকে নিজের করে নিতে চাওয়ার মধ্যে এক ধরনের অহংকার থাকে। বিশাল সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার আগে যখন মনে হয়, ‘সমুদ্রটা আমার চাই, আমি ওটা কিনে নেব।’ তখন তার মধ্যে দখলিস্বত্ব বড্ড বেশি জোরালো হয়ে পড়ে।  
পাখিরা আমাকে অভিশাপ দেয়। নদীর ছোট ছোট মাছগুলো ছোট্ট ঠোঁট মেলে পানিতে বিন্দু বিন্দু বুদবুদ তুলে আমাকে অভিশাপ দেয়। ছোটবেলায় স্কুল ছুটি হলে ছুটতাম গ্রামে। দাদার বাড়ি। নানার বাড়ি। বন-বাদাড়, নৌকা, নদী। সঙ্গে থাকত এয়ারগান। খুব ছোট্ট ছিল তার গুলি। আমার হাতের নিশানা ছিল ঈর্ষণীয়। বটের পাকা ছোট ছোট লাল ফলে ভরে থাকত সবুজ ঘন পাতার গাছ। হালকা সবুজ রঙের হরিয়াল মনের আনন্দে সেই বটের ফল খেতে জুটত গাছে। আমার এয়ারগান থেকে ছুটে যাওয়া গুলি যখন সেই পাখিগুলোর ডেকে ওঠা, টুকটুক করে লাফিয়ে এ ডাল থেকে ও ডালে যাওয়া থামিয়ে দিত, তখন আমার খুব আনন্দ হতো। জয় করার আনন্দ। পারার আনন্দ। গাছের অনেক উঁচু ডাল থেকে ঘুঘু যখন গুলি খেয়ে ডানা ঝাঁপটে ছটফট করতে করতে নিচে পড়ত, আমি তখন বড় আনন্দ পেতাম। অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের আনন্দ। এই নিষ্ঠুর আনন্দ তখন নিষ্ঠুর মনে হয়নি। নেশা মনে হতো। নদী থেকে জাল টেনে তুলে মাছগুলোকে রাখতাম খালুইয়ে। ছোট ছোট মাছগুলো যখন নিঃশ্বাস নিতে না পেরে বাঁশের খালুইয়ের ভেতর ছটফট করত, তখন ভারি মজা পেতাম। অল্প পানিতে মাছের অস্থির ঝাপটানি আমাকে আনন্দ দিত। 
আগ্রহটা আমার ছোট ছেলে তাপুর। পৃথিবীর তাবৎ কিছুতে তার আগ্রহ। ক্লাসের পড়ার বইয়ের চেয়ে আর সব বইয়ের প্রতি প্রবল ঝোঁক। বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন সবকিছুতে সমান আগ্রহ তার। হঠাৎ হঠাৎ এমন সব প্রশ্ন করে ঘাবড়ে দেয় আমাকে! ‘আচ্ছা বাবা! চাঁদের আকর্ষণে পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটা হয়, তাহলে কী চাঁদে কোনো চুম্বক আছে?’ তাপু আমাকে বলে, ‘আমাদের নিকটবর্তী উজ্জ্বলতম গ্যালাক্সি হলো এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি। ওই গ্যালাক্সিতে আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কি-ওয়ে থেকে অনেক বেশি নক্ষত্র আছে।’ আমি তাপুর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। বুকের সঙ্গে লেপটে থাকা সেই ছেলে আমার কত বড় হয়ে গেছে। এই বর্ষায় ওর বয়স চৌদ্দ পুরবে। লম্বাটে ফরসা ওই মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, ‘তুই কবে এত বড় হয়ে গেলি বাবা!’ ঠোঁটের ওপর হালকা চিকন গোঁফের রেখা। থুতনিতে একটা পশম যেন শক্ত আর লম্বা হয়ে দাড়ি’র মর্যাদা পাওয়ার চেষ্টা করেছে। ‘ব্ল্যাক হোল’ বোঝাচ্ছিল ও আমাকে। আমি তাপুর নন-স্টপ বক্তৃতার একজন মনোযোগী শ্রোতা। লেকচার শেষ করে জিজ্ঞেস করল, ‘কি বুঝলে বলো।’ আমি বললাম, ‘আসছে জন্মদিনে তোকে তো রেজার গিফট করতে হবে রে। এখনই তোর রবি ঠাকুরের দশা।’ তাপু রেগে গেল। ‘তারমানে তুমি আমার কোনো কথাই শোনোনি।’ বললাম, ‘শুনেছি তো। মহাবিশ্বের অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা হচ্ছে ব্ল্যাক হোল। যখন একটা নির্দিষ্ট ভর থেকে বেশি ভর থাকে তখন সেগুলো ভয়ংকরভাবে সংকুচিত হয়ে ব্ল্যাক হোল তৈরি হয়।’ তাপু বলল, ‘বাবা! আমি তো দাড়ি-গোঁফ কাটব না। তবে তোমার ওই রবি ঠাকুর আমি হব না। আমার দাড়ি হবে চে গুয়েভারার মতো। আর্নেস্তো চে গুয়েভারা।’
তাপু নাছোড়বান্দা। অ্যাকোয়ারিয়াম সে কিনবেই। আমি না করতে পারলাম না। ও যখন কোনো কিছুতে আগ্রহ করে আমি না করার জোর পাই না। ওর মা পেতো। ওর মা ওকে ধমক দিয়ে না করত। কতদিন হলো ছেলেটা কেবল আমার বুক ঘেঁষে শুয়ে থাকে। ওর মাকে তো পায় না! আচ্ছা ও কি ওর মায়ের গন্ধ অনুভব করতে পারে!  
হেমা চলে যাওয়ার আগে হৈচৈ, ঝগড়া-ঝাঁটি কিচ্ছু করেনি। রাতে আমি বাসায় না ফেরা পর্যন্ত হেমা অপেক্ষা করত। আমি ফিরলে দুইজন একসঙ্গে ডিনার করতাম। সেদিনও হেমা অপেক্ষা করেছিল আমার জন্য। ও বসে টিভি দেখছিল, সাউন্ড অফ করে। আমি সাপ্তাহিকের পাতা উল্টাচ্ছিলাম। পত্রিকাটা বন্ধ করে ঘুমুতে যাওয়ার আয়োজন করছি যখন, হেমা তখন টিভি অফ করে আমার দিকে ঘুরে বসল। আমরা অনেকদিন হলো আলাদা ঘুমাই। বেডরুমে হেমা তার বিছানা আলাদা করে নিয়েছে। কেন, জিজ্ঞাসা করিনি কোনোদিন। হেমা বলল, ‘আমাদের আর একসঙ্গে থাকা সম্ভব হচ্ছে না এটা নিশ্চয় তুমি বুঝেছ?’ আমি কিছু বুঝতে পারিনি। তবে তিনদিন ধরে ওর মন ভার ছিল। কেন ওর মন ভার ছিল জানা হয়নি। ও বলতে চায়নি, আমিও জানতে চাইনি। যে যার কাজ নিয়ে থেকেছি। আমি সংসারের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্বশীল না, সন্তানদের ব্যাপারে না। স্ত্রীর দিকে আমার কোনো খেয়াল নেই, খোঁজখবর রাখি না, কী তার ভালো লাগে, কীসে সে আনন্দ পায়, কষ্ট পায়- সব ব্যাপারেই বড্ড উদাসীন, আমার প্রতি এরকম হাজারো অভিযোগে হেমা হাঁপিয়ে উঠেছিল। ডিভোর্স, ল’ইয়ার, কাগজপত্র কোনো কিছু না। হেমা ওর ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল। সকালে উঠে বাসা ছেড়ে চলে গেল। ছেলেমেয়েরা তখনো ঘুমাচ্ছিল। আমি বিছানায় উঠে বসেছিলাম। একটা কথাও বলেনি হেমা। আমি চুপচাপ ওর চলে যাওয়া দেখলাম।   
অ্যাকোয়ারিয়াম আমাকে কিনতেই হলো। সঙ্গে দুটো গোল্ডফিস। বেশ দেখতে। মাছ দুটোর ভেতর কেমন একটা আভিজাত্য আছে মনে হলো। সোনালি মাছের সাদা বুক। সাদা কালো মেশানো ছোট ছোট পাথর কেনা হলো অ্যাকুরিয়ামে দেওয়ার জন্য। ফিল্টার, মাছের খাবার, আর যা কিছু লাগতে পারে সবই নিল তাপু তার মাছের জন্য। আমি মাছ দুটোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওরা একটা অ্যাকুরিয়ামে অনেকের সঙ্গে ছিল, এখন ওরা কেবল দুইজন।
তাথৈ টিচারের বাসা থেকে ফিরে অ্যাকোয়ারিয়াম দেখে হৈচৈ শুরু করে দিল। আমি ভেবেছিলাম ও বুঝি খুশি হবে। মেয়ে আমার খুশি হলো না। রাগারাগি করল। তাথৈ বলল, ‘বাবা! তুমি তাপুর সব কথা শুনে শুনে ওকে জেদি বানিয়ে দিচ্ছো। এটা কিন্তু তুমি ঠিক করছো না। তুমি দেখেছো তাপু কেমন মুখে মুখে কথা বলে এখন। আমার কোনো কথাই শোনে না। আর তোমার ওই অ্যাকোয়ারিয়াম পরিষ্কার করবে কে? পানি পালটাবে কে? মাছকে খাবার দেবে কে? তুমি ভেবেছো তাপু করবে? দু’দিন যাক, ওর সখ মিটে যাবে। আমি তো জানি, ওকাজ আমাকেই করতে হবে।’
তাথৈ এ-লেভেল করছে। বড় ভালো মেয়ে। বাবার প্রতি ওর বুঝি পক্ষপাতমূলক টান আছে। ওর মা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ক’দিন বাদে এক ছুটির দিনে সকাল বেলা এসেছিল। তাথৈ আর তাপুর সঙ্গে বসে অনেকক্ষণ কথা বলল। কেন ওদের মায়ের সঙ্গে গিয়ে থাকা উচিত তা অনেকভাবে বোঝাল। বাবার সঙ্গে থাকলে যে ওদের পড়াশুনা হবে না, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারবে না, তাপুকে স্কুল থেকে বের করে দেবে, তাথৈ এ-লেভেল শেষ করে ভালো কোথাও ভর্তি হতে পারবে না- এসব কথা যুক্তি দিয়ে একটা একটা করে দুইজনকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল হেমা। তাথৈ আর তাপু কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল মায়ের কথাগুলো। হেমা বলল, ‘তোমরা কি আমার কথা বুঝতে পারছো?’ তাথৈ বলল, ‘পারছি।’ হেমা তাপুকে জিজ্ঞেস করল, ‘তাপু তুই?’ তাপু বলল, ‘পারছি।’ হেমা জানতে চাইল, ‘তাহলে তোরা আমার সঙ্গে যাচ্ছিস?‘ তাথৈ বলল, ‘না।’ তাপু বলল, ‘আমি বাবার কাছে থাকব।’

অ্যাকুরিয়ামের স্বচ্ছ পানিতে গোল্ডফিস দুটো সাঁতরে বেড়াচ্ছে। একপাশ থেকে অন্যপাশ পর্যন্ত পরিভ্রমণের ভেতরেই ওদের চলাচল সীমাবদ্ধ। মাছ দুটো মাঝে মাঝে মুখ হা করে আবার ঠোঁট দুটো বন্ধ করে ফেলছে। অ্যাকুরিয়ামের একপাশ গভীর সমুদ্র তলদেশের ছবিওয়ালা স্টিকারে ঢাকা। অ্যাকুরিয়ামের ভেতর প্লাস্টিকের আর্টিফিশিয়াল সবুজ সামুদ্রিক গাছ। বিজবিজ করে ওয়াটার ফিল্টার অক্সিজেন ছড়িয়ে দিচ্ছে পানিতে।
তাথৈ হাঁটু মুড়ে বসে আছে অ্যাকুরিয়ামর সামনে। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সন্তরণরত মাছ দুটোর দিকে। দুই হাতের ভেতর ওর ছোট্ট মুখ। আমি জানিনা সন্তরণরত মাছের দিকে তাকিয়ে মেয়ে আমার কী ভাবছে! যেমন কোনোদিন জানিনি হেমা কী ভাবত। 
অ্যাকুরিয়ামের দিকে তাকিয়ে তাথৈ’র মনে হয়েছে, এই যে অ্যাকুরিয়াম। এই যে দুটো মাছ সেখানে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, তার সঙ্গে তার অনেক মিল। বদ্ধ একটা জীবন। পাশাপাশি দুটো মাছ একসঙ্গে ঘুরছে ফিরছে অথচ কেউ কাউকে কি একটিবারের জন্যও নিজের একান্তের কথাটা বলতে পেরেছে। তাথৈ তো কতবার ভেবেছে সে বলবে। কই বলতে পারেনি তো। সপ্তাহে তিনদিন কোচিংয়ে যায়। পড়ে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, ইচ্ছা হলে কফি শপে গিয়ে বসে। কিন্তু ওই তিনদিন, এবং প্রতিদিন কোনো একজনের জন্য প্রতীক্ষার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেল কিভাবে! তাথৈ মুঠো করা হাতের ওপর মাথা রেখে অ্যাকুরিয়ামের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে, আমি কি লাবণ্য না মাধবীলতা! নিজের ভেতর নিজে সিদ্ধান্ত তৈরি করে, আমি মাধবীলতার পক্ষে। লাবণ্য! সে বড় স্নিগ্ধ, শান্ত। সৌন্দর্য কেবল নিজের ভেতর। আর মাধবীলতা সংযত। নিজেরটুকু নিজের করে পেতে লড়তে জানে। সে শাশ্বত। তাথৈ ভাবে, আমি কেন তবে এই কথাটা বলতে পারিনি। কেন আমি জোর করতে পারিনি সপ্তাহে তিনদিন এবং প্রতিদিন প্রতীক্ষার পরও! কেন বলতে পারিনি, সুন্দরকে আঁকড়ে ধরো। বোকার মতো উপড়ে ফেলে দখল করতে চেয়ো না। ভেঙেচুরে নিজের করে পেতে চেয়ো না রক্তকরবী’র রাজার মতো। আমি নন্দিনী নই। খুব সাধারণ একজন মেয়ে। হয়তো কোথাও অসাধারণ। তবে নন্দিনী যদি হই, তবে রঞ্জনকে খুঁজি, রাজাকে না। সৌন্দর্যকে খুঁজি, কদর্যকে না। কেন আমি বোঝাতে পারিনা সুন্দর অনুভবের। সুন্দর মননে, বিশ্বাসে, শ্রদ্ধায়, সততায়। তাকে আটপৌরে সাধারণ নিয়মে আটকে দেওয়া যায় না। তাকে ধারণ করতে হয় একান্তই নিজের ভেতর।   
আমার দিকে তাকায়নি তাথৈ। আমি অ্যাকুরিয়ামের পাশে সোফার ওপর গিয়ে বসেছি ও বুঝতে পেরেছে। অ্যাকুরিয়ামের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে তাথৈ বলে, ‘বাবা! এই গোল্ডফিস দুটো কি নিজেদের ভেতর কমিউনিকেট করে?’ 
আমি কিছু বললাম না। তাথৈ উঠে চলে গেল।
অ্যাকুরিয়ামের পাশে সেন্টার টেবিলে একটা বই। বইটা খুলে পাতা উল্টালাম। প্রথম পাতায় বেশ গুছিয়ে কেউ একজন ঝকঝকে নীল কালিতে একটি ইংরেজি কবিতার কয়েকটা লাইন লিখেছে,  
‘লোহার বাজারে গিয়েছি আমি
শিকল কিনেছি
কঠিন শিকল
তোমারই জন্য
হে আমার প্রেম...’। 
নিচে লেখা ‘সুন্দর একজন মানুষ তাথৈকে- এস’। আমি অনেক ভেবেও ‘এস’ অদ্যাক্ষরের কাউকে মনে করতে পারলাম না, যে আমার একলা এই মেয়েকে বই গিফট করতে পারে।     
মা চলে যাওয়ার পর তাথৈ মেয়েটা বড় হয়ে গেল। নিয়মিত আমার ব্লাড প্রেশার চেক করে, ছুটির দিনে নিজে থেকেই দোকানে যায়, তরিতরকারি কিনে আনে। তাপু নিজে শ্যাম্পু করতে পারেনা বলে মাঝে মাঝে শ্যাম্পু করে গোসল করিয়ে দেয়। তাপুকে গল্প পড়ে শোনায় যেমন ওর মা শোনাত। আবার ওই তাপুর সঙ্গেই ঝগড়া করে, চিৎকার চেঁচামেচি করে। তবে বেশিরভাগ সময়ই তাথৈ ভীষণ চুপচাপ থাকে। বই পড়ে, টিভি দেখে, ঘাড় হেলিয়ে দুই পায়ের নখে খুব যত্ন করে নেইল-পলিশ দেয়। একেবারে নিজের ভেতরে থাকে। আমি প্রায়ই ওর মনের তল খুঁজে পাই না। আমার মন ভালো রাখার জন্য কিনা জানি না, তাথৈ আমাকে গান গেয়ে শোনায়, নতুন পড়া কোনো আর্টিকেল নিয়ে আলোচনা করে, হৈহৈ করে রান্নার আসর বসায়। আমি একদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কিরে তোর কোনো বন্ধু নেই? এই বয়সে ছেলেমেয়েদের কত বন্ধু থাকে। তোর কোনো বন্ধুকে তো কোনোদিন বাসায় আসতে দেখলাম না। তুইও তো যাস না কারও বাসায়।’ মেয়ে আমার কথার কোনো উত্তর দেয় না। আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বারান্দায় চলে যায়। মেয়ে আমার একা একা হেঁটে বেড়ায় বাসার ভেতর। যেন সবার ভেতরে থেকেও ও একলা একজন মানুষ।
বারান্দার গ্রিলে থুতনি ঠেকিয়ে আকাশ দেখে তাথৈ। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে কথা বলে। বাবা তুমি কি জানো আমার মনটা খুব খারাপ? মনের জোর ফুরিয়ে গেছে। হুট করে একটা ধাক্কা এলেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। আমার আমিকে কোথাও খুঁজে পাই না বাবা! হারিয়ে ফেলেছি। এই আমি যেন আমি না, অন্য কেউ। আমার যেন কী হয়েছে, আমি আমাকে খুঁজে পাচ্ছি না। তাই বুঝি আমার চারপাশটা এত অন্ধকার! আমার তো কেউ নেই, যেখানে হুটহাট মনের কপাট খুলে ধরতে পারি। মন কোথাও থিতু হতে চায়। কোথায় থিতু হতে চায় মন কে জানে! তাথৈ আকাশের দিকে তাকায়। মেঘ ভেসে যাচ্ছে। ও মেঘ হয়ে যায়। ভেসে যায় আকাশে। মনে মনে বলে, কোথাও কিছু রইল না আমার। না রাগ, অভিমান, দুঃখ, আনন্দ, কষ্ট, ঈর্ষা, হিংসা, ভালোবাসা- কিচ্ছু না। একটুখানি স্নেহ রাখলাম সঙ্গে আর একটু শ্রদ্ধা কোথাও কোনোখানে। কোথাও কোনো প্রত্যাশা রইল না আমার। আমি মিলিয়ে গেলাম দূর দিগন্তে, নীল আকাশে মেঘের ওপাশে হিম হিম বাতাসে, ফেনিল সাগরে। আমি চলে গেলাম ভেসে ভেসে আমার ছোট্ট নদীর টানে। 
অ্যাকুরিয়ামের দিকে তাকিয়ে ছিলাম একেবারেই অন্যমনে। হঠাৎ খেয়াল করলাম একটা মাছ সাঁতরে বেড়াচ্ছে। আমি ইতিউতি ওই মাছের জোড়াকে খুঁজছিলাম অ্যাকুরিয়ামের ভেতর। আরেকটা মাছ সবুজ গাছের ছড়ানো পাতার আড়ালে ছিল। খানিকটা পানির উপরের দিকে। একেবারে নির্জীব। আমার সাধারণ বুদ্ধি আমাকে জানাল, মাছটা মরে যাচ্ছে। ছেলে মেয়ে কাউকে কথাটা জানানো দরকার। কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না।  
আমার খুব হেমার কথা মনে হলো। চোখ বন্ধ করে আমি হেমাকে ভাবতে চাইলাম।
হাতে বোনানো উলের হালকা শাল গায়ে হেমা দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। কবরের মরা শুকনো বাঁশের খুঁটিটা চেপে ধরে আছে আলতো করে। সকালের রোদ্দুর যেন ধুয়ে দিচ্ছে হেমার নগ্ন ফর্সা পা দুটো। ওকে আশীর্বাদ করতেই বুঝি মাথায় তুলে দেওয়া ওড়না বেয়ে গাছের ডাল খসে গোলাপী কাঞ্চন ঝরে পড়ল ওর সামনে।
মধ্য ফাল্গুন। ছায়া ছায়া গ্রাম বলে হয়তো বা এখানে এখনো শীতের আমেজ রয়ে গেছে। গ্রামের একেবারে একপ্রান্তে এই গোরস্তান। জড়াজড়ি করে বেড়ে ওঠা বাঁশে-ঢাকা গোরস্তান বড্ড বেশি সুনসান। বাঁশের ঝরা পাতায় হঠাৎ বাউড়ি বাতাসের ঘূর্ণি অদ্ভুত এক হাহাকার ছড়িয়ে দিচ্ছে কেবল চারপাশে।
হেমা দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে আসা অশ্রু ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল আবারও। সে ঠিক করেছে আর কাঁদবে না। তবুও যতবার এখানে আসে, বুক চেপে আসে। দু’চোখ গড়িয়ে নামে অশ্রু। প্রতি সপ্তাহে একদিন সে আসে এখানে। হেমা জানে কথা বলতে বরাবরই আমি ভালোবাসি। আমার জীবনের সব অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, কী পেয়েছি, কী পাইনি, অনুযোগ-অভিযোগ-অনুতাপ-অভিমান সবকিছু তাকে বলতে হবে। আর বলতে হবে সব যেন তার কাছেই। হেমার বুঝি মনে হয় এখনো অনেক কথা বলা বাকি রয়ে গেছে আমার। হেমা আসে আমার সেই না-বলা কথাগুলো শুনতে।
গ্রামের কেউ কখনো আগে দেখেনি হেমাকে। আগে কখনো তো ও আসেনি এই গ্রামে। বিয়ের পরে আমি ওকে কতবার বলেছি ‘হেমা একবার চল। আমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর। দেখবে তোমার ভালো লাগবে।’ হেমা বলেছে, ‘না। গ্রামে যেতে আমার ভালো লাগে না।’ 
প্রত্যেক মঙ্গলবার সকালে হেমা আসে একটা সাদা গাড়ি চড়ে। গাড়ি থামে গোরস্তান বরাবর রাস্তার মুখে। হেমা গাড়ি থেকে নেমে বাঁশের ঝরা পাতা মাড়িয়ে গিয়ে দাঁড়ায় কবরের কাছে। স্থির দাঁড়িয়ে থাকে কতক্ষণ। যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনছে। ওর নীরবতা নির্জনতাকে ডেকে আনে, বাড়িয়ে দেয় আরও। শ্বাসকষ্ট শুরু হয় হেমার। বুকের ভেতরটা শুকিয়ে আসে। বুকের ভেতর গোরস্তানের হু হু বাতাস টেনে নিয়ে চেপে আসা নির্জনতাকে ভাঙে নিজেই। বিড়বিড় করে কথা বলে যায়। তারপর সারি সারি কবরের পাশ দিয়ে একে-বেঁকে যাওয়া সরু পথ ধরে হাঁটে আপনমনে।
ঘুমমতো এসে গিয়েছিল হয়তো। পায়ের ধাক্কায় সেন্টার টেবিলটা নড়ে ওঠে। চোখ মেলে দেখি অ্যাকুরিয়ামের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে আছে তাথৈ। আমি আবার আলতো করে চোখ বন্ধ করে ফেলি।
নিজের ভেতর জোর খুঁজছে তাথৈ। কেউ যেন সব অপরাধ স্বীকার করে শরণাগত হয়েছে তার। তাথৈ তাকে ক্ষমা করেছে। চোখ বন্ধ করে তাথৈ নতজানু হয়ে বসে আছে। প্রার্থনা করানোর ভঙ্গিতে নিজের মনে নিজে কথা বলে চলে। প্রতিজ্ঞা কর। বল! আমি মুক্তি চাই। শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্তি চাই। সমস্ত অসুন্দর থেকে মুক্তি চাই। আমি স্পর্শ করতে চাই অপার সৌন্দর্য। বল! তুমি তোমাতে স্থেয়। নিজের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা অপরিসীম। বল! সমস্ত প্রলোভন থেকে তুমি মুক্ত। মর্যাদাহীন, হীন, নীচ কাজ থেকে তুমি মুক্ত। তোমার সাহস আছে, তেজ আছে, সক্ষমতা আছে বরাবর। বল! তুমি আকাঙক্ষা কর সৌন্দর্য। তুমি ধৈর্য ধারণ কর। শান্ত হও। নিয়ন্ত্রণ কর নিজেকে। তোমার জন্য তো সঞ্চিত আছে সেই অপার সৌন্দর্য যা তুমি চাও।  
চোখ বন্ধ করে আমি হেমাকে ভেবে চললাম।
হাঁটতে হাঁটতে গোরস্তানের শেষপ্রান্তে পৌঁছে যায় হেমা। গোরস্তান শেষ হওয়ার পর ঢালু জমি। হেমা দাঁড়িয়ে থাকে। ঢালু জমি গিয়ে মিশেছে নদীতে। নদী এখন শীর্ণপ্রায়, নিস্তরঙ্গ। কেবল বয়ে চলা। নদীর পানিতে সূর্যের আলোর প্রতিফলন চোখে ধাঁধা লাগায়। তবুও এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে হেমার সূর্যাস্ত অবধি।
হেমা জানে, এই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে ভালো লাগত আমার। আমি কতদিন ওর কাছে আমাদের গ্রামের এই নদীর গল্প করেছি। আমি ওকে বলেছি, এই গ্রামের নদী ধরে সূর্যাস্ত হয় অন্যরকম। আমি ওকে বলেছিলাম, ‘কোনো একদিন ওই নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আমরা দু’জন সেই অন্যরকম এক সূর্যাস্ত দেখব। দু’জনে একসঙ্গে দেখলে সেই সূর্যাস্ত হবে আরও অন্যরকম, একেবারে নতুন কিছু।’
‘এত পাগল কেন ছিল সে’ ভাবে হেমা। ভাবতে ভাবতে ফিরে আসে আবার কবরের আঙিনায়। হাঁটু গেড়ে বসে। দুই হাতের পাতা মাটির ওপর রেখে বুলাতে বুলাতে ভিজে ওঠে চোখের পাতা।
ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে হেমা। চোখ মোছে। থমকে যায়। এবার ফিরে চলে। কবরের ধার ঘেঁষে সরু পথ। তারপাশেই গোলাপী কাঞ্চন গাছ। পথ আর সেই গাছের দিকে তাকাতে তাকাতে ফেরে হেমা। গোরস্তান থেকে বেরুনোর মুখে বেশ অস্থির দেখায় ওকে। ডাইনে-বাঁয়ে তাকায় আর হাঁটে। কি যেন খুঁজে ফেরে। বুকের ভেতর খামচে ধরে গোরস্তানের বৃক্ষ-শাখা, কাশ, এলোমেলো বাঁশের কঞ্চিসকল। হেমা ভাবে, ‘বেঁচে থাকতে যাকে বাঁধেনি কখনো। মরার পরে বাঁধনটা ছিঁড়তে পারে না একটুও। যত ছেড়ে যেতে চায় তত ও ওর বাঁধন শক্ত করে আরও।’
তাথৈ হৈচৈ করছে, ‘বললাম দু’দিন গেলেই তোর সখ মিটে যাবে। শুধু শুধু তুই বাবাকে দিয়ে অ্যাকোয়ারিয়াম কেনালি। নিজে তো কোনোদিন মাছের যত্ন নিস না। একটা মাছ যে মরে যাচ্ছে তাতেও তো তোর কোনো রি-অ্যাকশন দেখছি না।’ তাপু কিছু বলে না। ও এখন নতুন কিছুতে মেতেছে। জেদ ধরেছিল। ওকে রঙের টিউব, ইজেল, ব্রাশ, তুলি, প্যালেট, মাউন্ট পেপার সব কিনে দেওয়া হয়েছে। তাপু এখন ছবি আঁকে।
কোথা থেকে আসে মেয়েটি? বৃদ্ধ ছাদেকালি দু'হাতে নিজ কোমরে চাপ দিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে হেমার সামনে। পরনে তাঁতের লুঙ্গি। গায়ে হাফ হাতা মিলের গেঞ্জি। দু'হাতে কাদামাটি। নতুন কবরের মাটি ধ্বসে গেছে। সেখানে মাটির জোগান দিচ্ছিল সে। বয়স হয়েছে ঢের। চোখের জ্যোতি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে মুখটাকে এগিয়ে আনতে হয় অন্য মুখের খুব কাছাকাছি। তাই করল ছাদেকালি। হেমার মুখের কাছাকাছি নিজের মুখটাকে এগিয়ে এনে জিজ্ঞেস করল, ‘কিডা গো মা তুমি?’
হেমা বড় বিপন্ন বোধ করে। নিজের মনের জোর হারিয়ে ফেলে। সে কিছুতেই তার এখানে আসার যুক্তি দাঁড় করাতে পারে না, তবুও তার মন এখানে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। তবে কেন ছেড়ে চলে এসেছিল অমন করে! কে সে?
হেমা বলে, ‘এখানে কোথাও গন্ধরাজের চারা পাওয়া যায়?’
বৃদ্ধ বলে, ‘হ্যাঁ যায়। খুনকার বাড়ির বাগানেই পাওয়া যায়।’
‘আমাকে একটা গন্ধরাজের চারা এনে দেবেন?’
বৃদ্ধ সম্মতি জানায়। বলে, ‘হ্যাঁ দেব।’
হেমা চলে যায়। 
তাথৈ বলে, ‘বাবা, তুমি কি একবার ওই মাছের দোকানে ফোন করে দেখবে মাছটা কেন মরে যাচ্ছে। ওটাকে বাঁচানো যায় কিনা?’
আমি বললাম, ‘ওই দোকানের ফোন নাম্বার তো আমার জানা নেই।’
মনের ভেতর কোথাও চাপা একটা অস্থিরতা বোধ করছে তাথৈ। তবে বড্ড তীব্র এবং তীক্ষ্ণ সেই অস্থিরতা। কেন এই অস্থিরতা তা ঠিক ঠিক ঠাওর করতে পারছে না। কোনো একজনের সঙ্গে কথা বলতে পারলে হয়তোবা অস্থিরতা খানিকটা কমত। কিন্তু কী বলবে। কিভাবে শুরু করবে কোনোকিছুই স্থির করতে পারে না।
তাথৈ আমার সামনে থেকে চলে যায়।
হেমা আবার আসে পরের মঙ্গলবার সকালে। ছাদেকালি গন্ধরাজের চারাটা তুলেছে খুব যত্ন করে। তরতরে সজীব ছোট্ট গাছটার চারপাশ গোল করে মাটির চাপ কেটে তুলে এনেছে। নিড়ানিও এনেছে সঙ্গে। পায়ের কাছে বদনায় পানি। গাছের গোড়ার আলগা মাটিতে পানি ঢেলে দিতে হবে ওর দীর্ঘায়ু ও জীবনীশক্তি কামনা করে। যে জীবনীশক্তি দিয়ে সে ফুল ফুটিয়ে চলবে সারা বছর। 
কবরের শিয়রের পানে গন্ধরাজের চারাটা পুঁতে হেমা দু’হাত দিয়ে মাটি চেপে দিল শক্ত করে। পানি ছিটিয়ে দিল নিজ হাতে। ছাদেকালি অবাক হয়ে দেখে হেমার দু'হাত খালি। মুখের দিকে তাকাল। কান খালি, গলা খালি। গ্রামদেশে হাত-গলা খালি রাখে না কেউ। তবুও ছাদেকালির মনে হলো হেমাকে দেখাচ্ছে বিকেল রোদের পাকা যবক্ষেতের মতো সুন্দর, অঘ্রাণের নদীর মতো শান্ত। এত সুন্দর মানুষ সে আগে কখনো দেখেনি।
বৃদ্ধ তার চোখের ক্ষীণ জ্যোতি দিয়ে হেমার চোখেমুখে কিছু একটা খুঁজে ফিরছিল। বলল, ‘মাগো, মেয়েছেলের গোরস্তানে আসা বারণ। আমি অনেককে নিষেধও করেছি। কিন্তু তুমি যখন আসো তখন কেন জানি না করতে পারিনি।’
তাপু এসে বলল, ‘বাবা দেখ তো ছবিটা কেমন হয়েছে।’ আমি চোখ মেলে তাকালাম। একটা ধূসর ফাঁকা রাস্তা। দু’পাশে মেপল গাছের পাতায় খয়েরি রং ধরেছে। ঝরে পড়েছে শুকনো পাতা। নিচের সবুজ সেই বিবর্ণ পাতায় ঢাকা পড়েছে। 
আমি বললাম, ‘বাহ! খুব সুন্দর এঁকেছিস তো।’
তাপু চলে গেল হাঁসের মতো ডানে-বামে শরীর দুলিয়ে। 
হেমা চলে যাচ্ছে। বৃদ্ধ হাঁটছে তার সঙ্গে। নিজ মনেই কথা বলছে, ‘জানো মা, আমি মুর্দাদের কথা শুনতে পাই। ছন্নছাড়া মানুষ। গোরস্তানেই থাকি। যখন সূর্য ঠিক মাথার ওপরে ওঠে। দু’একটা পাখি র্ট র্ট করে ডেকে ওঠে। কিংবা ধরো ওই সাঁঝের বেলা, যখন ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকতে থাকে তখন মুর্দারা আমার সঙ্গে কথা বলে।’
হেমা থেমে যায়। ঘুরে তাকায় ছাদেকালির পানে। বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করে, ‘কিছু বলবা মা?’
হেমা বলে, ‘সে কোনোদিন কিছু বলেছে আপনাকে?’
বৃদ্ধ বলে, ‘বলেছে।’
হেমার কণ্ঠস্বর বড় মনোরম মনে হয় বৃদ্ধ ছাদেকালির কাছে। দোতারার ছড়ে টান দিলে যেমন বাতাসে কম্পন তুলে শব্দ ছড়িয়ে যায় দূরে, তেমনি হেমার কথাও যেন ভেসে আসে বাতাসে সুরের তরঙ্গ তুলে। হেমা ছোট্ট করে শুধায়, ‘কী বলেছে?’
‘বলেছে, যে মেয়েটা আমাকে দেখতে আসে সে বড় দুঃখী একজন মেয়ে। ওকে তুমি দেখ।’ এই কথা বলে বৃদ্ধ হেমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমার কিসের কষ্ট গো মা? আমি পাগল মানুষ, আমাকে বলে কোনো লাভ নাই। তাও বলতে পার।’
হেমার বড় বড় চোখজোড়া পানিতে ডুবে যায়। হেমা বলে, ‘আমিও ওর কথা শুনতে পাই। ও অনেক কথা বলে। ওর কথা শুনতেই আমি এখানে আসি।’
আমার চোখ ভরে আসে পানিতে। কুয়েবিদোর তিনটি লাইন মনের ভেতর ভাসতে থাকে।
'হায় মৃত্যু, হায় মানুষের অপরাজেয় নিয়তি
আগামিকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকাতে আমি কোনো আশা দেখি না
কেবল নিজের মৃত্যুর বিনিময়ে ওই মৃত্যুকেই কেনা ছাড়া।'
তাথৈ বলে, ‘বাবা! আমার এক বন্ধু আছে, খুব ইন্টিলিজেন্ট। ও যদি আসে তাহলে মাছটাকে দেখে ঠিক বলতে পারবে কিভাবে ওকে বাঁচানো যায়।’
আমি বললাম, ‘তোর বন্ধু! কী নাম?
তাথৈ বলল, ‘সাফকাত’।
বললাম, ‘আসতে বল।’
আমি সুখ বোধ করি। মনে হয় এই প্রথম আমি যেন কাউকে বুঝতে পারছি। ইংরেজি ‘এস’ বর্ণটি আমার কাছে প্রাণোচ্ছল, চঞ্চল, সৌন্দর্যে মোড়ানো পুরো একটা জীবন হয়ে ধরা দেয়। 
তাথৈ মোবাইল ফোনের বাটন টিপে একটু যেন লাফিয়ে ওর নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।
হেমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই পানি সে আটকায় না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন