মেনু

ইরাবতী তটিনী -এর গল্প

ইরাবতীর পূর্বজন্মের ইতিহাস
ইরাবতী তটিনী


   প্রায় তিনদিন চুলোয় আগুন জ্বলছে না, গৃহের একমাত্র উপার্জন করা মানুষটা সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েছে! কারণ তখন চৈত্যমাস মাঠঘাট রৌদ্র দাহে ফেটে চৌচির! ফসল উৎপাদনের সুযোগ নাই, তাই কৃষকগোষ্ঠীর অনেক দিন কাজও নাই! ফসল উৎপাদনের সময় কৃষকরা ঠিকঠাক মত ফসল ঘরে তুলতে পারতো না, তবুও তাদের পরিবার সারাদিনে একবেলায় খাবার ব্যবস্থা হতো! কৃষক পরিবার গুলো বউ বাচ্চা নিয়েও বেঁচে থাকার মত অবস্থা ছিল। ক্রমশ সংসারে যখন একবেলা খাবার জোগাড় করতেও ব্যর্থ হচ্ছিল! একদিন তার বউ ইরাবতীকে ঘুমোতে যাবার সময় বললো, 'বউ আমরা তো মনে হয় এবার না খেয়ে মারা যাবো রে!'
—বড় বাবুর কাছে যাবো? আমি গেলেই কিন্তু তোমার একটা কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাবে!
—না থাক, লোকটার নজর খারাপ, তোমার দিকে কুদৃষ্টি পড়বে!  প্রয়োজনে না খেয়ে থাকবো, তবুও সম্মানটুকু বেঁচে থাক!
   ইরাবতী তখন দু'বাচ্চার জননী, পরিবারে খাবারের মুখ বাড়ছে— সাথে চিন্তাও, কীভাবে চলবে চার জনের সংসার! অবিভক্তবাংলা ছিল তখন। ইরাবতী একটা সংস্কৃত কলেজে স্নাতকে পড়ে। মুসলিম মেয়ে সংস্কৃত কলেজে পড়া কেউ খুব একটা সুনজরে না দেখলেও ইরা কাউকে পাত্তা দেয়ার মেয়ে নয়! তৎকালিন সমাজে ১০/১১ বছরের মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতা থাকলেও, ইরা ছিল সম্পূর্ণ স্রোতের বিপরীতে চলা মেয়ে, দু'চোখে ছিল সাম্যবাদের স্বপ্ন! কৃষক শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলনের সময় ইরা এক হতদরিদ্র কৃষকের প্রেমে পড়ে এবং স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় বিয়ে করে ফেলে! বিয়ে হয়ে গেলেও তার আন্দোলন কিংবা পড়ালেখা কিছুই বন্ধ হয়ে যায়নি।
   বিয়ের বেশ কিছু বছর পর। একরাতে কৃষক বউকে বললো, 'একটা কথা বলি?'
—বলো।
—মাঝে মাঝে তোমার পাশে শু'তে আমার ভয় করে!
—কেন? আমি বাঘ না ভাল্লুক!
—নাহ্, তুমি কত লেখাপড়া জানা মেয়ে, আমার মত একটা মূর্খ স্বামীর পাশে মানাচ্ছে না একদম, তার উপর চাহিদা মত কিছুই দিতে পারছি না!
—দু'বাচ্চা হবার পর একথা মনে হল? আগে বললেই হতো, চলে যেতাম!
   খেয়াল করলো ইরা, কৃষকের চেহারাটা  কিরকম নিরীহ দেখাচ্ছে। নিরীহ কৃষক একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বললো, 'বলা উচিত ছিলরে বৌ! কে জানতো আমার অবস্থা এতোটা খারাপ হবে।'
—আচ্ছা পাশে শু'তে বেশি অসুবিধে হলে বালিশ ফেলে দাও।
—কেন? তাইলে কোথায় শু'বো?
—আমার উপরে, না হয় আমি তোমার...।
বেশ লজ্জা পেয়েছে লোকটি! ফান করার উদ্দেশ্য ছিল, ওকে দীর্ঘশ্বাস থেকে বের করে আনা। কাজের কথা বলছি শোন, 'আমরা তোমাদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে যাচ্ছি, যদিও এটা কৃষকের আন্দোলন আমার কাজ হচ্ছে স্লোগান লেখা!'
—কীসের আন্দোলন?
—এটা হচ্ছে তেভাগা আন্দোলন। তোমাদের উৎপান্ন ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ তোমরা বুঝে পাবার আন্দোলন! কথা দিচ্ছি, তোমাদের সাথে আর কোন অন্যায় হতে দিবো না।
   তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি কথা দিয়েছেন, তেভাগা আন্দোলন সফল করবেন। চারজনের সংসার আর একবেলা খাবারেরও ব্যবস্থা হচ্ছে না। চিন্তা করছে কী করবে? ইরা তখন শিয়ালদা স্টেশন মাস্টারের কাছে গিয়ে একটা চাকরির খোঁজ করে! ইরার বাবার বন্ধু ছিল, বেশ ভাল লোকটি। ইরাকে মেয়ের মত ভালোবাসে। তাকে ধরে শিয়ালদা স্টেশনের টিকিট কাল্টেক্টরের চাকরি নেয় সে— ৭৫ টাকা বেতন। চাকরিটা পাবার পর জামাই, ছেলে-মেয়েদের রেখে চলে যায় শিয়ালদা। আর ওরা থেকে যায় দিনাজপুরে। মাসশেষে ৫০ টাকা পাঠায়, ওতেই ভাল চলে যায় তিনজনের। কিন্তু দুনিয়ার নিয়ম অনুসারে নিম্নবিত্তদের ভালো থাকা প্রকৃতিও সহ্য হয় না।
   সে বছরে হঠাৎ করে বাংলায় মন্বন্তর দেখা দিলো। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি, দেশে খাবার নেই, চারদিকে হাহাকার। এটা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান যখন বার্মা (মায়ানমার) আক্রমন করে, বার্মার লক্ষ লক্ষ জনগন চট্রগ্রাম বন্দর দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করে। একদিকে বাড়তি জনসংখ্যা, অন্যদিকে সে বছরের খরা। খাদ্যঘাটতি চরম আকার ধারন করলো। ইরার বেতনের সবটা পাঠিয়েও কিচ্ছু হচ্ছে না! কারণ দেশের অবশিষ্ট খাদ্য শাসকগোষ্ঠী আর জমিদার শ্রেণীর জন্য গুদামজাত করে ফেলছে, সাধারনের জন্য কোন খাবার নেই। ইরা বুঝতে পারছে যা পাঠাচ্ছে তাতে কিছুই হচ্ছে না— কিন্তু নিরুপায়।
   জুলাই মাসের শেষের দিকে ইরার একটা চিঠি আসে। শিয়ালদা পোস্টম্যান দিয়ে যায়। এটি মাসের ৯ তারিখে পাঠানো হলেও ইরার হাতে আসে ২৮ তারিখে। চিঠিতে লেখা—
'ইরাবতী,
পারো যদি, একবার বাড়িতে এসো। তোমার ছেলে-মেয়ে তোমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে আছে। আমারও মন চাচ্ছে দেখতে; কতদিন দেখি না তোমায়।'

   চিঠি পেয়ে ইরা শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চেপে দিনাজপুর চলে আসে। সন্ধ্যার সময় কেউ কোথাও নেই, প্রায় জনশূন্য গ্রাম! হাঁটতে হাঁটতে বড়বাবুদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছায়! খোঁজ করে জামাই আর ছেলে-মেয়ের।
   ওরা কেউ আর ইহজগতে নেই! দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে চির বিদায় নিয়েছে ইরার কাছ থেকে! পাগলের মত এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে ইরা। এটা হতে পারে না, কী করে সম্ভব! কোথাও লাশও পাওয়া যাচ্ছে না।
   সেবার দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে। জীবিতরা না খেতে পেয়ে মৃত মানুষের মাংস ছিঁড়ে খেয়েছে। তাই গ্রামের একটা মানুষের লাশও আস্ত নেই! কলকাতা ফিরে গেলে স্টেশন মাস্টার জানায়— ইরাবতী, তোর চাকরিটা আর নেই রে!
—কাকু, আমি চাকরি করতে আসিনি, কার জন্য চাকরি করবো? ফিরে এসেছি জামাইর দেয়া ৯ টাকা দামের একটি সাদা শাড়ির জন্য। যেটা কৃষক আমাকে নামাজ পড়ার জন্য কিনে দিয়েছিল!
   সাদাশাড়িটা পরে হাঁটা দিলো সে— এক অজানা গন্তব্যে। ইরার পদযাত্রা এসে থামলো বার্মার কাছাকাছি এক মরুপ্রান্তরে। থেমে যায় সে একেবারেই, আর যেন এক পা সামনে বাড়ানোর শক্তি নেই তার। মৃত্যু অবধি চোখ থেকে অশ্রুস্রোত বয়ে চলেছে ইরাবতীর। তার চোখের জল পতিত হয়ে ক্রমশ... একটা নদী সৃষ্টি হল। বার্মার লোকজন পরবর্তীকালে এই ইরাবতীকে অমর করে রাখতে নদীটার নাম দিলো— ইরাবতী নদী।

ইরাবতী তটিনী
চট্টগ্রাম। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন