মেনু

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য'র মুক্তগদ্য...


অনিরাময়



কোনোদিন একটি হাওয়া আসে, ঘরটাকে অবিন্যস্ত করে দেয়। বালিশের পাড়ে এঁকে দেয় কেউ তৃষ্ণার নদী। কেউ এখনো আমাকে বালিশের নিচে খুঁজে বেড়ায়! আমি হারিয়ে যাওয়ার আগে মনে আছে—বালিশের তলায় রুমাল হয়ে ছিলাম। কেউ চিরদিন আকাশের পাশে কুমিরের ত্বকের রূপ নিয়ে বসে থাকে। বসে বসে ক্ষয় করে চোখের শীত ও পাথর। দুইটা ঘুঘুপাখি মুখোমুখি উড়ে উড়ে পরস্পরকে আঁকে।

প্রেতিনীরা ডেকে ডেকে ঘুরে আরো অন্ধদিনের প্রান্তে উড্ডীন। রাস্তায় আরো আরো মানুষ, মানুষের রূপ, রাস্তায় আরো রাস্তা, কবন্ধ-সবজির ভাঁজ, সবজির গন্ধ তাকিয়ে আছে মাছের দিকে। মাছ থেকে দৃষ্টি ওঠে যায় মাছির পেখমে। আহা, মাছির পেখমে জরির কাজ ম্লান করে দেয় মসলিন পাড়ের নকশা। ভাতের পাশে কেউ হয়ে থাকে রাতভর ছিন্নতারের সারেঙ্গী। কেউ এইরূপ রূপকথা বুকে ধরে পার হয় পাতাবাহারের ফুল। সেইসব পাতা হরিণের পায়ের ছাপে, জিরাফের পায়ের ছাপে, অজানিত কোনো দীঘল বৃক্ষের পায়ের ছাপে ভোর হয়ে যায় আরো কোনো ম্রিয়মাণ দিনের খুট ধরে, একা একা, একা একা। 

আমার চিৎকারে ভেঙে পড়ে যে আকাশ, কিংবা তার শীৎকারে উত্থিত হয় তেপান্তর, তার কাছে শুনেছি একা মেঘের গুঞ্জন। মৃত্যু, খানিকটা কারো নামে ঢেউ ভাঙে, ভাঙনরূপ চুলের রং রাত্রি হয় হয়তো, আমি জানি না। আমিও হারিয়ে যাই। জলের গভীরে ডুব দিয়ে চিৎকার করে কাঁদলে শান্তি পাবো জানি, শান্তি পাবো উপত্যকায় মুখ ডুবিয়ে কাদাগন্ধে ছাই হয়ে গেলে। 

একা যেতে হবে। স্মৃতি আর স্বপ্নের মাঝখানে পথ। সকল প্রত্যাখ্যান, সমস্ত গ্রহণ, সমস্ত জায়গা সমাধি। একা যেতে হবে। একটি নদী আছে চিরদিন অভিমানের পাশে, তীর্থের ছায়ায় সাতটি নিষ্কণ্টক পাখি খুঁটে খায় পৃথিবীর নিরাময়। 

আমরা কখনো সারি সারি কাচের বাকশের গায় হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে চাই ওপাশের মাছ, মাছের নিবাস। মাছেরা রঙিন। আমরাও তখন রামধনু হয়ে থাকি। আর মাছের ডানা দেখে ভাবি উড়ুক্কু মাছেরা জানে আকাশের গন্ধ ও আকার।

কেউ এমন আছে—যাকে দেখলেই এখনো বুকের ভিতর ধক করে জ্বলে ওঠে রক্ত, বেজে ওঠে রক্তের সারেঙ্গীতে হংসধ্বনি, বহুদূর বহুদূর দীপক; আর শূন্যতা ঘন হয়ে জুড়ে বসে মাইল মাইল চোখের বিবরে। তার মানে, আমি এখনো তেমনই আছি। এখনো বনের ধারের নির্জন কূয়ার জলে তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব খুঁজি, আর কূয়ার জল আমাকে পাঠায় ছায়া ছায়া অন্ধকারের সুতোয় বোনা একটি বিমূর্ত মুখ।

একটি গান শুনে শুনে ক্ষয় হয় প্রতারিত কান। গানের রেখায় কাঁপে হালকা নিমফুল সুর। এই রং কখনো দৃষ্টির শেষে ডানা মেলেছিলো মন। মনে আছে, ঘুমগাছের গায়ে হাত রেখে ফুরিয়ে গিয়েছে বিকেল। চোখবন্ধ রোদে ধুয়ে গেলে দৃষ্টির আতশ—বয়সের চিবুক ছুঁয়ে থাকে বাতাবিলেবুর দল। বিভোর হয়ে গড়িয়ে আসে ধান্যরাত, আঙুলের পাশে। ক্লান্ত করে সুইসুতো, মাঠের নথ ও নাকছাবি একা। শাদা হয়ে নুয়ে পড়ে বেলির আকার, জামিরের বন। পৃথিবীর যতো দীর্ঘ চুলের ঝুরি ঝুরঝুর বহুদূর ঝরে। উত্তর মিনারে ব্যস্ত প্রহর ঘড়ির নগ্নতা বয়ে বেড়ায়। আরো আরো বছরের দুপুরে একই গানের বিহ্বলতা তাড়িয়ে বেড়ায়। তেতে ওঠে পুকুরের হরিৎ উদ্ভাস শ্যাওলার বিছানায়। আর একটি হাওয়া এসে ঘরটাকে অবিন্যস্ত করে দেয়। 

শাদা দুপুরের হাতে দুয়ারের চাবি। সাঁতরে তবু ভাঙি ধোঁয়ার দেয়াল, খানিকটা প্রাচীর। শাদা দুপুর চেনে কি রাত্রি। দুপুরের হাত নাঙা। দুয়ারের চাবি হয়েছে কারো নাকছাবি। তাকে চিনি না; চিনবো না কোনোদিন।

আমি তো আঙুলের ক্ষত নিয়ে আঙুল ছুঁয়েছি। আঙুলের ছায়াতে ক্ষত নেই। ছায়া শুদ্ধ অচেতন দীপাবলি ছল। অনেক অসাড় জলের আধার। এই দিকে ঘনবন ক্রমশ অন্ধকার। কেউ এসেছে, কেউ আসেনি। এখনো শুকনোফুলে গন্ধ খুঁজি। সুরপোড়া ছাই হবে না গীত। গতকালই আঙুল ছুঁয়েছি। আঙুল, নাকি আঙুলের ছায়া অস্ফুট শব? এইদিকে ঘনবন আছে ক্রমশ নীরব।

কোথাও মন্ত্রধ্বনি শুনে শুনে প্রতারিত কান। কোনো পদচিহ্নের প্রত্যুষে যেই শব্দ পূর্বগামী—নিশ্চিত ক্ষুধা ও গানের আঁচলে মৌমাছি উৎসব। উৎসব শেষ হয় না একদিনও। পরস্পর বিরোধ সহজ সত্য এসে দাঁড়িয়েই থাকে। দুবেলা রোদের পাপ ত্বকে ধরে গ›ধ বিলানো যায়। জরজর দেহের উত্তাপ স্যাঁতাপড়া মায়া আনে। আমাদের যৌবনে গানের সরলতা শেষ নয়। আমাদের যৌবন কটিবন্ধে ঝুলে থাকে। ঝুলে থাকে পূর্বাপর সুরের মৌতাতে একা। একদিন গাছ পাতা ছায়ার পাপে উজাড় হবে সকল বন।


©লেখক : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন