মেনু

জাকির আহমদ -এর গল্প

আকাশের কল্পনা
জাকির আহমদ


   সম্ভবত রাত ২টা কি ৩টা বাজে। আকাশে বিশাল আকৃতির চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার চাদঁ হবে হয়তো। সারা শহরটা চাঁদের আলোয় আলোকিত, সোডিয়াম লাইটের প্রয়োজন নেই চাঁদের এই আলোর কাছে। আকাশদের বাড়িটাও চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। শহরের পশ্চিম পার্শ্বে তিনতলা ছিমছাম বাড়িটাই ওদের। আর দশটা বাড়ির চেয়ে তাদের বাড়িটা একটু ভিন্ন মডেলের, একেবারেই সিনেমা কোয়ালিটির। ছাদের উপরে, সিঁড়ির রুমের পাশে একটা সুন্দর রুম; আকাশ সে রুমে থাকে । আকাশ খুব ভাল ছাত্র সে অনেক রাত পর্যন্ত পড়ে। আজ আকাশের রুমের দিকে তাকিয়ে অবাক না হয়ে পারলাম না। সে কি! টেবিলের উপরে একটা বিদেশী মদের বোতল, একটা গ্লাস, এলোমেলো আবস্থায় পড়ে আছে ২/৩ প্যাকেট সিগারেট। পাশেই একটা ইজি চেয়ারে বসে আছে আকাশ। জানালা দিয়ে স্বচ্ছ এক ফাঁলি চাঁদের আলো পড়েছে আকাশের উজ্জল ফর্সা মুখে । চাঁদের আলোয় স্পস্ট বোঝা যাচ্ছে আকাশ এখন নেশায় কাতর। তার এই নেশাভরা মুখে বেদনার রেখা সু-স্পষ্ট। আচ্ছা, আকাশের আবার বেদনা কীসের ? কীসের জন্য সে আজ এমন নেশাসক্ত ? এই রাত দুপুরে আগে সে যেখানে পড়ার টেবিলে থাকতো, অথচ আজ একই সময়ে সে মদের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছে, এর কারন কী? জানার জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে উঠি। হাজার হলেও সে আমার খুব কাছের একজন বন্ধু। কিন্তু জানবো কীভাবে? সে তো এখন আমাদের সাথে মেশে না। বেশ কিছু দিন থেকে কেন জানি ও সব বন্ধুদেও এড়িয়ে চলে। একজন আছে, যার কাছে গেলে এ রহস্যের উদঘাটন করা যাবে। জানা যাবে আকাশের সব ধরনের তথ্য। সেই একজন হচ্ছে কল্পনা। আকাশদের পূর্ব পাশের দোতলা ফ্লাটটাই ওদের। আকাশের চেয়ে দুই এক বছরের জুনিয়ার হবে কল্পনা, তবে সে নাকি আকাশের খুব ভাল বন্ধু। আকাশতো প্রায়ই বলতো— 'তোরা আমার বন্ধু ঠিকই কিন্তু কল্পনার মত বন্ধু হতে পারবিনা। সে যে আমার কেমন বন্ধু তা তোদের কে বোঝাতে পারবোনা।' আসলেই কল্পনা আকাশের খুব ভাল বন্ধু, তা না হলে কল্পনার কথা সে সব সময় আমাদের সামনে অমন করে বলতো না। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝেও যে বন্ধুত্ব সম্ভব, তা আকাশ আর কল্পনার বন্ধুত্ব না দেখলে বোঝা যেত না। সকাল হতে না হতেই এনাম আর রুমনকে নিয়ে কল্পনাদের বাসায় গেলাম। কল্পনা আমাদের প্রত্যেককে চেনে; একদিন আকাশই পরিচয় করে দিয়েছিলো।
   কল্পনার সাথে অনেক্ষণ কথা হলো— ওর  কথা শুনে আমরা আবাক না হয়ে পারলাম না। কল্পনার বিয়ে হয়েছে কয়েক মাস আগে। ছেলে সুইডেনে থাকে। কল্পনাকেও দু’এক সপ্তাহের মধ্যেই নিয়ে যাবে। কল্পনার কোন ভাই নেই, ওরা দু’বোন। মা মারা গেছে বেশ আগে। বিয়ের ব্যাপারে আকাশ সব কিছুরই আয়োজনে কল্পনার বাবাকে সহযোগিতা করেছে। কনে-বর কে সাজানো থেকে শুরু করে সব কিছুতে। বিয়ের পর দিন থেকে আকাশ আর কল্পনাদের বাসায় যায়নি। কারণ কি? কল্পনাও তা জানে না।
   দু’টি মনের বিশুদ্ধ বন্ধুত্ব যে, ভালবাসা সৃষ্টি হয় তা আকাশ আর কল্পনার কথা শুনেই মনে হয়েছিল। তারা দুজন দুজন কে গভীর ভাবে ভালবাসতো। কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারেনি তাদের বুকভরা ভালবাসার কথা। চাওয়া- পাওয়ার কথা। কল্পনা বেশ কয়েকদিন আকাশকে তার ভালবাসার কথা বলবে বলে ঠিক করে রাখে। কিন্তু আকাশ তার সামনে এলে আর বলতে পারে না। হয়তো লজ্জায় কিংবা ভয়ে, যদি এই বলাতে তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়। আকাশও চায় না তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হউক। তাই কল্পনা যখন ইনিয়ে বিনিয়ে তার ভালবাসার কথা বোঝাতে চেষ্টা করে, তখনই আকাশ প্রসঙ্গ বদলে নেয়। একদিন কি প্রসঙ্গে যেন ওদের মাঝে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ কল্পনার বিয়ের কথা উঠে। তখন আকাশ বলেছিলো— 'জানো কল্পনা, তোমার বিয়েতে না আমি সব কিছু করবো। তোমাকে আর তোমার হবু বর কে সাজানোর জন্য তোমাকে সঙ্গে নিয়ে সব কিছু কিনবো।' কল্পনা তখন মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলো— 'সব কিছুর সঙ্গে একটু বিষও কিনিও।' কল্পনার ঐ কথার অর্থ আকাশ ঠিকই বুঝেতে পেরেছিলো। কিন্তু তার করার কিছু নেই। কারণ একটা মেয়ে কে আকাশ কিছুতেই আগে ভালবাসার কথা জানাবে না। তবে হ্যাঁ, কল্পনা যদি সরাসরি আকাশকে ভালবাসার কথা বলে তবে সে তাকে ফিরিয়ে দেবে না।  আকাশ যে কল্পনা কে ভালবাসেনা তা নয়। সেও কল্পনাকে ভালবাসে মন-প্রাণ দিয়ে গভীর ভাবে। তা না হলে কল্পনার সঙ্গ ছাড়া থাকতে পারে না কেন? কেন একা একা তার কল্পনার কথা মনে পড়বে? গভীর রাতে কল্পনার কথা মনে তুললে সে রাতে আর ঘুমাতে পারে না কেন? কিন্তু কল্পনাকে তার ভালবাসার কথা বলা মোটেই সম্ভব নয়। কেননা আকাশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ; তাছাড়া কাউকে বন্ধু বানিয়ে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেবে এমন ছেলে নয় আকাশ।
   কল্পনার বিয়ের জন্য ওর বাবার কথা মতো এবং আকাশের সকল প্রচেষ্টা আর সহযোগিতায় সমস্ত কিছুর আয়োজন করা হলো। কল্পনা তাতে খুশি কি অখুশি বোঝা যাচ্ছিল না। তবে সে যেন আমাকে কি বলতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। আকাশের ঝুঝতে বাকি রইল না কল্পনা তাকে কি বলতে চায়। সে জন্যই আকাশ বিয়ের কয়েক দিন কল্পানাকে এড়িয়ে চলে। এই মুহূর্তেই কল্পানার সে কথাগুলো শোনা যাবে আকাশের। তাহলে বিয়ের সমস্ত কিছু ভেস্তে যাবে। তাছাড়া কল্পনার বাবার একটা মান-সম্মানেরও ব্যাপার আছে। তাই কষ্ট হলেও বিয়ের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে আকাশ এবং সে দিন থেকে কল্পনাদের বাসায় যায়নি সে।
   বিয়ে হওয়ার এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল অথচ আকাশ আসছে না দেখে কল্পনার বাবা কল্পনাকে বলে— 'কিরে মা, তোদের মাঝে কোন ঝগড়া হয়েছে নাকি? আকাশ যে আসছে না।' কল্পনা বাবার কথার কোন জবাব দেয় না, নীরবে শুধু শোনে।
   আকাশ আর কল্পনার বন্ধুত্বের কথা জানেতো। মা মরা মেয়ে বলে কখনই কোন কষ্ট দেননি তিনি। কল্পনার ইচ্ছেই অপূর্ণ রাখেননি তিনি। তাইতো আকাশের সাথে বাইরে যেতে, মেলামেশা করতে কখনই বাধা দেননি কল্পনাকে। আর তাইতো ছুটির দিনে তারা দুজনে মিলে এখানে সেখানে ঘুরত। আজ কল্পনাদের টয়োটা; কাল আকাশদের পাজেরোতে। আজ চিড়িয়াখানাতো কাল বোটানিকেল গার্ডেনে, আজ সোনারগাঁও এ লান্সতো কাল ম্যাকডোনালন্সে ডিনার। এমনি ভাবে সারাক্ষণ দু’জনই মাতিয়ে থাকতো। একদিন যদি কেউ কাউকে না দেখে পর দিন জবাবদিহীতা করতে হয়। অথচ আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল আকাশের কোন খবর নেই, ভাবতেই কল্পনার ভিতরটা শূন্যতা অনুভব করলো। অস্থির হয়ে পড়লো আকাশকে এক নজর দেখার জন্য। কল্পনা যখন আকাশের রুমে যায়। তখন বিকেল হয়েছে। আকাশ তখনও শুয়ে আছে; ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে নাকি জেগে আছে কল্পনা তা বুঝতে পারছে না। হঠাৎ কল্পনার দৃষ্টি যায় মেঝেতে। সে অবাক হয়। মেঝেতে অসংখ্য সিগেরেটের শেষাংশ পড়ে আছে একটা সমাপ্ত ধোয়া দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে। কল্পনা বুঝতে পারে এ সিগারেট অন্য কেউ নয় আকাশই খেয়েছে। আকাশ সিগারেট খায়। এ কথা কল্পনা ভাবতেই পারে না। সে ডুকরে কেঁঁদে উঠে। আকাশ তবুও কথা বলে না, মনে হয় যেন গভীর ঘুমে অচেতন। কল্পনা তাকে জাগাবার জন্য অনেক চেষ্টা করে কিন্তু তার কোন চেষ্টাই সফল হয় না। অবশেষে সে ব্যর্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসে। এমনি ভাবে সে আরও বেশ কয়েক দিন আকাশের ওখানে যায়, কিন্তু প্রতিদিনই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
   কিন্তু আজ যে করেই হোক আকাশের সাথে কল্পনাকে কথা বলতেই হবে, কারণ আগামী কাল তার ফ্লাইট। এই ভেবে আকাশ কল্পনার কাছে যায়। প্রতিদিনের ন্যায় কল্পনা সে দিনও আকাশকে ঘুমের মাঝে পায়। কল্পনা বুঝতে পারে  আকাশের এই ঘুম কোন মানবের পক্ষে ভাঙানো সম্ভব নয়। তাই সে আকাশের টেবিলে একটা চিরকুট লিখে রেখে যায়।
   কল্পনা চলে যাবার পর আকাশ বিছানা থেকে উঠে। আসলেই সে কল্পনার যাওয়া-আসা সবই টের পেয়েছে। তবুও ঘুমের ভান করে ছিলো, কল্পনার সঙ্গে দেখা করবে না বলে। কি ভাবে দেখা করবে? একটা মেয়ে তাকে এতো ভালোবেসে ছিলো অথচ সে নিজে হাতে তাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে ভালোবাসাকে কবর দিয়েছে। সাথে সাথে নিজের জীবনটাকেও ঠেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তার দিকে। আকাশ তবুও পরাজয় বরণ করেনি। সে জয়ী, সে নীরবে তার প্রেম-ভালবাসাকে বিসর্জন দিয়েছে ঠিকই তবুও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেনি। এ সব ভাবতে ভাবতে আকাশ একটা সিগারেট ধরায়। তারপর টেবিলের উপর রেখে যাওয়া কল্পনার লেখা চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়তে আরম্ভ করে।

আকাশ,
আজ আমার জীবনের সমস্ত আনন্দ ধুলোয় মিশে গেছে। তবুও আমি বেঁচে আছি, বেঁচে থাকতে হয় বলে। কেন তুমি নিজের জীবনটা শেষ করে দিচ্ছ? তুমি সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকো। তোমাকে এক নজর দেখার ইচ্ছে হচ্ছে । আগামীকাল বিকেলে আমার ফ্লাইট, তুমি এসো— শেষ বারের মত অন্তত: একবার এসো।
কল্পনা।

   চিরকুটটা পড়া শেষ করে আকাশ আর একটা সিগারেট ধরায়। সিগারেটে সুখটান দেয় আর ভাবতে থাকে কল্পনার সাথে সে দেখা করবে কি করবে না।
   পরদিন বিকালে বেলা আকাশ ছাঁদে দাড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলো। হঠাৎ তার মনে পড়ে কল্পনা আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই এ শহর নয় দেশটাই ছেড়ে চলে যাবে। তাকে দেখতে চেয়েছে কল্পনা। সে কি যাবে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে আকাশ। পরক্ষণই আবার বিবেকের কাছ থেকে জবাব আসে, সে যাবে না। কারণ সেখানে তার সদ্য বিবাহ স্বামীসহ আরও আত্মীয়-স্বজন থাকবে। অনেক দিন পর তাকে দেখে যদি সে আপত্তিকর কিছু ঘটিয়ে বসে তখন? আকাশ তখন তার বিবেকে জবাব দেয়— সে যাবেনা।
   সূর্য তখন পশ্চিম আকাশের কোলে মুখ লুকাচ্ছে, পাখি দল বেঁধে ফিরে চলেছে নীড়ের খোঁজে আর আকাশ দাড়িয়ে আছে ছাদে। হঠাৎ শহরের উত্তর সাইট থেকে বিকট একটা শব্দ শুনে আকাশ তাকায় সে দিকে। দেখে এয়ার পোর্ট থেকে বিমান উঠে ছুটতে লাগলো দূর গগনে। আকাশ ভাবে কল্পনা এ বিমানেই হয়তো তার স্বামীসহ চলে যাচ্ছে এ দেশ তথা এদেশের মানুষ জনদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে দূর দেশে হয়তো বা আর ফিরবে না, ফিরলেই দেখা হবে না হয়তো। কারণ মরণ সুধার নেশায় আকাশের মৃত্যু খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। আকাশ মাথা উঁচু করে তাকিয়ে থাকতে দূর গগণে উড়ে চলা বিমানটি অদৃশ্য হয়ে যায়। আকাশ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

জাকির আহমদ
রংপুর। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন