মেনু

নাদিয়া জান্নাত-এর গল্প


ইতি তোমার লাবণ্য



আমি এসব কী ভাবছি। এমনটা হতে যাবে কেন? হঠাৎ করেই ফোন বেজে উঠলো...
"সন্ধ্যা প্রদীপ হাতে..."
অমিতের ফোন।

—কেমন আছো লাবণ্য?

আমি চুপ করে থাকি।

—দেখো লাবণ্য, তোমার শিউলি গাছের ফাঁকে ফুটফুটে দেব শিশুর মতো চাঁদ জেগেছে। চাঁদটাকে তোয়ালেতে করে কোলে নেবে? একটা কবিতা শোনাবে? রবি ঠাকুরের "সাধারণ মেয়ে" কবিতাটা? না থাক, শোনাতে হবে না। রবি ঠাকুরের কবিতা ভুল-ভাল আবৃতি করাও পাপ। এখন কি তোমাকে সাধারণ মেয়ের মতো লাগছে?
চুপ করে আছো কেন? অবশ্য এ সময় এই তোমাকেই আমার বেশি ভালো লাগছে। দেখেছো চাঁদটার রঙটা বদলে গেল। তোমার জানালার সামনে শিউলি গাছ না থেকে মেহগনি গাছ হলে ভালো হতো।
—অমিত, তুমি কি আমাকে দেখছো? কীভাবে এতসব বলছো তুমি? মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই তোমাকে ছুঁয়ে দিতে পারবো। 
—দেখছি তো। এই তো তোমার এলো চুল। দেখো অবাধ্য হয়ে কেমন করে কাঁধে এসে পড়েছে।

অমিত। সায়েন্সে পড়ে। গলার রগ ফুলিয়ে রাজনীতি করে। মিছিলের ঠিক সামনের সারির ছেলে। হালকা ছিপছিপে গড়ন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। লম্বা পাঞ্জাবি আর খাকি প্যান্টে ভীষণ মানায়। হাতের হাত ঘড়িটার বয়স এখনো জানা হয় নাই। কিছু বিশ্রী বদ অভ্যাস আছে। সেগুলো বাদ দিলেই রবি ঠাকুরের অমিত রয় হতে বাধ্য সে।
—এই যে মানবী। চাঁদ ঘোরে ফেলেছে বুঝি? আচ্ছা ঘোরেই থাকো। ঘুম আর ঘোর এই দুটি শব্দ হলো পৃথিবীর স্বর্গ।

ছেলেটা কেমন যেন দার্শনিকের মতো কথা বলে। মাঝে মাঝে ওকে বুঝতে পারি না। বুঝতেও চাই না। সম্পর্ক গুলোর মাঝে ধোঁয়াশা ছড়াতে হয়।
আমি অন্য কিছু ভাবছি। আজ সারাদিন অমিতের পাশে ছিলাম। আমি ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে কতবার ঘোরে পড়েছিলাম ও সেটা বোঝেনি। আমি আজ বুঝেছি মানুষের নিশ্বাসের শব্দগুলো বড় বেশি ভয়ংকর হয়।
কয়েকদিন আগেই অমিতকে প্রথম দেখেছি আমি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসছিল ছেলেটা। অথচ কপালের ভাঁজে কষ্টের কোন চিহ্ন ছিল না। তবে মনে আছে সে বলেছিল,'এমন অবস্থার পর মানুষ যেন না বাঁচে।'
আমি বুঝতে পারছিলাম তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তাকে বোঝানোর মতো শব্দ ভাণ্ডার আমার অভিধানে তখনো ছিল না। ফিরে আসার পর অমিতের ম্যাসেজ..."৫ তারিখ আমার একটা প্রোগ্রাম আছে। আমাকে নিয়ে যাবে লাবণ্য?" অমিতকে না বলার মতো দুঃসাহস আমার ছিল না।

বেশ ছিলাম সারাটা দিন। ঘরে ফেরার পর অমিতকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। যখন অমিতকে পেলাম, এ অমিত অন্য কোন অমিত। অমিত, অমিতের পাঠানো তিনটি বার্তা সব কিছু কেমন যেন অন্য রকম।
"লাবণ্য, আমি জানি আজ তোমাকে অনেক বিরক্ত করেছি, আর তুমি মুখ বুজে আমার সব অত্যাচার সহ্য করেছো, আমি দুঃখিত।
আজকের পর থেকে আর কখনো বলবো না,'আজ ক্লাস ফাঁকি দাও।'
আমার স্বৈরাচারী আচরণগুলোকে আজ ছুটি দিয়ে দিব। আরেকটি কথা, রোদেলা দুপুরের ভ্যাপসা গরমেও তোমার মুখটি আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মুখ ছিল ।
লাবণ্য, আমার কন্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে। অদৃশ্য কোন দৈব শক্তি আমার গলা চেপে ধরেছে। তোমার সাথে কথা বলার শক্তি ও সাহস দুটোই আমি হারিয়ে ফেলেছি।
শুধু এতটুকুই জেনো, খুব কম সময়ে অনেক ভালোবেসেছি তোমায়।
—অমিত।"

প্রতিটা লাইন অনেক বেশি সাধারণ। তবে মানতে পারছি না। কথা গুলো খুব বেশি পোড়াচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে? কেন ওকে হ্যাঁ বলতে পারছি না। ও যদি আমাকে এতোই ভালোবাসে, তবে আমি কেন গ্রহণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি? এসব আমার জানা নেই। শুধু জানি, আমার অতীত জীবনটা খুব বেশি ভয়ংকর। আমি অভিশপ্ত। অমিতের মতো একটা শুভ্র জীবনকে নষ্ট করা আমার সাজে না। আমি জানি না দশ বছর পর আমার আর অমিতের কী হবে। হয়তোবা দশ বছর পর আমার লেখা উপন্যাসগুলো অমিত প্রথমে পড়বে, তারপর যত্ন করে সাজিয়ে সাজিয়ে রাখবে তার বিছানার পাশের বইয়ের তাকে।
কিংবা এমনও হতে পারে। দশ বছর পর ঘুম ভেঙে অমিতকে দেখবো। হয়তো রাত জেগে আমি কোন গল্প লিখবো, আর অমিত কাঁধে হাত রেখে বলবে,'অনেক রাত হলো ঘুমোবে না?'
হয়তো এসবের কিছুই হবে না। আমি সে সব ভাবছি না। আমি ভাবছি আজ অমিত ভালো নেই। সিগারেটের ঠোঙায় অমিতের ঘর ভেসে যাবে আজ।

এরপর অনেক গুলো বছর কেটেছে। আমি দেশ ছেড়েছি। প্রিয় দেশে আমার থাকা হয়ে ওঠে নাই।
অনেকদিন জেল খেটে অমিত আজ অসুস্থ। একা বড় নিঃসঙ্গ। রাজনীতির ছোবল তার জীবনের পনেরোটা বছর কেড়ে নিয়েছে।
তার সাথে যোগাযোগের সাহসটা আজ আমার নেই। পাগলামী করার বয়সটাও চলে গেছে অনেক আগে। চুলের গোছায় পাক ধরেছে। পত্রিকার খবর আর ছবি দেখে মেলাতে পারছিনা এই কি অমিত? এই ভয়ংকর পরিণতির জন্য...না না আমি কেন?
এতটা দিন পর মনে হচ্ছে, অমিতের সাথে আমার জীবনটা জড়িয়ে গেলে হয়তো অমিতকে এভাবে নষ্ট হতে হতো না। হয়তো আমাকেও আমার দেশ ছাড়তে হতো না।
অমিতের পাশে দাড়ানো দরকার। কিন্তু কী করে সম্ভব? দেশ-জাতি অসহায় মানুষের পাশে যে দাঁড়ায়, তার পাশে আমার কিংবা আমাদের দাঁড়াতে এতো ভয়, সংকোচ আর দ্বিধা কেন? এগুলো এখন কেন ভাবছি? এখন কী করার আছে আছে আমার? এতদিন বাদে আসলেই কি কিছু করার থাকে?
আজ বুঝলাম, অমিত আমার অগোচরে আমার ভেতরে অনেক বড় একটা জায়গা করেছিল।
আমি জানি না আমার লেখা চিঠি অমিতের হাতে শেষ অবধি যাবে কি না। তবে আমাকে লিখতেই হবে। অামার অমিতের জন্য।

অমিত,
ভালোবাসা আর ভালো না বাসা এ দুটোর মানে বুঝতে গিয়ে আমার জীবনের সব ক'টা বছর শেষের পথে। আমি জানি এতটা বছর তোমাকেও ভালো থাকতে দেয়া হয় নি।
তুমি হয়তো জানো, চাইলেও আমি আর দেশে ফিরতে পারবো না। তোমাকে না দেখে যদি মরে যাই, তবে শেষ শান্তিটুকুও থাকবে না আর। একটি বারের জন্য কাছে এসে আমাকে কি দেখে যাবে অমিত?
ইতি
তোমার লাবণ্য


●লেখক : নাদিয়া জান্নাত, রংপুর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন