মেনু

আল কাফি নয়ন'র গল্প...


নুরানের দীর্ঘশ্বাস



এক.
আলিফ কান ধরে নিল ডাউন হয়ে আছে। সে তার বন্ধু তারেক কে কলম দিয়ে মারতে চেয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি আলিফের এই চেষ্টা ইকবাল স্যার ধরে ফেলেছেন। এই কারনে ক্লাসরুমে তার জায়গা হয় নি।সে ক্লাসের বাইরে নিল-ডাউন হয়ে আছে।

এতে অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। ক্লাসের অন্যকেউ তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকাতে পারছে না। ক্লাসে কাউকে শাস্তি দেয়া দেখলে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে, যেন এমন ঘটনা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে প্রথম ঘটছে। সবার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে , এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সবাইকে যাইতে হয়। তবে মেয়েদের কে শাস্তি কম দেয়া হয়, কারন তাদের শাস্তি দিলে নাকের জল, চোখের জল এক করে ভাউ ভাউ করে কান্না জুড়ে দেয়। তার উপর গার্ডিয়ান কল হাবিজাবি তো আছেই। শেষমেষ দেখা  যাবে শিক্ষকের বিরুদ্ধে শালীনতাহানির অভিযোগ উঠেছে। নিজের খেয়ে কেউ কি এত ঝামেলা নিতে চায় ?

তবে ইকবাল স্যার এসবের তোয়াক্কা করেন না। তিনি ছেলে–মেয়ে নির্বিশেষে একই শ্লোগান সামনে রেখে শাস্তি দিয়ে চলেছেন। তার শ্লোগান হল-“এমন জায়গায় মারবো নিজেও দেখতে পারবি না অন্যরেও দেখাইতে পারবি না”। কিন্তু শ্লোগান তিনি মুখেই ব্যবহার করেন।বাস্তবায়ন খুব একটা দেখা যায় না। নিল-ডাউন, বেঞ্চের নিচে মাথা ঢুকানো, পেন্সিল দিয়ে আঙুল চিপা দিলেই স্টুডেটের হালুয়া টাইট হয়ে যাচ্ছে, বিশেষ জায়াগায় মারার দরকার পড়ছে না। শুধু চোখ দিয়ে তাকিয়ে স্টুডেট কাঁদানোর রেকড আছে ইকবাল স্যারের।

তাই আলিফ এই মূহুর্তে ইকবাল স্যারের দৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। সে দরজার পাশে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু হাটু গেড়ে সরতে সমস্যা হচ্ছে। এই সরতে গিয়ে আবার স্যার দেখলে মাথা বাঁচাতে গিয়ে মাথা কাঁটা যাওয়ার মত ব্যাপার দাঁড়াবে।

অনেক কষ্টে আলিফ একটু সরতে সমর্থ  হয়েছে। এখানে থেকে  স্যারের মুখ দেখা যায় না। তিনি এই মূহুর্তে  ক্লাসের মাঝে দাঁড়িয়ে  লেকচার দিচ্ছেন। তার লেকচার পড়ালেখা সমন্ধীয় নয়, বরং উচ্চ-মার্গীয় জীবন গঠনমূলক লেকচার। ক্লাস টিচার হবার সুবাদে তাকে অধিকাংশ সময় বিচারাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। গত দিন কে স্কুল পালিয়েছে, কে ক্লাস ফাকি দিয়ে টয়লেট গিয়েছিল, কে কার টিফিন চুরি করেছে এইসব বিষয়ে চলে বিচারকার্য। বিচারের পর অনেকেরই অবস্থা হয় আলিফের মত। এরপর সময় সুযোগ থাকলেই ইকবাল স্যারের জীবন দর্শনমূলক লেকচার শোনার সু্যোগ হয় শিক্ষার্থীদের।

আলিফের সরে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। সরতে সরতে এখন সে দরজার আড়ালে চলে এসেছে প্রায়। দরজার মুখে দাঁড়ালেও এখন তাকে দেখা যাবে না। সে এখন বেশ স্বস্তি বোধ করছে। কারণ এখন পা টা তুলে একটু আরাম করা যাবে। পায়ে ব্যাথ্যা ধরে গেছে। আলিফ মাথা নিচু করে আস্তে  আস্তে পা তুলে দাঁড়াতে যাবে এমন সময়  দ্যাখে পাশে নুরান দাড়িয়ে। নুরান আলিফের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসি দিল। আলিফ পা তুলে হাটুর ময়লা ঝেড়ে আবার  নিল-ডাউন হয়ে গেল যেন কিছুই হয় নি, হাটুর ময়লা ঝাড়ার জন্যই সে উঠে দাঁড়াতে চেয়েছিল।
নুরান বললো, “ক্লাস থাইকা বাইর কইরা দিছে?”
আলিফ বললো, “হুম,তুই বাইরে কেন?”
–আমারেও বাইর কইরা দিছে।
আলিফ উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কেন, কী করেছিস?”
–কিছু করি নাই, আব্বায় তিন মাসের বেতন দেয় নাই। দিছে বাইর কইরা। হা হা হা...
নুরান কে দ্বিগুন উৎফুল্ল বলে মনে হচ্ছে। সে সব ক'টা দাঁত বের করে হাসি দিয়ে  এই বিষয়টা নিশ্চিত করলো।

আলিফ পঞ্চম শ্রেণির গেটে নিল-ডাউন হয়ে থাকলো। নুরান এগিয়ে গেল। সামনেই দুইজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। জাতীয় পতাকার দিকে তাকিয়ে। এরা বয়সে নুরানের থেকে বেশ বড়। নুরান পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ছেলে গুলো নুরানের দিকে দেখে আবার অবাক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো। নুরান তাদের মত আকাশের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু সূর্যের জন্য তাকানো গেল না। নুরান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ভাইয়া, এখানে কী করেন?”
একজন উত্তর দিল, “জাতীয় পতাকা কে শ্রদ্ধা জানাই!”
এই কথা শুনে অন্যজন হেসে উঠল। নুরান কিছুই বুঝতে পারলো না। এই দুজনকে যে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার শাস্তি দেয়া হয়েছে সেটা বোঝার মত বয়স নুরানের হয় নি।
নুরান আবার জিজ্ঞেস করলো, “ভাইয়া, আপনারা কোন ক্লাস?”
–ক্লাস সেভেন, তুই কোন ক্লাস?
–আমি ফোর ক্লাসে উঠছি।
–বাইরে কী করিস? ক্লাসে যা।
–ক্লাস থাইকা খেদায় দিছে।

কিছুক্ষণ পর টিফিনের বেল পড়ল। সব ছাত্র-ছাত্রী  হৈ হৈ করে মাঠে চলে আসলো। নুরান তার বাবার দোকানে চলে আসলো। স্কুলের পশ্চিম পাশে ছোট চা-বিস্কুটের দোকান নুরু মিয়ার। নুরান নুরু মিয়ার সন্তান। নুরান তার বাবার জন্য খাবার নিয়ে আসে। সে স্কুলে আসলেই তার স্কুল ড্রেস পরে আসে। গত এক মাস আগেও সে এই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির একজন ছাত্র ছিল। নুরান এখন ক্লাস করতে পারছে না। কারণ তার বেতন বাকি পড়েছে তিন চার-মাসের। এই নিয়ে নুরানের কিছুটা অভিমান হয় বাবার উপর। সেই অভিমান থেকেই সে একদিন মা কে জিজ্ঞেস করলো, “মা, আব্বা আমার স্কুলের বেতন দেয় না কেন ?”
মা উত্তর দেয়, “দিবে বাবা, টাকা-পয়সার সমস্যা হয়ত।”
–কবে দিবে? কয়দিন পর পরীক্ষা। আমি কইলে খালি ধমকায়।
–পুরুষ মানুষ তো, টাকা পয়সা না থাকলে মাথা ঠিক থাকে না। আয়-রোজগার একটু বাড়ুক আমি বলে দিব এখন।
নুরান আশ্বস্ত হয়। সেই আশা নিয়েই সে বুক বেধে থাকে। ছেলের মুখ দেখে মায়ের চোখে পানি চলে আসে। ছেলের অলক্ষ্যে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা।

টিফিনের এই সময় টা নুরানের বড় প্রিয়। এই সময় সে সবার সাথে মিশে যেতে পারে। তার কিছু বন্ধুদের সাথে তার দেখা হয়। সবার গায়ে একই স্কুল ড্রেস। নুরানের গায়েও তাই। এই বিষয়টা নুরানের ছোট্ট মন টা কে কিছুক্ষণের জন্য ভুলিয়ে দেয় সে বর্তমানে সবার  সাথে থেকেও বিচ্ছিন্ন।


দুই.
কিছুদিন পরের কথা, স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। এখন আর কাউকে বাইরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না। নুরান স্কুলে এসে প্রতিদিনই অবাক হচ্ছে। এই কয়েকদিন ধরে টিফিনও দেয়া হচ্ছে না, সরাসরি ছুটি। তাই নুরান ঠিক করেছে তার কোন বন্ধু কে জিজ্ঞেস করবে। ছুটির সময় সে কয়েকজন কে খুঁজে বের করলো ।
নুরান জিজ্ঞেস করলো, “এখন টিফিন দেয় না কেন রে?”
নুরানের কথা শুনে সবাই হেসে উঠল।
–পরীক্ষার সময় আবার কিসের টিফিন রে? হি হি হি...।
–কী পরীক্ষা হইল আজকে?
–অংকন পরীক্ষা, শহীদ মিনার আসছিলো, কলা গাছের শহীদ মিনার আর্ট করছি হি হি হি...
–আর কয়টা পরীক্ষা?
–আর দুইটা হইলেই শেষ। তারপর একমাস বন্ধ। কি যে মজা !!!

একমাস বন্ধ কথাটা শুনে নুরানের মন ভালো হয়ে গেল। সে তার বাবাকে গিয়ে বললো, “আব্বা, স্কুল নাকি একমাস বন্ধ দিবে।”
কথাটা শুনে নুরু মিয়ার রেগে গেল। সে ধমকের সুরে উত্তর দিল, “বন্ধ দিবে দেখি খুশি লাগতেছে? ব্যবসা-পাতি কমি যাবে তার চিন্তা নাই। দুর হ চোখের সামনে থাইকা।”

নুরানের মন খারাপ। সে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। স্কুল বন্ধ হলে ব্যবসা-পাতি কমে যায় এই জটিল হিসাব সে বোঝে না। তার মনে শুধু অজানা আতঙ্ক। আগামী বছর ক্লাস করা হবে তো? ছোট মানুষ নুরান, হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ছোট মানুষের দীর্ঘশ্বাস বড্ড ভারি। এ সভ্যতা তার ভারবহন করতে পারে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন