মেনু

কবির কল্লোল'র গল্প...


বোধোদয়



খটাং ক'রে একটা ফড়িং এসে বসলো গোলাপের পাতার উপর। বসেই চুপ। গোল ফোয়ারা থেকে জলকণা ছিটকে এসে জমা হচ্ছে পাতায় পাতায়। এখন সাড়ে নয়টা , অথচ রোদের চিহ্নমাত্র নেই। ফুলগুলো ফুটবে ফুটবে ক'রেও মনমরা হয়ে চুপসে আছে। কিছু মৌমাছি সাঁই সাঁই ক'রে উড়ে যাচ্ছে কানের পাশ দিয়ে। আতংকে কানের লতি লাল হবার জোগাড়। একটা এসে সজোরে কানে আঘাত দিয়েই বু-উ-উ ক'রে চলে গেলো। তড়িঘড়ি কানে হাত রাখতেই আচমকা শক খাওয়ার মতো হাত সরিয়ে নেয় রেশমা। ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে আছে কান। নাকেমুখেও সচেতন ভাবে হাত বুলালো কিছুক্ষণ। খসখসে। আশেপাশে নিশ্চয় মৌচাক আছে কোথাও; ভাবতে ভাবতেই রোড ডিভাইডারে দাঁড়ানো কৃষ্ণচূড়ার একটা বাঁকা ডালের দিকে নজর পড়লো। ছোটখাটো জটলা ক'রে নতুন একটা মৌচাক গঠনের পায়তারা চলছে। কয়েকটা অটো গুনে শেষ করলো রেশমা। ওরা পাঁচ জনের একটা দল। সবাই বেশ খোশ মেজাজে আছে। জড়তা ভাঙার জন্যই একটু আগেভাগে রাস্তায় এসেছে ওরা।


এক.
সাতদিন হলো খালেক ঢাকা শহরে এসেছে। প্রথম দিনটা এলাকার এক বন্ধুর আশ্রয়ে ছিলো। তাহের আসলে আস্ত এক চাঁপাবাজ। গ্রামের সবাই জানে- শহরে বিশাল এক বাড়ির দারোয়ান তাহের। জনশ্রুতি আছে- কোনো এক উপমন্ত্রী না পতিমন্ত্রীর বাসা সেটা। নিয়ম রক্ষার্থেই বড় ক'রে মোঁচ রাখে সে। আদতে তাহেরের আসল পরিচয় খালেকই এখন জানে। কিন্তু কাউকে সে বলবে না। একটা রাত অন্তত তাহেরের কাছে আশ্রয় পেয়েছে খালেক। উপকারীর মান সে রাখতে জানে।

পরের দিনটা কাকরাইল মসজিদে অনায়াসেই কেটে যায়। শুক্রবার দিনভর ব্যাপক খানাপিনার আয়োজন। তাহেরের পরামর্শেই এখানে এসে উঠেছিলো খালেক। প্রথমদিনেই জায়গাটা দারুণ পছন্দ হয়ে যায়। তবে দিন না ঘুরতেই বাঁধে বিপত্তি। শনিবারের সকাল পেরিয়ে গেলেও তেমন কোনো ভাবনার উদয় হয় না, কিন্তু দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেলের রোদও ক্ষীণ হতে শুরু করে, খালেকের আশাও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। মাগরিবের নামাজ না প'ড়েই সে বেরিয়ে পড়ে অজানা পথে।

পকেটে তখনো শ'খানেক টাকা ছিলো। শিশুপার্কের সামনে এসে পঞ্চাশ গ্রাম বাদাম কিনে নিরুদ্দেশ হাঁটতে থাকে।

সারা রাস্তা জ্যাম। চারিদিকে আলো আর আলো। হাঁটতে খুব একটা কষ্ট হয় না। কেবল তো পয়ত্রিশ কিংবা বড়জোর চল্লিশই হবে হয়তো। যদিও ইতোমধ্যে একবার নানা হওয়ার সুসংবাদ ভাগ্যে জুটেছে, তবু বয়স চল্লিশের খুব বেশি হবে না। হাঁটতে ভালোই লাগে। মাঝে একটা বুথ থেকে তাহেরের নাম্বারে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো কয়েকবার। প্রথমে একবার ফোন ধরেই সেই যে কেটে দিলো, পরে আর পাত্তাই পাওয়া গেলো না। শেষমেষ কিভাবে জেনো বসুন্ধরা সিটির সামনে এসে পৌঁছায়। এখানেই একটা পামগাছের নিচে তৃতীয় রাতটা কাটে।


দুই.
- হা হা হা হা হা। এইডা কোনো কথা কইলেন মিয়াবাই ! আপনাগো এলাকা আপনারাই দেখবেন। আমগো কোনো পোলাপাইন ঐহানে নাক গলাইবো না।

- প্রতিবারই তো এই কথাই বলেন। মাস-দু'মাস পর যেই লাউ সেই কদু।

- আমরে অবিশ্বাস করলেন মিয়াবাই! আরে এই গফুর চাঁনের কথার লরচড় হইছে হুনছেন কখনো? জিগান, আশেপাশে জিগান।

- আসলে হয়েছে কী স্যার, বাজার খুব মন্দা। এই কমিটি সেই কমিটি এসে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। উচ্ছেদ করতে চাই।

- ছিঁড়বো। সরকার আমগো পক্ষে। এমনি এমনি ব্যবসা পাতছি? কুড়ি লাখ ট্যাকা, প্রতি মাসে কুড়ি লাখ ট্যাকা শুধু মেয়রগো পকেটেই যায়। ছিঁড়তে পারলে ছিঁড়ুকগা।

- কিছু কম করা যায় না?

- দুই লাখের একট্যাকা কমেও যদি কন, পারুম না। প্রতিটা থানায় ফিক্সড কইরা দিছি। হাত তো একটা দুইডা না। এমপি, কমিশনার; আবার ধরেন কনসটেবল গুলানরেও দু'পাঁচ ট্যাকা দেওন লাগে। আপনারে কাগজ দিমু?

- তাহলে পোলাপান আর ঝামেলা করবে না বলছেন?

- ধ্যাত্তেরি। দিমু নাকি হেইডা কন। বেবাকে চাইতাছে।

- দ্যান। ব্যবসা না থাকলে খামু ক্যামনে। দ্যান।

- হা হা হা হা হা। এইতো লাইনে আইছেন। যাগো কাম কইরবেন তাগো ভাষাডাও কিন্তু জরুলি। তাইলে লিইখ্যা রাখলাম- 'এ্যাডভোকেট আব্দুল জলিল, পরিচালক, রমনা থানা মাধুকর সোসাইটি'।

- তাইলে রাইতের মধ্যেই ট্যাকা নিয়া আসুম। কি কন? অহন উঠি।

- আইচ্ছা। স্লামালেকুম।

এ্যাডভোকেট আব্দুল জলিল বেরিয়ে যেতেই রুমের ভেতর পাঁচ ছয়জনের একটা দল এসে হাজির । গফুর চাঁনের মেজাজ এখন মিহি। শান্ত চোখে ছেলেগুলোকে এক পলক দেখে নিলেন। সবাই সোসাইটির ছেলে। অপরিচিত কেবল একজন। রোগাপটকা মধ্যবয়স্ক একটা লোককে রশি দিয়ে বেঁধে হাজির করেছে ছেলেরা। যথেষ্ট মারধর করেছে বলেই মনে হচ্ছে। গফুর চাঁন খাকারি দিয়ে ওঠেন।

- কিও? কী কইরছেন ভাইসাব? ওরে বানলি ক্যান তোরা?

দলের ভেতর সবচেয়ে লম্বা ছেলেটা বীরদর্পে উত্তর দিতে থাকে

- হালায় একটা বজ্জাত। দুপুরবেলা দেখি বসুন্ধরার সামনে ভিক্ষা শুরু করছে। প্রথমে দেইখাই সন্দ হইছিলো। কাছে গিয়ে কার্ড দেখাইতে কইলাম। কয় কী, 'কিয়ের কার্ড?'

- শহরে নতুন আইছে। মারলি ক্যান ওরে? ছাড়। রশি খুইল্যা দে।

প্রথম দেখাতেই লোকটাকে বেশ ভালো লাগে খালেকের। গফুর চাঁন। মাধুকর সোসাইটির ডিলার। শহরের সমস্ত ভিক্ষুকের নাম-ঠিকানা আছে লোকটার কাছে। গফুর চাঁনের স্বাক্ষর ছাড়া ভিক্ষা করা আইনত দণ্ডনীয়।


তিন.
দুইদিনে ভালোই প্রশিক্ষণ পেয়েছে খালেক। সোমবার আর মঙ্গলবার প্রায় সারা দিনই সে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। মাধুকর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিশজন খণ্ডকালীন প্রশিক্ষক আছেন। প্রত্যেকেই চড়া বেতন পান। একজন প্রশিক্ষককে সে টিভির নাটকেও দেখেছে ব'লে মনে হয়েছে। সুযোগ বুঝে একবার প্রশ্নও ক'রে বসেছিলো খালেক। প্রত্যুত্তরে একটা মুচকি হাসি দিয়ে সেই যে চম্পাট, এরপর আর সামনেই আসেনি।

খালেকের কাজটা বেশ কঠিন। তবু দ্রুতই শিখে ফেলেছে সে। গ্রামে একসময় যাত্রাদলে পার্ট করতো খালেক। নাতিদীর্ঘ শরীর, হ্যাংলাপাতলা গড়ন আর গায়ের রঙটা সামান্য উজ্জ্বল হওয়ায় নারী চরিত্রে দারুণ মানিয়ে যেতো। এখানেও কাজটা প্রায় কাছাকাছি। হিজড়ার চরিত্রে ঘুরতে হবে খালেককে। দলবেঁধে টাকা তুলাই তো, এমন কিছু না। একটু নির্লজ্জ হতে পারলেই অঢেল টাকা। ভিক্ষা করার চেয়ে এই পেশাটাই ভালো।

শাড়ি প'রে সাজুগুজু করলে খালেককে দেখাচ্ছেও দারুণ। শহরে হিজড়াদের নাকি ভালো কদরও আছে। দেখতে সুন্দর হলে ডাক পড়ে বড় বড় হোটেলে। কাড়ি কাড়ি টাকা আর দামি সব উপহার পাওয়া যায়। হিজড়া দলের এক পুরোনো সদস্যের কাছ থেকে খুঁটিনাটি জেনে নিয়েছে সে।

'মন্দ কী? সুযোগ পেলে মাসে একটা রাত হোটেলেই থাকবে' - মনে মনে চিন্তা করে খালেক।

একটা ঝামেলার কথা অবশ্য ইতোমধ্যে জানা গেছে। এই পেশাটা মাধুকর সোসাইটির আওতাধীন নয়। 'হিকসড' বা 'হিজড়া কমিউনিটি অব সেক্সুয়াল ডিজ-অরর্ডার' নামে একটা প্রতিষ্ঠান হিজড়াদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ক'রে থাকে। মাধুকর সোসাইটি নকল কাগজপত্র ব্যবহার ক'রে এই কাজ পরিচালনা করছে। মূলতঃ মাধুকর সোসাইটির কার্ডধারী কোনো হিজড়াই প্রকৃত হিজড়া নয়। তবে ভরসার কথা হলো- হোটেলে এখন সমান কদর।

আজকেই প্রথমবার কাজে নামবে খালেক। সাজুগুজু করতে করতে ছোট মেয়েটার মুখ তার চোখে ভেসে ওঠে। তুখোড় মেধাবী। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছে এবার। দেখতেও সাহেবদের মেয়েদের মতো। গত দু'বছরে এমন কোনো দিন নেই যেদিন অন্তত একটা বিয়ের প্রস্তাব আসেনি। প্রথম দিকে প্রায় বিয়ে দিয়েই দিতো খালেক। কিন্তু মেয়েটাও যেমন জেদী, ওর মা-ও সায় দিলো না। তাছাড়া ঘরে ছেলে সন্তানও নেই। মেয়েটার বিয়ে দিলে ঘর শূন্য হয়ে যাবে। সাতপাঁচ ভেবে খালেকও প্রশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু মেয়ে যে লেখাপড়াতে এতো ভালো করবে খালেকের কল্পনাতেও ছিলো না। সাজুগুজু করতে করতে মেয়েটার মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মেয়েকে ডাক্তার বানাতে চায় খালেক। ছেলে নেই তো কী হয়েছে, মেয়েকেই লাঠির মতো গড়ে তুলবে।


চার.
খটাং ক'রে একটা ফড়িং এসে বসলো গোলাপের পাতার উপর। বসেই চুপ। গোল ফোয়ারা থেকে জলকণা ছিটকে এসে জমা হচ্ছে পাতায় পাতায়। এখন সাড়ে নয়টা , অথচ রোদের চিহ্নমাত্র নেই। ফুলগুলো ফুটবে ফুটবে ক'রেও মনমরা হয়ে চুপসে আছে। কিছু মৌমাছি সাঁই সাঁই ক'রে উড়ে যাচ্ছে কানের পাশ দিয়ে। আতংকে কানের লতি লাল হবার জোগাড়। একটা এসে সজোরে কানে আঘাত দিয়েই বু-উ-উ ক'রে চলে গেলো। তড়িঘড়ি কানে হাত রাখতেই আচমকা শক খাওয়ার মতো হাত সরিয়ে নেয় রেশমা। ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে আছে কান। নাকেমুখেও সচেতন ভাবে হাত বুলালো কিছুক্ষণ। খসখসে। আশেপাশে নিশ্চয় মৌচাক আছে কোথাও; ভাবতে ভাবতেই রোড ডিভাইডারে দাঁড়ানো কৃষ্ণচূড়ার একটা বাঁকা ডালের দিকে নজর পড়লো। ছোটখাটো জটলা ক'রে নতুন একটা মৌচাক গঠণের পায়তারা চলছে। কয়েকটা অটো গুনে শেষ করলো রেশমা। ওরা পাঁচ জনের একটা দল। সবাই বেশ খোশ মেজাজে আছে। জড়তা ভাঙার জন্যই একটু আগেভাগে রাস্তায় এসেছে ওরা।

রোদ চড়তে শুরু করেছে। তবে তাপ তেমন নেই। তাছাড়া শীত এখনো পুরোপুরি পাততাড়ি গুটিয়ে উঠতে পারেনি। মাঘের শেষ। প্রকৃতিও খানিকটা আড়মোড়া দিয়ে দাঁড়াতে চাইছে।

দলের মধ্যে তুমুল হাসিঠাট্টা চলছে। কিন্তু রেশমা আনমনা। চুরি ক'রে কখন যে সূর্যটা মাথার উপরে চ'লে এসেছে বুঝাই যায়নি। আজ বুধবার। বসুন্ধরা সিটি বেশ জমজমাট হতে শুরু করেছে।

'আয় আয়', সমস্বরে ডেকে ওঠে দল। সম্বিত ফিরে পেয়ে রেশমাও উঠে দাঁড়ায়। ততক্ষণে একটা নাদুসনুদুস জুটিকে পাকড়াও করেছে ওরা। ছেলেটার পকেটে হাত দিচ্ছে দলের একজন। ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতি। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে ছেলেটা। বাকি তিনজন মেয়েটাকে ঘিরে ধরেছে। কেউ আলতো ক'রে মুখ টিপে দেয়, কেউ হাত ধ'রে টানে, কেউবা সরাসরি বুকে হাত রেখে ভরপুর প্রশংসা করে। মেয়েটার প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা।

'আয় আয়। কেমন মানিয়েছে দেখতো', রেশমাকে আবার ডাকে। খানিকটা এগোতেই পাথরের মতো স্থির দাঁড়িয়ে যায় সে। মেয়েটার মুখের সাথে আরো একটা মুখ খুব মিলে যাচ্ছে। রেশমার মাথা ঘুরপাক খায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। না এগোতে পারে, না পিছাতে পারো। হাউমাউ ক'রে কাঁদতে ইচ্ছা করে তার। পারে না। এই মুহূর্তে তাহেরের কথা খুব মনে পড়ছে ওর। চিন্তারা নড়েচড়ে বসে। হিজড়া নয়, ভিখিরি নয়, মৌমাছি নয়; সে একজন পরিপূর্ণ মানুষ। মধুকর কিংবা মাধুকর হয়ে সে কেনো বাঁচবে! মানুষ হয়ে মানুষকে সে কেনো ঠকাবে! কাজ করবে। রিক্সা চালাবে। হোক অল্প উপার্জন। তবু রেশমা হয়ে নয়, খালেক হয়ে বাঁচবে সে। ততক্ষণে ওরা আরও একটা জুটিকে পাকড়াও করেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন