মেনু

সোহানুর রহমান শাহীন -এর গল্প

অনিশ্চয়তার যাত্রা
সোহানুর রহমান শাহীন


   দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে বাস। পিচঢালা পথ পিছে ফেলে দরিদ্র পরিবহনের বাসটি চলছে তো চলছেই। কষা ব্রেকে কখনো বাসের সিট থেকে দেহ আলগা হয়ে সামনের দিকে হোঁচট খায় বাস ভর্তি যাত্রী। কখনো ফুলস্প্রীডের চলমান বাস ব্রীজগুলো পার হবার সময় শোঁ-শোঁ শব্দ, মনে হয় যেন, হাজার ফুট উঁচু পাহাড় থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে। আবার কখনো ওভারটেক করতে গিয়ে ডানদিকে হেলে যায় যাত্রী বোঝাই বাস। এভাবেই দুর্ঘটনার আগাম বার্তা বহন করে। প্রতিদিনে পত্রিকার পাতা জুড়ে সড়ক দুর্ঘটনার খবর শিহরণ জাগায় আমজনতার মনে। বাসের যাত্রী হয়ে বাড়ি ফেরা পরিবারের একমাত্র কর্তার অপেক্ষায় স্বজনরা, অপেক্ষার পালা শেষ হয়, ফিরে আসে কফিনবন্দী সংসার প্রধান। আবছা আলো নিভে যেতে যেতে ঝরে পরে কতোগুলো পরিবারের বেড়ে ওঠা স্বর্ণসন্তান, পালক ছিন্ন পাখির মতো দিক হারায় অবুঝ শিশু। তবুও জীবন মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন করে প্রতিদিন এভাবেই দূরের মানুষ গুলো বাসে চড়ে যাতায়াত করে। যাতায়াত করতে গার্মেন্টসে কাজ করা সালমাকে। হেলেদুলে চলা বাসের অবস্থা দেখে মাঝে মাঝে বুকটা কেমন ধক্ ধক্ করে উঠে সালমার। তার মায়ের অসুখের খবর পেয়ে তিন দিনের ছুটিতে রাজধানী ছেড়ে বাসে করে রংপুর যাচ্ছে সালমা, মাকে দেখবে বলে। হঠাৎ পাশের সিট থেকে ছোট্ট শিশুর কান্না, নিজের চার বছরের একমাত্র সন্তান শাকিবের কথা মনে করে দেয়। ছেলেকে অসুস্থ মায়ের কাছে রেখে দারিদ্রতা ঘোঁচাতে রাজধানীতে পারি জমাতে হয়েছে, সেই অসুস্থ মায়ের অসুখ নাকি আরো বেড়ে গেছে। শাকিব কে মায়ের কাছে রেখে গার্মেন্টস করলে অনেকটা চিন্তামুক্ত থাকা যায়, যদিও সন্তানের জন্য মন কেঁদে ওঠে কাজের ফাঁকে ফাঁকে, হতাশা অনুভব করে প্রতিনিয়ত- তথাপি শাকিব তার নানির কোলে বেড়ে উঠতে উঠতে নানির ভক্ত হয়ে গেছে। মাসে মাসে সামান্য বেতনের পাঠানো টাকা দিয়ে শাকিবের দেখাশুনা হয়, কিন্তু মায়ের ওষুধ কিনতে চরম  হিমশিম খায়। তার পরও পিতৃপরিত্যক্ত সন্তানকে ফেলে দিতে পারে না সালমার মা রমিচা বেগম।
   গ্রামের দিনমজুর আক্কাসের সাথে সালমার বিয়ে হয় অল্প বয়সে, বিয়ের পর থেকে যৌতুক জটিলতায় সালমার সংসারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। দারিদ্রতার বেত্রাঘাতে জর্জরিত সালমার কোল জুড়ে আসে পুত্র সন্তান। সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে প্রায়ই মারধর করতে থাকে সালমার স্বামী নামক অর্থলোভী আক্কাস আলী। সব সময় বলতো—‘হারামজাদী এতোবার তোক তোর মায়ের কাছে থাকি ট্যাকা আনবার কনু, তুই ট্যাকা তো আনবার পালু না, ফির মোকে ধ্বংস করার জন্যে ছাওয়া পয়দা করলু, এতো খাবার আইসে কোটে থাকি? হারামী শালি, যেমন করি পারিস ট্যাকা আনি দিবু, আর যদি ট্যাকা আনবার না পারিস তাহইলে ছাওয়া ধরি তোর বাপের বাড়ি চলি যাবু, এইটায় মোর শ্যাষ কতা।’
   এসবের সবই মুখবুজে সহ্য করে সালমা। এক সময় ধৈর্য্যরে বাঁধভেঙে আক্কাসের সামনে মুখ খুলে—‘মোর মাও ঝিয়ের কাম করি করি তোমাকে একুশ হাজার ট্যাকা দিছে, এলা মোর অসুস্থ মায়ের চলফিরা করার মতন ক্ষমতা নাই। মনুষ আর কামোত নিবার চায় না। তোমরা যদি ফির ট্যাকা চান দিবে কেমন করি। তোমরা পুরুষ মানুষ, গাওত বল আছে, কামাই কইরবার পারেন, তাক না করিয়া আলসিয়ার মতন ঘরোত বসি থাকমেন আর মুই মায়ের বাড়ি থাকি ট্যাকা আনি দিলে তাকে খাইমেন, তাক আর হবার নয়।’ সালমার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই কিল-ঘুষি শুরু করে আক্কাস। এমনি ভাবে চলতে চলতে এক সময় চার বছরের সন্তান কে নিয়ে সালমার ঠাঁই মেলে বিধাব মায়ের বাড়িতে।
   অভাব অনাটনের মাঝে স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ সম্বল তিন শতক জমি বিক্রি করে নিজের চিকিৎসা চালায় সালমার মা রমিচা বেগম। শেষ ভিটামাটি চলে যাবার পর অন্যের ভিটায় ছনের একটা ঘর তুলে মাথা গোঁজেন তারা। অনাহারী মা আর ফুটফুটে সন্তানের দিকে চেয়ে ঢাকায় পাড়ি জমায় কাজের আশায়। অন্যদিকে আবার যৌতুক নিয়ে বিয়ে করে ঘরে বউ তোলে সালমার স্বামী আক্কাস। ভুলে যায় নাবালক সন্তান শাকিব কে।
   বাসে যেতে যেতে দুঃখের ভাবনায় যখন আচ্ছন্ন, ঠিক সেই মুহূর্তে বাসের বিকট এক শব্দে ধ্যান ভেঙ্গে যায় সালমার। মনে হয় কিছু একটার সাথে বাসটির সংঘর্ষ হলো। নিমিষেই চলন্ত বাসটি যেন ঘূর্ণিপাকের মতো মোচড় দিয়ে উঠে। বাসের ভিতরে থাকা মানুষের আর্তচিৎকার, আহাজারী, আল্লাহ-রাসূলের নাম জপতে থাকে সবাই। চারিদিক অন্ধাকার হয়ে আসে ধূলায়, সিগন্যাল লাইট নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত তখনো। জানালার কাঁচগুলো মড় মড় করে ভেঙে চুড়মার হয়ে যায়। ধূলোর ঝাঁপটা চোখে এসে পড়ে। ধূলোময় চোখে আবছা আবছা বুঝতে পারে সালমা, তার পুরো দেহ যেন কোথাও গিয়ে আটকে আছে, যন্ত্রণা হচ্ছে প্রচণ্ড ভাবে। গাল বেয়ে তরল কি যেন নামছে টপটপ করে, মাঝে মাঝে ক্যামেরার ফ্লাশ লাইটের আলোর মতো জ্বলছে ক্যাচ ক্যাচ শব্দে। দূর থেকে এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন কানে বাজতে থাকে। এমন যন্ত্রণায় বাঁচার জন্য আকুতি জানাবার শক্তি টুকুও হারিয়ে ফেলেছে সালমা। ধীরে ধীরে যেন নিঃশ্বাস থেমে যাবার উপক্রম। এই মুহূর্তে চার বছরের ছেলে শাকিবের কথা খুব মনে পড়ে সালমার। অসুস্থ মা, যাকে দেখার জন্য ছুটে আসা- সেই মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। মাঝে মাঝে পায়ে প্রচণ্ড আঘাতের অনুভবটা যেন আরো বেড়ে যায়, মনে হয় করাতে কাটা হচ্ছে তার পায়ের উপরি ভাগ থেকে, নিজের শরীর থেকে কিছু একটা বিচ্ছিন্ন হতে চলছে। অনিশ্চয়তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে শেষ ক’ফোটা জল। নিভে যায় অনুভবের আলো, থেমে যায় নিঃশ্বাস। চোখ দু’টো তখনও একমাত্র সন্তান শাকিব কে ইশারায় ডাকে, সারিবদ্ধ লাশের মিছিল থেকে...।

সোহানুর রহমান শাহীন
রংপুর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন