মেনু

আবু উবায়দাহ তামিম-এর গল্প


ধূসর কাচে অঙ্কিত যে মিথ্যে



ক.
পান্থ স্বপ্নে দেখল- সে অনেক রাতে বসে ল্যাপটপের মৃদু আলোয় টুকটুক করে কি-বোর্ড চেপে কোডিং করছে। হাতের আঙ্গুল, ঠোঁট এবং মন একসাথে নিবিষ্ট হচ্ছে কোডিংয়ের প্রতি। ঠিক সেই নীরব ঠাসা মুহূর্তে দরজায় আংটা নাড়ার আওয়াজ হলে পান্থর তৃতীয় চোখটি খুলে গেল। সে বাকী দুটো চোখ ল্যাপটপের উপরে আলগা করে রেখেই বেখেয়ালে দরজা খুলে ফেলল। সে ভূত দেখেনি। তবে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠে আবার লাগিয়ে দিল দরজাটা। পান্থ মুখ বিড়বিড় করে বলতে লাগল, মেয়েটি কি চলেই এলো তবে। দরজার উপর হেলান দিয়ে পান্থ একবার ভেবে নিলো, মেয়েটি কি সত্যি তাকে ভালোবাসে? সত্যিকারে ভালোবাসলে মেয়েটিকে কষ্ট দেয়া হয়ত ঠিক হবে না। ধীরে ধীরে পান্থর গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো আর ভাবল, দরজা কি খুলবে? দরজা খুললে কী করতে পারে মেয়েটি? মেয়েটি দরজায় দ্বিতীয়বার থাবা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পান্থর ঘুম ভেঙ্গে গেল। তার গলা শুকনো, খুব পানির পিপাসা লেগেছে। পান্থ এখন কোথায় আছে কয়েক মুহূর্তের জন্য সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। একবার মনে হলো সে হয়ত তার নিজের রুমেই শুয়ে আছে। পরক্ষণে আবার মনে হলো, নাহ, সে হয়ত অফিসে বসেই ঘুমিয়েছিল এতক্ষণ। কারণ তার অফিসেও এভাবে বসে নাক টেনে ঘুম দেয়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু তার এ দুটো ধারণাই মিথ্যে হলো, যখন তার পাশের আসনে বসা কোঁকড়া চুলের মেয়েটি তাকে হালকা খোঁচা দিয়ে বলল, 

- মি. পান্থ! ইউ আর নাউ ইন মুভিং ট্রেইন।

- ইট'স ওকে! ইট'স ওকে! থ্যাংকস... বলে মুখ কাঁচুমাচু করে লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করল পান্থ। মেয়েটিও ঠোঁট বেঁকে হাসল এমন ভঙ্গীতে, কেমন যেন পান্থর ছেলেমানুষী দেখে সে খুব মজা পেয়েছে। পান্থ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় কাঁধের ব্যাগ থেকে পানির বোতল নিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেয়ে নিল এবং কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে শরীর এলিয়ে দিল।



পান্থ এখন ট্রেনে চড়ে খুলনা থেকে ঢাকায় যাত্রা করছে। আগামীকাল তার একটা প্রোগ্রামিং ফিস্টে যোগ দেয়ার কথা, নিজের একটি গেমিং প্রোজেক্ট নিয়ে। তার আগে পান্থর একটা পরিচয় জেনে নেয়া যায়- ওর পুরো নাম পান্থ ইসলাম, পেশায় একজন ফ্রিল্যান্স গেইম প্রোগ্রামার। গেল বছর, তার গোয়েন্দাভিত্তিক গেইম 'দ্য এ্যাকাউন্ট অব গড' এর জন্য পুরস্কৃত হয়ে ব্যাপক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছিল সে। তারপর থেকে অল্প অল্প করে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে তার। আর সেই সুবাদে এবারই প্রথম বড় কোনো প্রোগ্রামিং ফিস্টে যাওয়া তার । তাই আগামীকালের প্রোগ্রামের জন্য সে বেশ সিরিয়াস হয়ে আছে। চেহারায় উদ্বিগ্ন ভাব। এই যাত্রার মধ্যেও সে কয়েকটি বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেটের মনিটরে।



পান্থর চোখের পাতায় আবারও ঘুম আসতে লাগল খানিকটা। কিন্তু ট্রেনের একটা ঝাঁকুনিতে ঘুমের তন্দ্রা ভাবটা নষ্ট হয়ে গেল। হঠাৎ পাশের আসনের মেয়েটা বলে উঠল,

- মি. পান্থ! কিছু মনে না করলে আসুন, আমরা কথাবার্তা বলি। এতে হয়ত আমাদের একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গ ভ্রমণটা আনন্দদায়ক হবে।

- হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই! তার আগে একটা কথা জানতে চাই আমি! 

খুব আনইজিভাবে কথাটি বলে ঢোক গিলল পান্থ।

- কী প্রশ্ন? অবাক হওয়ার ভঙ্গীতে বলল মেয়েটি, ঠোঁটের কোণে কৌতুহলী মৃদু হাসি। 

- আমার তখন একটি দুঃস্বপ্ন মতো দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আপনি বললেন 'মি. পান্থ! ইউ আর নাও ইন মুভিং ট্রেইন' কিন্তু কেন বললেন ওটা?



- ওহ হো হো হো! জ্বোরে হেসে ওঠে কোঁকড়া চুলের মেয়েটি। তারপর বলে,

- তোমাকে আমার অকুপেশনটা সম্পর্কে বলতে একদমই ভুলে গেছি পান্থ। আমি একজন সাইক্লোজি স্পেশালিষ্ট।



তখন তোমার মুখের ভঙ্গী বা ভীতিভাবটি দেখে আমি বুঝে নিয়েছিলাম তুমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছিলে। এমন অনেক পেশেন্ট দেখতে দেখতে আমি অভিজ্ঞ হয়ে গেছি যে। তাই-ই বলে দিলাম। কথাটুকু বলে একটু থেমে মেয়েটি আবার বলল, 

- বাট এ্যানি রঙ ইন দিজ?

- নো নো, সিস। এমনিই মনে হলো; তাই জিজ্ঞাসা করলাম। বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে থাকল পান্থ। তার মনে প্রশ্ন জাগল, স্বপ্নে যা দেখেছি, সেটাও কি মেয়েটা বুঝে ফেলেছে নাকি? ধুর, তা বুঝবে কেনো? পান্থ একবার ভাবল, তার এই দুঃস্বপ্নের কথা কি খুলে বলবে মেয়েটাকে? সাইক্লোজিস্ট হবার কারণে হয়ত সে কোনো সাজেশন দিতে পারবে পান্থকে। কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে তো সবে পরিচয় হলো, তাও এই ট্রেনেরই ভেতরে। তাকে কি পারসোনাল কথা বলাটা ঠিক হবে? 


হ্যাঁ এবং না, এই দুটো শব্দ মৌমাছির মতো ঘুরতে থাকে পান্থর মাথার মধ্যে। আর কোঁকড়া চুলের মেয়েটি মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে জোনাকী পোকাদের দল বেধে ছোটা দেখে, আবার পান্থর দিকে কিছুক্ষণ পর পর তাকায়। ওদিকে ট্রেন ছুটে চলে সব অন্ধকার পাশে রেখে, তার আপন গতিতে। অথচ আমরা তার পেটের ভেতরে থেকে কিছু আঁচ করতে পারি না।

খ.
পান্থ তার এই ছোট্ট জীবনের মধ্যে প্রোগ্রামিং এর পোকা ঢুকিয়ে একটা মানব মনকে কেমন যেন রোবোটিক্স টাইপ করে ফেলেছে। সে জানত এমন ছেলেদের সঙ্গে কোনো মেয়ে বিয়ে তো দূরের কথা প্রেম করতেই আসে না। তারা এমন প্রোগ্রামার ছেলেদেরকে নিতান্তই পাগল ভাবে। কিন্তু একরাতে পান্থর সে ধারণা বদলে গেল, 


সেই রাতে পান্থ তার ফেসবুকে লগিন করার সাথে সাথে ইনবক্সে দেখল একটা মেয়েরই পরপর তিনটি ম্যাসেজ এসেছে। মেয়েটির নাম শ্রাবণী তারা। তিনটি ম্যাসেজ বা কোনো মেয়ের ম্যাসেজ বলে পান্থ কোনোরকম বিচলিত হওয়া থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে অন্যকিছু ভাবতে চাইল। কিন্তু ঐ মেয়েটি বলতে চেয়েছে কী! তার তিনটি ম্যাসেজ এমন-


১. প্রিয় পান্থ! তোমাকে কখনোই আমি দেখিনি। তবে তোমার ছবি কয়েকটা পেয়েছি গুগলে। এই ম্যাসেজটি পাঠানোর কারণ, তোমার সদ্য তৈরী গেইমগুলো খেলে আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। 

২. এত সস্তাভাবে বলছি বলে তুমি আমাকে নিয়ে খেলা বা তামাশা করবে না, প্লিজ।

৩. আই রিয়েলি লাভ ইউ, প্লিজ ফিরিয়ে দেবে না আমাকে।


পান্থ সেদিন অনেক কিছু ভেবেছিল। প্রথম তো ভেবেছিল কেউ তার সাথে ধোঁকাবাজি করেই এমনটা করছে। তার ধারণায় ভুল ছিল। ধোঁকাবাজি নয়, আসলেই চাঁদের মত এক টুকরো প্রেম এসে পান্থর গায়ে আলো ছড়িয়েছিল সেদিন। কিন্তু পরবর্তীতে ইঁদুরের গর্ত খোঁড়ার মতো টুকটুক করে ইনবক্স আলাপ জমাতে জমাতে সে প্রেম কোথায় গিয়ে পৌঁছাল, এখন তা ভাবতেই পুরো শরীর ঘেমে ওঠে পান্থর। কিন্তু কেমন করে যে পরিবর্তন হয়ে গেল পৃথিবীটা, তারা কেউ বুঝতে পারল না। যখনই রাধা উন্মাদ হয়ে উঠল কৃষ্ণকে একপলক দেখার জন্য, তখনই কী যেন এক সন্দেহ গেথে বসল সরল গোছের ছেলে পান্থর মনে।


মেয়েটি কি আর কাউকে পেল না, হতে তো পারে বাজারি টাইপের মেয়ে সে। তার জন্য কি আমাকেই পেল শেষপর্যন্ত?...ভাবতে লাগল পান্থ। 


এই সন্দেহটিই বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে গেল তাদের ইনবক্স চ্যাটিং, প্রেম-ভালোবাসা। এমনকি মাঝে মাঝে দু'একদিন তার আইডিও ডিএ্যাক্টিভেট করে রাখতে লাগল পান্থ। হয়ত এসব দূরে দূরে রাখার চেষ্টা 'শ্রাবণী তারা'র ভেতরে কষ্টের ঢেউ তুলছে অথবা বাজারি হলে ঢেউয়ের বদলে তার স্বাভাবিকতা নিয়ে থাকছে। অযথা তা নিয়ে মাথা ঘামাল না পান্থ।


তারপর থেকে প্রায়ই পান্থ যখন ক্লান্তভাবে ঘুমিয়ে পড়ে, তখনই সে স্বপ্নে দেখে শ্রাবণী তারা হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে এসেছে। কখনো কাঁদো কাঁদো চেহারায়, কখনো আবার অভিমানী চেহারা নিয়ে। অথচ পান্থ আদতে কখনোই দেখেনি শ্রাবণীর আসল চেহারা। সব দেখা কল্পনার পরে। রেলস্টেশন পৌঁছাতে আর এক কিলোমিটার লাগবে ট্রেনটির। ট্রেন ছুটে চলছে তার নিজস্ব শব্দে। ঘুমন্ত যাত্রীরা জেগে উঠেছে। নামবার হালকা প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে তারা। হঠাৎ পান্থ খেয়াল করল, সেই কোঁকড়া চুলের মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে। পান্থ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল মেয়েটির কৃষ্ণ এলোমেলো চুল লেপ্টে গেছে তার শাদা মুখের সাথে। কী নামে ডাকবে মেয়েটিকে? মেয়েটির তো নাম জানে না পান্থ। নিজের উপর নিজেরই রাগ হলো পান্থের, তার কী জীবনে একটু বুদ্ধি সুদ্ধি হবে না। এই তিন চার ঘন্টা বসে কত কথাই না হলো, অথচ মেয়েটির নাম পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হয়নি।



মেয়েটির হাতে হালকা স্পর্শ করে জাগিয়ে দিল পান্থ। নিচু কন্ঠে বলল,

- আমরা চলে এসেছি, উঠে পড়–ন, সিস।

মেয়েটি মুখ নাড়ল, এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে নিল। টান টান চোখে বলল,

- পান্থ! কোনোদিন মনে চাইলে দেখা করবে। আমার কার্ড দিচ্ছি তোমাকে।

বলতে বলতে সে বড় ভ্যানিটিব্যাগের চেইন টেনে একটি রঙ্গীন স্টাইলিশ ভিজিটিং কার্ড বের করে দিল পান্থর হাতে। তাতে ইংলিশ ফন্টে লেখা-

Dr. Shanta Parvin
Phsyclosy Speacialist, 
Rashida Memorial Hospital
Panthapath, Dhaka.


গ.
প্রোগ্রামিং ফিস্ট শেষ হয়েছে দুদিন আগে, পান্থ এখনও ঢাকাতে আছে। নিরিবিলি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ ছোটফুফুর বাড়িতে, কাল বড় খালুর বাড়িতে, থাকছে এভাবেই। পান্থর ঠিক মনে পড়ে না, তার কতদিন ফেসবুকে লগিন করা হয় নি। শ্রাবণী তারার সাথে যোগাযোগ হয়নি অনেকদিন। হঠাৎ শ্রাবণীর কথা মনে পড়ে বুকের ভেতরে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করল পান্থ। তার খুব মন চাইল শ্রাবণীর সাথে কথা বলতে এবং সেই সঙ্গে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ল সে। 

রাতে শুয়ে শুয়ে ল্যাপটপ অন করে পান্থ, ফেসবুকে লগিন করে। প্রথমে ঝৎধনড়হর ঞধৎধ লিখে সার্চ দেয়, সার্চ রেজাল্টে তার শ্রাবণী ছাড়া অচেনা আইডিগুলো বেরিয়ে আসে হুড়মুড় করে। এবার সে ঢোকে ইনবক্সে, খুঁজতে থাকে শ্রাবণীকে। নাহ কোথাও নেই। এবার সে ম্যাসেজগুলো ঘাটতে থাকে পাগলের মতো। পান্থ ধারণা করে একবার, হয়ত শ্রাবণী আইডি নেইম চেঞ্জ করেছে। আরে তাইতো, হ্যাঁ পেয়েছে তো ম্যাসেজগুলো। সত্যিই নেম চেঞ্জ করে ফেলেছে শ্রাবণী। কিন্তু কার নাম এটা! আবারও চমকে ওঠে পান্থ। অপলক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে ল্যাপটপের সাদা মনিটরের উপরে। তার চোখ ঝাপসা হতে হতে ভিজে ওঠে পানিতে। রাত তিনটে চৌদ্দ এখন, আর এক মিনিট হলে সোয়া তিনটে বাজবে। তার মানে গভীর রাত। পান্থ মানিব্যাগ থেকে ড. শান্তা পারভীনের কার্ডটি হাতে ধরে দেখে, আর শ্রাবণীর পরিবর্তিত নামের সাথে মেলাতে থাকে ভিজিটিং কার্ডের অক্ষরগুলো। আর চুলের সঙ্গে চিরুনী মেলার দৃশ্যের মতোই দুটি নাম একসঙ্গে মিলে যেতে থাকে ক্রমশ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন