মেনু

রক্তিম মিলন -এর গল্প

ভালোবাসা হত্যার বিচার হয় না
রক্তিম মিলন


'তুমি কই?'
'ক্যাম্পাস থেকে ফিরছি।' ফোনে কথা বলার সময় উত্তরে পরশ জানাল।
পরের প্রশ্নে অন্তিম তাঁকে জিজ্ঞেস করেছে, 'দেখ করতে পারি?'
'হ্যাঁ।'
সম্মতি সূচক জবাব পেয়ে দুপুরের কড়া রোদে হেঁটে অন্তিম দেখা করতে গেল। ব্যস্ত রোড। গাড়ি চলছে। কথা খুব জোরে বলতে হয়। ক্ষুধা পেটে ক্লান্ত শরীর থেকে কথা বেড় হতে চায় না। তবু বলছে। পাশের হোটেলে খেতে যাবার কথা বলতেই পরশ জানাল, 'মেসে ছোট বোন আছে।'
'মেসের সামনে পর্যন্ত গেলে আন ইজি ফিল করবে?'
'না, মানে। ঠিক আছে, আস।'
রাস্তা পাড় হয়ে পরশ অপেক্ষা করছে। কিন্তু অভিমানী অন্তিম গেল না। তাঁর প্রশ্ন ছোট- বোন আছে, তাঁর সামনে পড়লে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো। অন্তিমের মনে হল পরশ বোধহয় তাঁকে উপেক্ষা করছে। অথবা সে তাঁর প্রিয় মানুষকে কারো সামনে বিব্রত করতে চায় না। তাই গেল না। অভিমানী অন্তিমের ক্ষুধা ক্ষোভে ভরে উঠল। না খেয়েই সে তাঁর ডরমিটরিতে ফিরে গেল। অন্তিম এসেছিল পরশকে চা খাওয়াবে আর সে হোটেলে ভাত খাবে এই পরিকল্পনা করে। কিন্তু আন্তঃকথোপকথোনে সামান্য ঘাটতি থাকায় সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হল না। ক্লান্ত দেহে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই সে ঘুমের ঘোরে হারিয়ে গেল। ক্ষুধা পেটে খুব বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারল না। ঘুম ভাঙ্গার পর মোবাইল চাপতেই চোখে পড়ল পরশের এসএমএস— 'আমি জিজ্ঞেস করলাম মেস পর্যন্ত যাবা নাকি এখানেই কথা বলবা। আর তুমি…..অন্তিম তুমি আমাকে কতটা চাও জানি না। তবে আমি তোমাকে খুব করে চাই।'
এসএমএস পড়ে অন্তিমের ক্ষুধা আবার বেড়ে গেল। খেতে যেতে যেতে পরশকে সেও একটা এসএমএস লিখল, 'আমি তোমাকে খুব করে চাই।'
দু‘জনের চাওয়াতে কোন গাফিলতি নাই। নাই কোন ফাঁক। কিন্তু আর সমস্ত কিছু—যাদের নিয়ে আমাদের সমাজ, আমাদের পরিপার্শ্বিকতা তাঁদের চাওয়াতে গাফিলতি আছে। তাঁরা ভালবাসা বুঝে না। তাঁরা প্রেম বুঝে না। তাঁরা দু‘টি নিষ্পাপ মনের চাওয়া বুঝে না। তাঁরা পাষাণ। তাঁদের ভালবাসা হত্যার দায়ে দায়ী করা যায় কিন্তু বিচার করা যায় না। এ এক বড্ড যন্ত্রণার। সে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় ভুক্তভোগীকে। প্রকৃতি সে যন্ত্রণা দেখে কেবল পরিহাস করে। বুকের ব্যথা, মনের কষ্ট, চাপা কান্না, প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য না পাবার অন্তর্জ্বালা, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ সমস্ত কিছু যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তবু প্রতিকার পাওয়া যায় না। ভালবাসার সমস্ত ন্যাকামি তাঁদের কাছে বোকামি। এই বোকামির দাম মূল্যহীন। মূল্যহীন ভালবাসা আকড়ে ধরে থাকাটাও বোকামি। অন্তিমরা সেই বোকামি যুগ যুগ ধরে করে আসছে। সেই শরতের দেবদাসের সময়কাল থেকে চলমান সময় অবধি।
প্রকৃতির রোদ চক্রের খেলায় অনেক বেলা কেটে গেছে। অনেক সময় হারিয়ে গেছে। অনেক মিছিল হয়েছে। অনেক আন্দোলন হয়েছে। তবু পরিপার্শ্বিকতা বলতে যা বুঝায় তার খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। বরং আরো খারাপ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশন জ্যাম আরো বেড়েছে। বহু আন্দোলনেও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করা যায়নি। রক্ষা হয়েছে শুধু স্বার্থকায়েমীদের স্বার্থ। দলীয় লেজুরবৃত্তিতে উচ্ছিষ্ট রাজনীতির ভিড়ে অন্তিমরা তবু দাঁড়িয়েছিল। 'রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চাই না। বাঁশখালিতে লাশ কেন?' প্রভৃতি বলে বিভিন্ন জন দাবিতে স্লোগান দিয়েছিল। কিন্তু নিজের ভালবাসার কথা স্লোগানে তাঁর বলা হয়নি। একদিন সাহস করে সে তাঁর ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের নিয়ে ভালবাসার কথা ভেবেই সেশন জ্যামের কথা বলতে গিয়েছিল। ডিপার্টমেন্ট প্রধান শুনেছিলেন। শুনে বহু জ্ঞানের কথা কপচিয়েছিলেন। তারপর আরো অনেক জল ঘোলা হয়েছিল। সেই ঘোলা জলে অন্তিম আর পরশকে খুঁজে পায়নি। খুঁজে পায়নি আসলে বিষয়টি তা নয়। তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। ডিপার্টমেন্টের স্বার্থ চাপায় পিষ্ট হয়েছে অন্তিমের ভালবাসা।
ভালবাসতে ভালবাসতে পড়াশুনা মাত্র দশ বছরে শেষ করে চাকরির ভাইভা পরীক্ষা শেষ করে পুরনো স্মৃতি রোমমন্থন করতে করতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে অন্তিম। কড়া লিকারের লাল রংয়ের চা। মাথা ঝিম ঝিম করলে অন্তিম এই চা খায়। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। চায়ের কাপেই অন্তিমের সব মনোযোগ। আর কোন দিকে সে তাকাচ্ছে না।
'চায়ের নেশা এখনো কাটেনি, না?'
এবার বাধ্য হয়ে অন্তিমকে দৃষ্টি সরাতে হলো। হালকা রংয়ের শাড়িতে সেই চেনা মুখ। কিন্তু চেনা হলেও সে আর খুব কাছের কেউ নয়।
'আরে পরশ,সম্প্রীতি পরশ। কেমন আছেন?' অন্তিমের উত্তম পুরুষে কথা বলাটা খুব ভদ্র গোছের কিছু নয়। এতে একটা শ্লেষ, একটা চাপা আর্তনাদ আছে।
পরশের পুরো নাম সম্প্রীতি পরশ। বহুদিন পর চেনা কণ্ঠের অচেনা গাম্ভীর্যে এই ডাক শুনতে পেয়ে পরশ হতবাক হয়েছে। সেও অন্তিমকে তাঁর পুরো নাম উচ্চারণ করে বলেছে, 'ভাল। ভাল আছি, অন্তিম কিশলয়। আপনি? আগের মতই আছেন দেখছি!' শুধু হু বলে একটা শব্দ করল অন্তিম। দোকানদার না চাইতেই নতুন আরেক কাপ চা দিয়েছে। সেই চা পরশ চেয়েছে কি না অন্তিম সেটা খেয়াল করেনি। তাঁর নজরে এসেছে পরশ চা খাচ্ছে।
'তুমি আগের মতই কড়া লিকারের চা খাও?'
উত্তরে পরশ কিছু বলেনি। তাকিয়ে দেখেছে শুধু এক পলক। তারপর বলেছে, 'আজকের বৃষ্টিটা দারুণ।' তখন হালকা বাতাসের সাথে সামান্য বৃষ্টি হচ্ছিল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অন্তিম বলেছে, 'হুমমম! বৃষ্টি। বৃষ্টিতে আর হয় না সৃষ্টি।'
'বৃষ্টিতে আর হয় না সৃষ্টি। কোন কবিতার লাইন যেন?'
'হু, হুমমমম! সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শাশ্বতী কবিতাটা পড়েছো—
শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে,
… … … … ...
স্বর্ণ সুযোগে লুকোচুরি-খেলা করে
গগনে গগনে পলাতক আলো-ছায়া।
… … … … …'
'না! পড়ি নাই।'
'পড়তে পার। নেটে সার্চ  দিলেই পাবে। আচ্ছা, বিশ্বায়ন নিয়ে ভালো জানা যাবে এমন একটা বইয়ের নাম বলতে পার।'
'জানি না।'
'কেন?'
'পড়ি নাই। হইছে।'
কথায় একটা ঝাঁঝ ছিল। ঝাঁঝটা ক্ষোভ থেকে। কারণ যে বিষয়ে টপার হয়ে পরশ পড়াশুনা শেষ করেছে, সেই বিষয়ের একটা বইয়ের নাম সে বলতে পারবে না এমনটা চিন্তার অতীত। কত বইয়ের আলোচনা করে তাঁরা দুপুর কাটিয়েছে। রাত জেগে ফোনে কথা বলেছে। অথচ বহুদিন পরের সাক্ষাতে সেসব পানসে লাগছে। কপালে অন্তিমের চিন্তার রেখা বুঝা যাচ্ছে। অন্তিমের চিন্তার বলি রেখা এখন তাঁর অক্ষমতা নিয়ে। তাঁর অক্ষমতা সময় মত  পড়াশুনা শেষ না করতে পারার। এটা তাঁর অক্ষমতা নাকি অন্য কারো?
'মামা, চায়ের টাকা নেন।' বলে পরশ টাকাটা বাড়িয়ে দিল।
'না, আমি দেই।' বলতে গিয়ে থেমে গেল অন্তিম। কেন বলবে? বেকার হয়ে আগ বাড়িয়ে কেন বলবে যে, বিলটা তাঁর দেয়া উচিত। টিউশনির টাকায় প্রেম করার বড়াই দেখানো যায়। রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর দাপট করা যায়। বাদাম কেনা যায়। কিন্তু একজন কর্মজীবী মানুষের মুখের উপর বলা যায় না বিলটা তাঁর দেয়া উচিত। এই উচিত অনুচিতের মাঝখানে আজ অন্তিম এবং পরশ যোজন ব্যবধান দূরে অবস্থিত। ব্যবধান বাড়িয়েছে নানা অনুঘটক। বেকার ছেলের জন্য পরশ পরিবারের কারো কাছে অন্তিমের কথা বলতে পারেনি। সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি তুলে পরশ পরিবারের কারো মুখে উপর বলতে পারেনি সে অন্তিমকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। কারণ অন্তিমের পড়াশুনা তখনো শেষ হয়নি তাঁর ডিপার্টমেন্টে তিব্র সেশন জ্যামের কারণে। তার উপর সে বেকার। তাই সদ্য মাস্টার্স শেষ করা পরশকে বিয়ে করতে হয়েছিল।
পরশের বিয়ের তিন বছর পর আজ তাঁদের দেখা হয়েছে। সবেমাত্র পড়াশুনা শেষ করা অন্তিম এখনও বিয়ের কথা চিন্তা করতে পারছে না। সে চিন্তা করলেও পরশ নীড় বদল করবে কি না অন্তিম তাও জানে না।
অন্তিম কি বিয়ের কথা ভাববে নাকি পরশের স্পর্শ সুখ, গা ঘেষে বসে থাকবার সময় যে তাপ বিনিময় হয়েছে তার পুলক, হাত ধরবার সময় যে শিহরণ হয়েছে সেই সকল স্মৃতি নিয়ে পুরো জীবন কাটিয়ে দিবে। এ সকল ভাবতে ভাবতে যখন অন্তিম পুরো ক্লান্ত আর অবসন্ন তখন সে সংবিত ফিরে পেল মিছিলের স্লোগানে। বৃষ্টি থেমে গেছে। বৃষ্টি শেষে ক্যাম্পাস সংলগ্ন রোডে মিছিল শুরু হয়েছে। মিছিল থেকে আওয়াজ আসছে, 'শিক্ষক না দোকানি, ফি বাড়ানোর শয়তানী।' মিছিলের অনেক মুখ অন্তিমের চেনা। এখন তাঁর অচেনা লাগছে নিজেকে। অচেনা লাগছে তাঁর নিজস্ব পরিপার্শ্বিকতাকে। এই রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনায় ভালোবাসা মূল্যহীন। যেন প্রেম ভালবাসার চেয়ে টেন্ডারবাজী করা ভালো, তাতে প্রেমিকাকে পাওয়া যায়।
মিছিল চলে গেছে। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখে পরশ নেই। চেনা শহরের ভিড়ে সে হারিয়ে গেছে। আর তাঁকে কাছে পাওয়া যাবে না। তাঁর সাথে রিকসায় বসা হবে না, বাদাম খাওয়া হবে না, চকলেট কেনা হবে না, গিফট কেনা হবে না, আরো অনেক কিছু হবে না। হয়তো পরশেরও অনেক কিছু হবে না। অন্য কারো সাথে—যার সাথে সে থাকছে তাঁর সাথে অনেক কিছু তাঁর শেয়ার করা হবে না, যেগুলো অন্তিমের সাথে খুব সহজে করা যেত। অন্তিম তাঁর বন্ধুপ্রতিম জীবন সঙ্গী পেল না, হয়তো পরশও। অথবা উল্টোটা। অথবা কোনটাই না।
দুম করে একটা আওয়াজ হলো। চারদিকে লোকজন ছুটোছুটি করছে। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির মিছিলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হামলা। পুলিশও প্রশাসনের নির্দেশ মেনে আন্দোলন থামাতে তৎপর। একটা রাবার বুলেট এসে লাগল অন্তিমের সোজা হৃদপিন্ড বরাবর। অন্তিমের তখন চিন্তা পরশ মিছিল পেরিয়ে যেতে পেরেছে কি না। কাঁদানে গ্যাসে নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। অন্তিমের দম আটকে আসছে। আবার একটা গুলি বুকের উপর এসে লাগল। রাস্তায় পুলিশ নেই। পুলিশ অনেক দূরে। তাঁরা আন্দোলনকারীদের তাড়াতে ব্যস্ত। রাস্তায় শুধু ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ছাত্ররা। তাঁদের হাতে দেশী অস্ত্র, দু‘একটা গান দেখা যাচ্ছে। পুলিশের রাবার বুলেটের মাঝখানে এরাই গুলি ছুড়েছে। সোনার বাংলার সোনার টুকরা ছাত্র নেতার আঙুল একটি গানের ট্রিগার টেনে ধরেছে।
শিক্ষা জীবন শেষ হবার কারণে অন্তিম আজ মিছিলে যায়নি। তবু মিছিল এসেছে। হৃদপিন্ড বরাবর একটা গুলি লেগেছে। সেটা রাবার বুলেট। ধাতব বুলেট লেগেছে অন্য পাশে।
অন্তিমের এসএমএস চেক করতে ইচ্ছে করছে, পরশ তাঁর জন্য কিছু লিখেছে কি না। পরশ কি লিখবে, এই সেশন জ্যাম তাঁর সৃষ্টি নয়; অথবা আবার কি সে লিখবে, 'অন্তিম, আমি তোমাকে খুব করে চাই।'
অন্তিমের অনন্ত যাত্রায় এই এসএমএস দেখে যাওয়া হয়নি। পরশ হয়তো লিখেছিল। অথবা লিখে নাই। তবু অন্তিমের লাশ নিয়ে মিছিল হয়েছিল। তাঁর ভালবাসার দাবিতে ‍মিছিল হয় নাই।
বাস্তবিক হিসেবগুলোই যেখানে গোলমেলে মনের হিসেব সেখানে মেলে না। বস্তু জগতের সুষ্ঠু হিসেব মিললে অন্তিম-পরশরা হয়তো পরস্পর মিলবে। হয়তোবা।
ক্ষমতার পালা বদলে অন্তিম হত্যার বিচার হয়তো হবে। আর তাঁর ভালবাসা হত্যার বিচার চাইতে পারে একমাত্র পরশ। কিন্তু অন্তিমের ভালবাসার হত্যাকারীদের বিচার হবে না।

রক্তিম মিলন
রংপুর। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন