মেনু

আসহাদুজ্জামান মিলন -এর গল্প

অন্য পথে
আসহাদুজ্জামান মিলন


   মটরসাইকেল স্টার্ট দিতেই মাগরিবের আযানের ধ্বনি কানে এলো। স্টার্ট বন্ধ না করে দু'মিনিট দাঁড়ালাম। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর প্রশ্নই উঠে না। যেতে হবে অনেক দূরের পথ। রাস্তার পরিস্থিতি খুব একটা ভাল না। মাঝে মধ্যেই ছিনতাই হয়ে থাকে এই রাস্তায়। তারপর 'মরার উপর খাড়ার ঘা'র মতো বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
   রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার ভেণ্ডাবাড়ি নামক স্থানে কাজ শেষ করতে করতেই সন্ধ্যা হয়ে গেলো। যদিও সন্ধ্যা করার কোন ইচ্ছে ছিলো না। মাঝে মাঝে এমনই হয় বেশি তাড়াহুড়া করতে গিয়ে দেরি হয়ে যায়। সাথে রেইনকোর্ট থাকাতে কিছুটা স্বস্তি। ভেণ্ডাবাড়ী থেকে বড়দরগা পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছানো সবচেয়ে জরুরী। মাঝে দুটি স্থান বেশ খারাপ। ছিনতাই এর ভয় ছাড়াও অন্য কিছুরও ভয় থাকে। যদিও আমি খারাপ মানুষ ছাড়া অন্য কিছুকে ভয় পাই না। শুনশান ফাঁকা স্থান দু'টি অতিক্রম করতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো। মনে সাহস নিয়ে অতিক্রম করলাম দু'টি কথিত ভয়ের স্থান। বড়দরগা বাজারে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। রংপুর-ঢাকা হাইওয়ে রাস্তা। ভয়ের কিছু নেই। চা বিরতি দেবার ইচ্ছে হলো, কিন্তু দিলাম না। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রংপুর শহরে পৌঁছুতে বেশ সময় লেগে যাবে। বৃষ্টির মাঝে মোটরসাইকেল চালানো খুবই কঠিন। মটরসাইকেল চালানোর সময় চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। সামনে আর পিছনে সমান ভাবে দেখতে হয়। সামনে তাকানো অবস্থায় দু'মিনিট পরপর তাকাতে হয় লুকিং গ্লাসে। আর বৃষ্টির সময় চোখের দৃষ্টি বাড়িয়ে ৩৬০ ডিগ্রী করতে হয়। পিছন থেকে হঠাৎ করেই যেন বড় গাড়ি চলে আসে।
   ভেণ্ডাবাড়ি থেকে মাত্র দশ কি.মি. রাস্তা আসতে সময় লেগে গেলো এক ঘণ্টা। রংপুর-ঢাকা হাইওয়েতে রাত আটটার পর ঢাকার নৈশ কোচ গুলো চলাচল শুরু করে। মটরসাইকেল নিরাপদে চালানো আরো কঠিন হয়ে পরে ঢাকাগামী নৈশ কোচ গুলোর কারণে।
   যে কোন রকম দুর্ঘটনা এড়াতে মটরসাইকেলের গতি ঘণ্টা প্রতি ৩০ কি.মি. রাখলাম। খুব সাবধানেই মটরসাইকেল চালাচ্ছি। কিন্তু হঠাৎ করেই কেউ এসে সামনে দাঁড়ালো! একবার মনে হলো সাদা পোশাক পড়া কোন মধ্যবয়স্ক লোক রাস্তা পার হচ্ছে। হর্ন বাজানোর সময় নেই। দু'টি ব্রেক একসাথে চেপে ধরলাম। রাস্তা পিচ্ছিল থাকাতে পড়ে গেলাম মাঝ রাস্তায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে জ্ঞান হারালাম। শুধু মনে আছে রাস্তার পড়ে যাবার সাথে সাথেই ঢাকার নৈশ কোচ চলে এসেছে। অনেক কষ্ট করে হাত উঁচু করলাম। আসে পাশে থেকে কিছু লোক আসতে দেখলাম। আর কিছুই মনে নেই। স্বাভাবিক হতে কয়েক মিনিট লাগলো। যখন স্বাভাবিক হলাম তখন আমি রাস্তার ধারে। বুঝলাম কয়েকজন মিলে আমাকে আর মটরসাইকেল মাঝ রাস্তা থেকে সরিয়ে রাস্তার ধারে নিয়ে এসেছে। অনেক বলছে, আপনার কোথায় লেগেছে? হাত-পা গুলো নাড়াচাড়া করেন। একটু হাঁটেন। কি যেতে পারবেন? নানা জনের নানা কথা। আমার ওখানে থাকতে মন চাইছিলো না। আমি বললাম, 'আমি যেতে পারবো, যদি মটরসাইকেল স্টার্ট নেয়।'
   আমি মটর সাইকেল স্টার্ট দিলাম। স্টার্ট দিতে গিয়ে দেখলাম। ফুটপিন বেঁকে গেছে। ক্লাচ লিভার ভেঙে গেছে। ভাগ্য ভাল মটরসাইকেল এক কিকেই স্টার্ট নিল। সামনে কিছুটা ঠেলে ক্লাচ লিভার ছাড়াই চলতে শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়ে গিয়ার পরিবর্তন করলাম ক্লাচ ছাড়াই। এদিকে বৃষ্টির তীব্রতা আরো বাড়তে লাগলো। এ বছরের সেরা বৃষ্টি যেন আজই হচ্ছে। এভাবে বেশ কিছুদুর এলাম। সম্ভবত পনেরো বিশ কিলোমিটার চলার পর মনে হলো, আমি ভুল পথে চলছি নাতো? রংপুর এখনো আসছে না কেন? যে বাজার অতিক্রম করলাম, সেটা শঠিবাড়ি কিংবা মিঠাপুকুর নয়। তাহলে কোন বাজার? আমি কি বেঁচে আছি? নিজের শরীরে নিজেই চিমটি কাটলাম। বেঁচে আছি নিঃসন্দেহে। আরো বেশ কিছুদুর এগিয়ে রাস্তার ধারে দুরত্ব নির্ণয়কারক দেখলাম। যা দেখলাম তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে । তাতে লেখা গাইবান্ধা ২০ কি.মি.। হায় আল্লাহ, আমি কি তাহলে গাইবান্ধা যাচ্ছি! মটরসাইকেল ঘুরালাম। মনের সাথে বুঝে নিলাম আমি এবার রংপুরেই যাচ্ছি।
   নিজের বোকামিতে নিজেই হাসলাম। বৃষ্টির তীব্রতা কমে এসেছে। বুঝলাম মানুষের জীবনে কোন কোন সময় হঠাৎ করেই বিপদ আসে আবার চলে যায়। বিপদে ধৈর্য না হারিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখলেই অনেক কিছুরই সমাধান হয়ে যায়। আল্লাহ মানুষকে বিপদ দেন আবার তিনিই উদ্ধার করেন।

আসহাদুজ্জামান মিলন
রংপুর। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন