মেনু

মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০১৭

অনির্বাচিত বর্ষার কবিতা—২০১৭


অনির্বাচিত বর্ষার কবিতা—২০১৭। মাত্র দশটি কবিতা নিয়ে এবারের আয়োজন। কবিতাগুলো বর্ষা ঋতু কেন্দ্রিক। এতে 'অনির্বাচিত' শব্দটি জুড়ে দেয়ার কারণ, এবারের কবিতাগুলো কোনও বাছাই প্রক্রিয়া ছাড়াই প্রকাশ করা হলো। এবার বরং পাঠকরাই বেছে নিক ব্যক্তিগত পছন্দের কবিতাটি।



বন্য পীতম

পোড়া শহরের গল্প

বুকের ভিতর একটা আস্ত শহর পুড়ে যায়।
আমার সন্ধ্যা ছুঁয়ে যায় না একমুঠো বেলীফুলে,
খুব ভুলে আর কোন ঠোঁটে জন্ম হয় না কবিতার।
শহরের ব্যস্ত সন্ধ্যেরা (সন্ধ্যা) সে খবর রাখে না।
আমি হঠাৎ কোন প্রেমিকের আর্তনাদ শুনি।
কামিনী ফুলের গন্ধে বেড়ে চলে রাত।
বহুদূরে কুকুর ডাকে,
বাহাদুর চা বানায়, টঙ দোকানে আমার হাতে পোড়ে সিগারেট।
যুবতী মেঘের আড়ালে তখন খুব একা বর্ষার চাঁদ।
অথচ কেউ জানে না, বুকের ভিতর একটা আস্ত শহর পুড়ে যাচ্ছে।


সোহান সরকার

প্রণয়িনী বরষা

আকাশ চিরে বৃষ্টি ঝরে যবে চঞ্চলা বরষায়—
তব গৃহকোণে নির্জনে তনু-মনে যেতে চায়।

একলা রাতে, মেঘের সাথে যখন অজান্তে হারাই
হারিয়ে যাওয়া ছন্দগুলো সেথায় হঠাৎ দেখা পাই।

জানলা খোলা, আপন ভোলা ভবঘুরে বসে রয়
নিপুণ ভণিতা ছেড়ে কবিতা করে চলে অভিনয়।

ছন্দের কবি রন্ধ্রের ছবি খুঁজতে খুঁজতে খুঁজে পায়
চলে যায় চর্তুমাত্রায় পায় প্রথম পরিচয়—

কণ্ঠাগত শব্দ যত সেদিন নাহি গিলে খাই
সবই বরং উগ্রে দেই এত দিনে যা জমাই।

ক'দিন আগে; মধ্যভাগে শেষ তোমায় কাছে পাই
বৃষ্টি দিল একি নেশা! শুধুই তোমায় ছুঁতে চাই।

ভেজা ঘাসে হয়তো হাসে, তোমায় পেয়ে সাথে আমায়
মিলেমিশে একাকার তোমার আমার ভেজা জামায়।

ঘড়ির কাটা দিচ্ছে ভাটা কারবা আছে সে খেয়াল
বহু সাধনার সমাপ্তিতে ভেঙেছি আজ সব দেয়াল।

ছন্দে আমি বন্ধ নই আর, পেয়েছি আজ আলোর গতি
কর্মে আমার নেইকো বিরাম, থামাবে আমায় সে কোন যতি?



সঞ্চারিণী

প্রতারণার ঋতু



বর্ষা এলেই মনে হয়
এসেছে আবার বুঝি সেই; প্রতারণার ঋতু,
এসময় কোনভাবেই বলা যাবে না, ভিজিনি, ভিজবোনা, ভিজতে চাইনা!
আর ভিজলেই নরম কাদায় রাখতে চাইবে; যে কেউ তার পা, কিংবা
বলবে, "এই যে দেখো; পায়ের আঙুল কেমন ফুলে ওঠেছে, ধরে দেখো; কেমন কাঁপছে!
অঙুলাগ্রে দেখা দিয়েছে; কেমন ঝড়ের আশংকা!"
রাখছি রাখছি বলে কাল্পনিক অনুভব জাগিয়ে; আর তার স্পর্শে খুলে গিয়ে গোপন কপাট,
কোমরে কলস না ভাঙার জলাবদ্ধতা কিংবা মাংসপেশী কুঞ্চনের চাপ বাবদ; তাবৎ কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়ার সহজ সমাধান সামনে এনে দিয়ে বলবে, "খিড়কিটা খোল! ভেতরে আসতে চাই, অপেক্ষমান!
তুমিও ছুটে এসে খুলে দিবে সেই কঠিন দরোজা, এতটা বছর খোলা হয়নি যা।
দাঁড়িয়ে আছো সেই দরজাটির কাছে; অপেক্ষায় তুমি,
তাতে আরো বেশি অনুভুতির গলনে গলে যেতে থাকছে; নরম দেয়ালের মাটি,
বেড়ে ওঠা আঙুল জাগাবে বিস্ময়! তুমি ভয় পেতে পেতে মুদে আসা চোখে দেখবে; 
জেগে থাকার এক নতুন স্বপ্ন-ভেজা পথ! আছড়ে পড়ছে বৃষ্টি-শলাকা সেই পথের উপর, 
আর সে পথে আঙুল নেমেছে যেন কার; দ্রুতগামী বৈদ্যুতিক তার! 
শপাশপ্ শব্দ জলের উপর। দৌড়ে যাওয়া ছোট পায়ের প্রবল ওঠা-নামা বারংবার।
কিছুতেই আড়াল করা যাচ্ছে না; অবাধ্য সেই ইচ্ছেটা!
অথচ চাইছো না; ভিজে যেতে চাইছো না, 
না... চাইছো না; কেউ নামুক... অবাধ সাঁতারের জলে; ডুবিয়ে দেয়ার কৌশলে,
ডুবিয়ে দিক; যার তার যেমন তেমন পা, এমনটিও তুমি চাইছো না, কারণ—
বর্ষা এলেই মনে হয়;
এসেছে সেই ছলনার ছল—কদম ফুলে ভিজে,
বৃষ্টিস্নাত দিন আর বর্ষণমুখর রাত্তিরে সেজে
                                                পহেলা আষাঢ়ে...


● 

নাজিয়া ছায়া

বর্ষা আমার প্রিয় ঋতু না

বৃষ্টি আমি ভীষণ ভালোবাসি।
রিমঝিম সুরের মাদকতায়
মোহ সৃষ্টি হয়।
মেঘে মাখামাখি আকাশ আর জলের গন্ধ মাখা বাতাসে
যেন রঙিন সুরার নেশা।
তবুও বর্ষা আমার এখন আর প্রিয় ঋতু না।
বর্ষা এলেই মনে পড়ে টুংটাং রিকশা,
ভেজা ভেজা কদম ফুল,
ঠাণ্ডায় নীল হয়ে যাওয়া কোন প্রিয় মুখ।
স্মৃতির আঙিনায় ভীড় করে
কেয়ার গন্ধভরা ঝিরঝিরে বিকেল।
তুমুল বর্ষনের শব্দের ভিতর ও
 আবছা শোনা যায় যেন  সেতারের মেঘমল্লার সুর। 
বর্ষা এলেই গাছেরা মেলে ধরে সবুজ কচিপাতায় ভুলে যাওয়া স্বপ্ন দৃশ্য।
বর্ষা এলেই দেয়ালে ঝুলানো নীলছাতা আর লাল রেইনকোর্ট তাকিয়ে থাকে বিষন্ন চোখে।
তাই আজকাল বর্ষা বাদ দিয়ে
শীত কে আলিঙ্গন করি ভালোবেসে।
অল্প দুপুর স্বল্প বিকেল ব্যস্ততায় কেটে যায়
বিবর্ণ ঝরা পাতায় আর ভেসে উঠে না অতীতের গল্প।
কুয়াশার চাদরে পরম আদরে শীত ঢেকে রেখে 
স্মৃতির শহর।
আমাকে দুঃখী করার জন্য নেই তার কোন বিশেষ আয়োজন।
শীতকেই ভালোবাসি আমি এখন।
তাই বর্ষা আর এখন আমার প্রিয় ঋতু না।


● 

মোহাম্মদ  শহীদুল্লাহ

বৃষ্টির রীতি-নীতি 

নগ্নবৃষ্টির ধমকে প্রকৃতির ব্যকরণ গিয়েছি ভুলে
জলজমাট সময়ের শ্বাসকষ্ট
কাব্যসুখে
ঘুমঘুম বেকারত্ব—
নদীর যৌবন যেন 
কৃপণ দুপুরের কোলে  শুয়ে থাকা নিরন্ন  কবিতার লাইন,

অভাগার দুচোখে
ডুবো মানুষের অভুক্ত ঘর-সংসার
 যান্ত্রিক হাতের কাছে 
মলামাছের মতো ঝাঁক বেঁধে আসে গাঙ ভাসা  উদোম মানুষেরা—ওরাও বুঝি এ দেশের-ই!
নগ্নবৃষ্টি এমনি হতচ্ছারা যে
কারো কারো
আকাশ ফুঁড়ে উঠবে 
জমকালো টাওয়ার।


● 

আরিফুল হাসান

কোন এক মেঘলা সন্ধ্যায়

কোন এক মেঘলা সন্ধ্যায়, পথে নেমে এসো খালি পায়ে,
আকাশে হয়তো মেঘের গর্জন শুনতে পাবে,
হয়তো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়বে,
হয়তো দমকা হাওয়ায় চোখ বুঁজে আসবে,
আমি অপেক্ষায় থাকব;
সেদিন না হয় তোমার প্রিয় ছাতাটা নাই আনলে,
বৃষ্টির ক'টা ফোঁটা পড়বে হয়তো তোমার চিবুক বেয়ে,
আর কাদামাখা পিচ্ছিল পথটাকে নিতে দিও
তোমার কোমল পায়ের সিক্ত পরশ।

তবে, কালো টিপটা দিতে ভুলো না যেন;
হয়তো জানো না তোমার প্রশস্ত কপালে কালো টিপটা
যেন শত বর্ষের সূর্য গ্রহন!

তুমি চাইলে আবার ফাঁকা রেল লাইন ধরে হাঁটতে পারি,
রেল লাইনের স্লিপারের ভারী লোহার পাত দেখে ভরকে যেও না,
হয়তো জানো না, অজস্র মানুষের নিত্য স্বপ্ন ওই পাতে চেপেই
পাড়ি দেয় দূর বহুদূ্রে।

যদি চাও তবে রাজপথ ধরে হাঁটতে পারি,
হাতে হাত রেখে বৃষ্টির পরশ নেব,
কংক্রিটের নগরীর বৃষ্টিতে থমকে থাকা প্রতিটা সভ্য মানুষ
আমাদের পাগল ভেবে দিক না প্রচণ্ড অভিশাপ,
অঝর বর্ষনে শুকনো কাঁদার মতো সে অভিশাপ
ধুয়ে যাবে নিমিশে।

তুমি চাইলে একটা গাঢ় সবুজ কলাপাতা  নিতে পারি,
মাথার উপর না হয় ছোট্টো একটা ছাউনি হলো!
না হয় পাতার উপর শুধু অবিরত বৃষ্টি পড়ার শব্দই শুনলে,
কীভাবে বিশাল আকাশ সুর তোলে ক্ষুদ্র পল্লবে।

উদ্দেশ্যহীন পথ চলায় সেদিন না হয় পাড়ি দিলাম
বেঁকে যাওয়া গলিপথ,
প্রতিটা বাঁকে হবে আমাদের আত্মা দর্শন।
আঁধারে ঢেকে যাওয়া গলিপথে
হয়তো কখনো একমুঠো আলোর দেখা পাবে,
আলোর নগরী থেকে বহুদূরে
নিকশ অন্ধকারে এক মুঠো আলোতেই হবে আমদের আশার সঞ্চারন।

শহরের অদূরে যে পুরোনো রাজবাড়ি আছে;
তুমি চাইলে সেখানেও ঘুরে আসতে পারি,
শতশত বছর ধরে  বৃষ্টিতে স্নান করছে বাড়িটা,
সেদিনের বৃষ্টি বাড়িটাকে শিহরিত করবে কিনা জানি না
হয়তো অনেক দিন আগেও ঠিক এমনি বৃষ্টি হয়েছিল,
রাতের দ্বিপ্রহরে হয়তো কোন যুবতী প্রশস্ত ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল,
সে বৃষ্টি হয়তো দীর্ঘ করেছিল তার প্রিয় মিলনের অপেক্ষাকে,
কয়েকটা মুহূর্তকে যেন এ বৃষ্টি করেছিল সহস্র বছর।
বাড়ির সামনে মস্ত পুকুরের বাঁধানো ঘাটটাতে বসে
দেখবো কতটা বৃষ্টি আছড়ে পড়ে প্রশস্ত জলাধারে।
এই অঝর বৃষ্টি যেন;
প্রতিটা মানুষের সব অপূরনীয় আকাঙ্ক্ষার নিংড়ানো প্রাণরস,
যা অসংখ্য কাল ধরে কঠিন তাপে জ্বলে আবার বৃষ্টি হয়ে
আবার সিক্ত হয়ে উঠেছে।
আবার প্ররোচিত করছে আশায় বুক বাঁধতে,
আবার বলছে স্বপ্ন দেখতে—
ঠিক শতবর্ষ আগেও যেমন বলেছিল।


● 

শিস খন্দকার

সমকালীন বর্ষা

সমূহ যোগ্যতা অযোগ্য প্রমাণ করছে বর্ষার আকাশ;
তুমুল উৎসবে চলছে সূর্যবন্দনা—
পুড়ে যাচ্ছে প্রিয়ার নরম ছাতা। 
★ ★ ★
অতিবৃষ্টি—লুকিয়ে ফেলে প্রিয়ার অশ্রু;
অতিরৌদ্র—উড়িয়ে দেয় প্রিয়ার অশ্রু।
অতিবৃষ্টি এবং অতিরৌদ্র সমার্থক হয়ে যায় প্রিয়তমার ব্যথিত চোখে।


● 

নয়ন আহমেদ

শ্রাবণ

ঘরভর্তি কতোগুলো শ্রাবণ এনে দিলে আত্মস্থ হতো কিছু মগ্নতা।
তোমাদের পরমায়ু বৃদ্ধি পেতো।

বাক্সভর্তি কিছু বর্ষা যাচ্ছে জীবনের দিকে।
চোখ, তার সৌন্দর্যে মজেছে।

কতো সংসার টুকরো টুকরো হচ্ছে প্রেমহীন !
মমত্বটুকু যাচ্ছে বেঁকে !

শ্রাবণ হে, এখনই কয়েকটা কাজলকালো অভিযোজন উপহার দাও।


● 

আদিল ফকির

বর্ষার রূপান্তর 

বাঁশ বাগানের শুকনো বাঁশ পাতা ভেসে গেছে
ঢেঁকি পাতা জল ভারে মাটির বুকে বুকে
হোলাব্যাঙ নিস্তব্ধ পূর্বের মত ডাক আসে না
পাশের বাড়ির সে আর জানালা খুলে না
আমার ছাতায় আমি এখন একা
চটকা জালে টেঙরা-পুটি আর খলশে উঠে না

তোমাদের বুটজুতো ভিজে গেছে
কালো পিঁপড়া-লাল পিঁপড়া সবে তো মরে গেছে
বলার কিছুই ছিল না—
চোখের পাতা বর্ষায় ভেজা ছিল
বুঝতে পারিনি কালো আর লাল

বাঁশ বাগানের শুকনো বাঁশ পাতা ভেসে গেছে
সেই দিনের বাতাসে কিছু কাচাপাতা পড়েছিলো

বুঝতে পারিনি—হয়তবা তেজপাতা ছিলো।


● 

সোহানুর রহমান শাহীন

মফস্বলী শ্রাবণে ভাঙন

মফস্বলী শ্রাবণ ধারায়
ভাঙছে বাড়ি-ঘর
মূল ভাঙছে কূল ভাঙছে
ভাঙছে পানের বর।
ভাঙছে মানুষ স্রোতের কোলে
ভাঙছে যাযাবর
ভেঙে সবাই ডুবছে জলে
আপন কি'বা পর।
ভাঙে নদী একূল-ওকূল
ভাঙছে বারে বার
ছোট্ট শিশু পায় না  খাবার
বাবাও অনাহার।
একূল ভেঙে সেকূল গড়ে
নদীর অনাচার
বানভাসি রা সব হারিয়ে
নিঃস্ব হাহাকার।
শ্রবণ ভাঙে প্রকৃতিতে
নিয়ম-নীতি মেনে
মরছে মানুষ ভাঙন খেলায়
বর্ষার এমন দিনে।

_____

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন