মেনু

রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৬

রক্তিম মিলন -এর প্রবন্ধে রবীন্দ্র ভাবনা

রবীন্দ্রনাথ এখন আভিজাত্যের হাতে বন্দী


পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা পূর্ববঙ্গের লোকদের বাঙ্গাল বলে গালি দিত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিকৃত এবং ভাঙা উচ্চারণে পাকিস্তানী সেনারা গালিটা সমগ্র বাঙালিদের দিত। গালিটা স্থায়ীভাবে থেকে গেছে। তবে সমগ্র বাঙালির জন্য নয়। এই গালি এখন দেয়া হয় শুধু চাষাভূষাদের জন্য। এই বাঙালদের জন্য রবীন্দ্রনাথ দরদ দিয়ে ভেবেছেন। রাশিয়ার চিঠিতে তিনি লিখেছেন, 'চাষীকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে হবে, এই ছিল আমার অভিপ্রায়।' খুব দরদ ভরে তাদের উন্নতির কথা চিন্তা করে তিনি লিখেছেন, 'সমবায়নীতি অনুসারে চাষের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে না পারলে কৃষির উন্নতি হতেই পারে না।'

প্রাবন্ধিক যতীন সরকারের মতে, সোনারতরী কবিতার সরল বর্ণনাটি হল- একজন কৃষক তাঁর সোনা ধান নিয়ে পাড়ে বসে আছে নদী পার করবার প্রত্যাশায়। একজন মাঝি এসে তাঁর ফসল তুলে নিল। এবার কৃষক নৌকায় উঠবে। উঠতে গিয়ে দেখে নৌকায় তিল  ধারণ করবার মত আর কোন জায়গা খালি নাই। মাঝি তাঁর সমস্ত ফসল নিয়ে চলে যায়। পাড়ে কৃষক একা বসে থাকে।

এই বর্ণনা থেকে কবিতার তাৎপর্য এভাবে বলা যায়- কৃষক তাঁর আপন শ্রমে উৎপন্ন ফসলের ন্যায্য ভাগ থেকে বঞ্চিত। কবিতাটি শ্রমিকের ক্ষোভের ধারা বর্ণনা। অথচ অভিজাত সংস্কৃতিতে কবিতার এই আবেদনটি নেই। হারিয়ে গেছে। মহাকাল ব্যক্তিকে নিয়ে যায়, সমস্ত কীর্তি রেখে যায়- নানান সব কথার ভিড়ে এভাবেই মূল কথা হারিয়েছে।

রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা কৃষকে এই রবীন্দ্রনাথের সাথে কেউ পরিচয় করিয়ে দেয় না। শহুরে আভিজাত্যে বন্দী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কোন অভিজাত আবৃত্তিকার কবিতাটি আবৃত্তি করলে হয়তো রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করা হয়। রবি ঠাকুরের মহাপ্রয়ান পালন করা হয়। কিন্তু কোনভাবেই রবীন্দ্র চর্চা সুসম্পন্ন হয় না। বাঙ্গালারা চিনতে পারে না প্রকৃত রবীন্দ্র সত্তা। অভিজাতন্ত্রে রবীন্দ্রনাথ হারিয়ে গেলে ‘বাঙাল’ গালি বুমেরাং হয়ে ফিরে যাবে শহুরে মধ্যবিত্তের কাছে! (অথবা স্বয়ং রবী হারিয়ে যাবে।)

নানা রকম আনুষ্ঠানিকতায় রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিবস, প্রয়ান দিবস পালিত হয়। কিন্তু পালন করা হয় না রবীন্দ্র চেতনা। রবীন্দ্রনাথের চেতনা, ভাবনা সব আড়ালে থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথের রক্ত করবী, রথের রশি, অচলায়তন প্রভৃতি সব রচনা যাদের জন্য তাঁরা আদতে না পারে এসব নাটক মঞ্চস্থ করতে, না পারে নাটক দেখতে। অবশ্য বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে উক্ত দিবস দু‘টি উপলক্ষে তাঁর নাটক, গল্প, উপন্যাস, কবিতা থেকে নানা রকম অনুষ্ঠান প্রচারিত হতে দেখা যায়। কিন্তু বিজ্ঞাপনের ভারিক্কিতে আয়োজনের মূল আবেদনটি থাকে বলে মনে হয় না। আবার শহুরে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নিজেদের ক্রিয়াশীলতা আর সংগঠনের অহংবোধ বাড়াতে তাঁর বিশেষ দিনগুলোতে মহা ব্যস্ত হয়ে পড়লেও না খেয়ে থাকা কৃষককুল অথবা ফসলের ন্যায্য দাম বঞ্চিত কৃষকের কোন খোঁজ রাখে না। তাতে সোনার তরী বা অন্যান্য রচনার উপযোগিতা কতটুকু থাকে?

রবীন্দ্রনাথের রক্ত করবী নাটকের কথা উল্লেখ করা যাক। শহুরে সংস্কৃতি চর্চায় ব্যস্ত নাট্যগোষ্ঠী বা সংগঠনগুলো এই নাটকের শততম মঞ্চায়ন বা তারো অধিকবার মঞ্চায়ন সম্পন্ন করেছে। কিন্তু কতবার তাঁরা গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সামনে করেছে! তাঁদের নাটক শহুরে শিল্পকলা একাডেমিতে আবদ্ধ হয়ে পড়লে রবি ঠাকুরের চিন্তার প্রসার ঘটবে না। রবির চিন্তা বইয়ের পাতা আর সাংস্কৃতিক আভিজাত্যে মাথা কুটে মারা যাবে।

রক্ত করবী নাটকের কাহিনী সারমর্ম বলা যাক- এই নাটকে শোষিত মানুষের মুক্তির লড়াই আছে। বিশু, কিশোর চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে রবী সে কথাই বারবার বলতে চেয়েছেন। ধনবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে নাটকের সমস্ত সংলাপ, কথকতা। কিন্তু বর্তমানে নাটকটির মূল অর্থ অভিজাত নাট্যগোষ্ঠীর কাছে আর নেই। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র নন্দিনীর প্রেমের উপর ফোকাস ফেলতে গিয়ে তাঁরা (অতি সম্মানী নাট্যকাররা আসলে তাঁহারা) নাটকের মূল অর্থ বদল করে দিয়েছে। এরফলে দর্শকরা নাটকটি হয়তো দেখে কিন্তু তাঁরা দার্শনিক সত্যতা বুঝতে পারে না, উপলব্ধিও করতে পারে না।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭৫তম মহাপ্রয়ান উদযাপন উপলক্ষে নিজস্ব ভাবনা। বাঙালদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বাঙালদের কাছে পৌঁছাক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন